রবীন্দ্রনাথের মন আজ ভীষণ খারাপ। আজকে দুপুরে এইচএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এডুকেশন বোর্ডের ওয়েব সাইটে ঢুকে দেখলেন সব সাবজেক্টেই এ প্লাস মিস হয়ে গেছে তার। তিনি পেয়েছেন জিপিএ ২.৫০। এটা কোন কথা হল? সারাদিন রুটির দোকানে কাজ করে কাজী নজরুল ইসলাম যেখানে পেল জিপিএ ৪.৫০, সেখানে রবীন্দ্রনাথের এই রেজাল্ট অকল্পনীয়। রবীন্দ্রনাথের ধারণা কাজী নজরুল পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়েছিল। গত কয়দিন আগে ফেসবুকে ‘ধুমকেতু’ নামে একটি আইডি লক্ষ্য করা গেছে। রবীন্দ্রনাথ মোটামুটি শিওর যে এটি কাজী নজরুলই চালায়।
রবীন্দ্রনাথ একবার রুটি কিনতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, অ্যাই কাজী ধুমকেতু আইডিটা তুমি চালাও নাকি?
কাজী নজরুল অতি নিরীহ ভাব করে বলেছে, কি যে বলেন, গরীবের আবার ফেসবুক। রুটি ভেজেই সময় পাই না।
ভয়ংকর মিথ্যাবাদী লোক।
তাছাড়া কিছুদিন ধরে কাজী নজরুলের হাতে একটা বিশাল স্ক্রিনের চায়না অ্যান্ড্রয়েড সেটও দেখা গেছে। রুটির দোকানের কর্মচারীর এত বড় অ্যান্ড্রয়েড সেট কী দরকার? রবীন্দ্রনাথ খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, নজরুল যে নান রুটির দোকানে কাজ করে সেটাতে ওয়াই-ফাই আছে। সেই ওয়াই-ফাই ব্যবহার করেই সে ফেসবুক থেকে প্রশ্ন পেয়েছে সম্ভবত। না হলে এত ভালো করার কথা না। ঘটনা তো বুঝাই যায়, পানির মতই স্বচ্ছ।
রুটির দোকানে কাজ করে এত ভালো রেজাল্ট করা গেলে সবাই পড়ালেখা করতে স্কুলে না এসে রুটির দোকানেই যেত। রবীন্দ্রনাথ নিজের রেজাল্ট মানতে পারছেন না। বাংলা পরীক্ষাটা অবশ্য একটু খারাপ হয়েছিল। সেটাই ডুবিয়েছে।
বাংলা প্রশ্ন হাতে পেয়েই রবীন্দ্রনাথ চিৎকার করে বলেছিলেন, সব কমন, এ প্লাস নিশ্চিত, নয়ন বন্ধ করিয়া এ প্লাস অর্জন করিব। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলেন, একটি প্রশ্নও তিনি চিনতে পারছেন না। তখনই তিনি উপলব্ধি করেন যে এত জোরে চিৎকার দেয়া ঠিক হয়নি, প্রশ্ন না পড়েই। এখন তো পাশ নিয়েই টানাটানি।
প্রথম প্রশ্নটা ছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার প্রথম দশ লাইন লিখে ব্যাখ্যা কর। কোন মানে হয়? এটি কোন কবিতা রবীন্দ্রনাথের মনে পড়লো না। তিনি তো জুতা আবিষ্কার করেন নি। তাহলে তাকে কেন এই কবিতা লিখতে হবে? রবীন্দ্রনাথ অনেক ভেবেও তার নিজের লেখা এই কবিতার একটি লাইনও মনে করতে পারলেন না। অগত্যা সামনের সিটে বসা কাজী নজরুল ইসলামকে ডাক দিলেন। কাজী নজরুল তখন খুব যত্ন সহকারে খাতায় তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ব্যাখ্যা করছিল যদিও এটি সিলেবাস বহির্ভূত।
‘এই কাজী, শুনতে পাচ্ছিস? নাকি বিজি? একটু পেছনে তাকা প্লিজ। সত্যি করে বলছি তোকে, পরীক্ষার পর দু-আনার সন্দেশ খাওয়াবো, ওকে?’
‘কে? ভানুসিংহবাবু নাকি? কর্তা, মোরে ক্ষমা কোরো, সময় খুব অল্প বাকি। আমি ‘কাকতারুয়া’ উপন্যাসের ব্রড প্রশ্ন অ্যান্সার করিতেছি। তুমি বাপু যন্ত্রনা কোরো না। ইহা অ্যান্সার শেষে তোমাকে সময় দেব খন।’
‘শুনে রাখ হে কাজী, তুই যে এত পাজি, তাহা আমি আগে ঠাহর করিতে সক্ষম হই নাই। তা ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাখানির দু একটি চরণ বলতে পারবি? তোকে সন্দেশের সাথে দুটা লাঠি বিস্কিটও খাওয়াবো।’
‘উহু মশাই, জুতা বিষয়ক কোন কবিতা আমার পড়া নাই। এইসব আজেবাজে চ্যাপ্টার আমি বাদ দিয়াছি। আমি বিদ্রোহী কবিতার চ্যাপ্টার থেকে অ্যান্সার করিব তাই।’
রবীন্দ্রনাথের মেজাজ চরমে উঠলো। ফাউল পোলাপান কোথাকার। সামান্য রুটির দোকানে কাজ করে কি তেজ! বেকুবটা নাকি বিদ্রোহী কবিতা থেকে অ্যান্সার দিবে? আরে বেকুব সেই কবিতা কি আছে পাঠ্য বইতে?
কাজী নজরুল ইসলামের মত স্টুডেন্টও যে পরীক্ষার হলে এতটা ভাব দেখাবে সেটা তার কল্পনায় আসেনি। বাইরে বের হয়ে সাইজ করতে হবে। কোমরে দুইটা বাড়ি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ অসহায়ভাবে চারপাশে তাকালেন। তার দুই বেঞ্চ সামনে শরৎচন্দ্র পরীক্ষা দিচ্ছিলো। শরৎচন্দ্র ক্লাসের ফার্ষ্টবয়। এই জাতীয় ছাত্রকে ডাকলেও এরা তাকাবেনা। এরা হল ঘাউরা প্রজাতির। শরৎচন্দ্র তখন ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের প্রশ্নটি অ্যান্সার করছিল চিন্তিত মুখে। এই গল্পটা কী বিষয়ক ছিল সেটা ঠিক মনে আসছে না। আজকাল এত কিছু কি মনে রাখা যায়? আর যেটা বইতে থাকে সেটা মনে রাখার দরকারই কী? দেশের পড়ালেখা কোনদিকে যাচ্ছে! শরৎচন্দ্রকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বেশ চিন্তিত মনে হল। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে ডাকার চিন্তা বাদ দিলেন।
বাম দিকের কোনার বেঞ্চে পরীক্ষা দিচ্ছে বেগম রোকেয়া। দূর থেকে তাকে দেখতে নিরীহ বাঙ্গালীর মত লাগছে। রবীন্দ্রনাথ তাকে ডাকলেন। বললেন, বৌদি পরীক্ষা কেমন দিচ্ছ গো? আমার তো সবই কমন। তোমাকে দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে আজ। সুগন্ধিতে ভরিয়া উঠিয়াছে চারপাশ। তুমি কি স্যান্ডালিনা দিয়ে স্নান করেছ নাকি?
বেগম রোকেয়া পাত্তা দিল না। রবীন্দ্রনাথের গা জ্বলে গেল। এই মেয়ে নিজেকে ভাবে কী! এই মেয়ে কি জানে রবীন্দ্রনাথ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে এমন শত শত মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে? এদের মধ্যে কয়েকটার নাম রোকেয়াও আছে। খবর নিলে দেখা যাবে এইসব রোকেয়ার ভেতর বেগম রোকেয়াও আছে।
রবীন্দ্রনাথের পেছনে পরীক্ষা দিচ্ছেন এই প্রজন্মের কবি ভবঘুরে সালাম। ভবঘুরে সালাম ক্লাসের লাস্ট বয়। তাছাড়া সাহিত্য এই ছেলে কিছু বুঝে বলে মনে হয় না। এগুলোকে হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া দরকার। রবীন্দ্রনাথ একে ডাকার ভরসা পেলেন না। জিজ্ঞেস করলে হয়তো ভুল উত্তর বলে দিবে। এরা ভুল উত্তর কনফিডেন্টলি বলে। নিজেরাও ডুবে, পাশেপাশে যারা থাকে তাদেরও ডুবায়। এগুলো ডেঞ্জারাস পোলাপান।
রবীন্দ্রনাথের দুই বেঞ্চ পেছনে আছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন অ্যাভারেজ টাইপের স্টুডেন্ট, টেনে টুনে পাস করে। জসীমউদ্দীনের কোন প্রশ্নই কমন পড়েনি। নাইন-টেনের বইতে তাঁর লিখিত একটি কবিতা পাঠ্য করা হয়েছে। সেটির নাম এখন মনে আসছে না। মনে এলে সেটি নিয়ে কিছু লেখা যেত। সে এখন খাতায় তাঁর সিলেবাস বহির্ভূত কবিতা ‘কবর’ এর বৃদ্ধ দাদুর করুণ কাহিনী লিখছে আর একটু পর পর রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। রবীন্দ্রনাথ উপায় না দেখে তাকেই ডাক দিলেন।
'হে জসী, একটু এদিকে তাকাবি ভাই? দু-আনার সন্দেশ খাওয়াবো তোকে একাই।’
‘আরে ভানুদা যে! বল কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’
‘বাপু তুই আমাকে বাঁচা প্লিজ। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কোন চরণ কি তোর স্মরণে আছে? নাকি মেমরি থেকে হয়ে গেছে সিজ?’
‘সে কি! থাকবেনা কেন? জুতা নিয়ে এমন কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর আছে? এই কবিতা যিনি লিখেছেন তিনি এই ভুবনের সেরা কবি। এইসব কবিতা ধরেনা গাছে।’
রবীন্দ্রনাথ মনে মনে খুশি হলেন। যাক জসীমউদ্দীন অন্তত তার কবিতার মর্ম বুঝল। জসীমউদ্দীন লোকটাকে তার মাটির মানুষ বলে মনে হল। লোকটার গায়ে মাটি মাটি একটা গন্ধ আছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, জসী, তুই-ই আমার সত্যিকার বন্ধুরে। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার লাইনগুলো বল দেকিনি। জসীমউদ্দীন ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার লাইনগুলো বলতে থাকলো। রবীন্দ্রনাথ শুনে শুনে লিখতে থাকলেন। লেখার ফাঁকে বেগম রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার মুচকি হাসলেন।
জসীমউদ্দীন ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার যে লাইনগুলো বললো:
“ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।”
পুরো কবিতা লেখা শেষ করে রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষার হল ছেড়ে বের হয়ে এলেন খুশি মনে। এ প্লাস নিশ্চিত। কিছুক্ষণ পরে জসীমউদ্দীনও বের হল। রবীন্দ্রনাথ জসীমউদ্দীনকে বুকে জড়িয়ে ধরে দু-আনার সন্দেশ এবং আলু পুড়ি খাওয়ালেন। আজকের রেজাল্টে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন তিনি বাংলায় ডি গ্রেড পেয়েছেন। এখন ইচ্ছা করছে জসীমউদ্দীনকে ধরে সাইজ করতে। এই শয়তান ছেলেই তাকে ভুল-ভাল কবিতা বলে দিয়ে এই অবস্থা করেছে। জুতা বিষয়ক কবিতায় ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা’ আসে কী করে? আগেই বুঝা উচিত ছিল। বিরাট বোকামী হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ আজ দুপুরের পর থেকে কিছু মুখে দিতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের বন্ধুরা সবাই মিষ্টি বিতরণ করছে। একটু আগে তার ক্লাসমেট হুমায়ূন আহমেদ এসে মিষ্টি দিয়ে গেল। হুমায়ূনের নাকি এক সাবজেক্টের জন্য গোল্ডেন ছুটে গেছে। এজন্য মন খারাপ। রবীন্দ্রনাথ মনে মনে বলবেন, অ্যাহ! ঢং কত! এ প্লাস যে পেয়েছ সেটাই তো কপাল। আবার গোল্ডেন চায়!
বিকেলে পাড়ার মাতব্বরের ছেলে সমরেশ মজুমদার এক বাক্স রসমালাই দিয়ে গেল। সে গোল্ডেন পেয়েছে। এসব দেখে রবীন্দ্রনাথের মন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সবাই তার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে।
রবীন্দ্রনাথ তার পাড়ার বড় ভাই বঙ্কিমচন্দ্র ফোন দিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বাসে ঝুলে বাসায় যাচ্ছিল। সে ঝুলন্ত অবস্থায়ই রবীন্দ্রনাথের ফোন রিসিভ করলো।
‘হ্যালো, কে, বঙ্কিমদা নাকি?’
‘আরে ভানু, কী খবর তোর?’
‘আর বোলো না। তোমার কী খবর?’
‘তুইও আর বলিস না, আমি তিন সাবজেক্টে ফেইল। বাংলায় দুই পেয়েছি।’
বঙ্কিমচন্দ্র ফেল করেছে শুনে রবীন্দ্রনাথ খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন। যাক একজন অন্তত তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। এই লোককে মিষ্টি দেয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বললেন, বঙ্কিম আমি পাস করেছি। তোমার বাসায় মিষ্টি নিয়ে আসছি। পাশের আনন্দ ভাগ করে নিতে হবে তো। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব সেই ব্যাপারে তোমার পরামর্শও লাগবে। পাস করে গুরুজনকে ভুলে যাব ওমন অকৃতজ্ঞ আমি কোনকালেই ছিলাম না।
পাঠকের মন্তব্য ( ৬ )
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন