এমন সঙ্কটে জীবন বাবু কখনো পড়েন নি। এই একটু আগে বন্ধু মহসীন এসে তাঁকে ধরেছেন। এবার আর ছাগ নয়, এই ঈদে তারা আস্ত একটা গরুই কুরবানি দেবে। জীবনানন্দ যেন তাকে সাহায্য করে গরু কেনায়। সম্ভব হলে জীবনানন্দ দাশ আকাশ থেকে পড়তেন। সম্ভব হলো না। তিনি বসেছিলেন ভাঙা হাতলের বুড়োমার্কা চেয়ারে। সেখান থেকে শুধু পিছলে গেলেন। ডাগর চোখে মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি গরু কিনব কীভাবে? আমি তো জীবনেও গরু কিনিনি মহসিন! মহসিন বলল, তুই কখনো হাজার বছর বেঁচেছিস?
জীবন বাবু পিটপিট চোখে এবার তাকালেন। মহসিন বলল, বাঁচিস নি তো? কিন্তু লিখেছিস তো হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি...তাহলে? জীবনে যা করিস নি তা যদি লিখতে পারিস তাহলে একটা গরু কিনতে পারবি না!
জীবন বাবু বললেন, কিন্তু গরু কিনতে আমিই কেন?
মহসিন বলল, শোন সকলেই যেমন কবি নয়, তেমনি সকলই কিন্তু গরু নয়। তুই যদি কবিকে চিনতে পারিস তাহলে গরুকেও চিনতে পারবি। গরু আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নাই!
: কী বলিস এসব?
: ঠিকই তো বলি। গরু যেমন খাওয়ার সময় খেয়ে নেয় হাপুস-হুপুস তারপর সারাদিন বসে ঝিমায় আর জাবর কাটে...কবিরাও তেমনি সারাদিন এটা-ওটা দেখে আর সারা রাত বসে বসে সেগুলো নিয়ে জাবর কাটতে থাকে...আর কাগজ-কলম বা ল্যাপটপ নিয়ে কবিতা লিখে যায়। কবিতা লেখা আর জাবর কাটার মধ্যে পার্থক্যটা কী বল? না না তুইই বল, পার্থক্যটা কী? শোন, গরু উপকারী...কবিও মোটামোটি উপকারী...বিশেষত এদের কবিতার লাইন প্রেম করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভালোই কাজে লাগে। এবার আর কথা না, চল আমার সাথে। আজকে একটা ভালো গরু কিনতেই হবে।
পরের দৃশ্য গরুর হাটে। ধানসিঁড়ি হাট। আর হাটের ভেতর হাজার হাজার মানুষ, নাকি লাখ লাখ? জীবনানন্দ দাশের তব্দা খাওয়ার অবস্থা। এত মানুষ? তিনি একটু নির্জনতা পছন্দ করেন। কিন্তু শুধু তো মানুষ না। মানুষের মধ্যেই সারি সারি গরু। নানান ধরনের গরু। যেন মানুষ আর গরুর এক মহামিলনমেলা। আহা! কিন্তু জীবনানন্দের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। এত মানুষের ভিতর বা এত গরুর ভিতর তিনি কী করবেন?
মহসিন তাকে টানতে টানতে প্রথমেই নিয়ে গেল একটা মাটিরঙা গরুর সামনে। গরুটা তাকিয়ে আছে ছলোছলো চোখে। অন্তত জীবনানন্দের তাই মনে হলো। মহসিন কিছু দর-দাম করে ওঠার আগেই চোখের সামনেই গরুটা বিক্রি হয়ে গেল। তাতে গরুটা খুশিই হলো কিনা বলা মুস্কিল। হতেও পারে। এখানে তীব্র রোদ। খাদ্যের অভাব। সব মিলিয়ে গরুটা হয়তো ভাবছে নতুন ঠিকানাই তার জন্য শুভ। টুংটাং করে নিজের গলার ঘণ্টি বাজিয়ে সে যেতে লাগল ক্রেতার সাথে। আহারে, গরুটা জানে না কী পরিণতি তার সামনে। জীবনানন্দ বলে উঠলেন--
গরুঞ্জনা, ওই দিকে যেও নাকো তুমি
দিও নাকো দড়ি ওই বুড়োটার হাতে;
ফিরে এসো গরুঞ্জনা
লোক-জঞ্জাল ভরা এই ধানসিঁড়ি মাঠে...
গরুটি হাম্বা করে দুইবার ডেকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে গেল। মহসিনের মুখে আফসোস। বলল, ভালো গরু ছিল। মিস হয়ে গেল! চল, চল ওই গরুটাকে দেখি...দেখেছিস তার লেজ কী সুন্দর...
কিন্তু সৌন্দর্যের চেয়ে বরং জীবনানন্দ দাশ তাকে দেখল দুখী হিসেবে। কেমন মায়া মায়া চেহারা। মাথা এক দিকে করে জাবর কেটে চলেছে বিষাদগ্রস্থ চোখে। আহা! জীবনানন্দের বুকটা ডুকরে উঠল।
হয়তো তার গাভিটি শুয়ে ছিল পাশে-- বাছুরটিও ছিলো
ঘাস ছিলো, হাম্বা ছিলো--জঙ্গলে--তবু সে দেখিল
কোন কসাই? জাবর কাটা হলো না তার
অথবা জাবর কাটে নাই বহুকাল-- ধানসিঁড়ি হাটে শুয়ে জাবর কাটিছে এবার।
মহসিন গরুর দাম জিজ্ঞেস করতেই কয়েক লক্ষের অঙ্ক জীবনানন্দের কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। একটা গরুর দাম ২৫ লাখ? বাপরে বাপ! এতো মানুষের চেয়ে ঢের বেশি দামী। ভুল লিখেছেন ভুল লিখেছেন তিনি। নিজেকে দুষতে শুরু করলেন। তাঁকে লিখতে হতো--
আমি যদি হতেম বুনোগরু
বুনোগাভী হতে যদি তুমি
লক্ষ টাকা দাম হয়ে চড়িতাম ধানসিঁড়ি তৃণভূমি!
দাম শুনে মহসিনেরও অবস্থা খারাপ। ভিড়ের মধ্যে জীবনানন্দকে টেনে প্রায় পালিয়ে আরেক পাশে চলে আসে সে। এখানে কিছু গরু আছে। আকৃতিতে ছোট ছোট। প্রকৃতিতে নরম। তবে একটা গরুর দশা ভিন্ন। সে তার খুঁটি ধরে একা একা ঘুরে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন--
হায় গরু, সোনালী কানের গরু, এই খটখটে খড়ের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো বাঁকাত্যাড়া খুটিটিকে ঘুরে ঘুরে।
গরু জীবনানন্দ দাশের কথা আমলে নিলো। ঘোরা বন্ধ করে দুইবার কান ঝেড়ে গোবর ঢালা শুরু করল। তাতে বাতাস কিছুটা ভারী হয়ে আসল বটে। আর তখনই আওয়াজ উঠল হাটজুড়ে, পালাও পালাও! কাহিনি বুঝতে মহসিন ছুটন্ত একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই? লোকটি বিস্ফোরিত চোখে বলল, হাটের সবচেয়ে ষণ্ডা ষাঁড়টা খুঁটি উপড়ে ছুটে গেছে। এখন যাকে পারছে তাকেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে পেছনের হাড়হাড্ডি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলছে...জানে বাঁচতে চাইলে পালাও...
সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী হাম্বা রব এলো। আরও একদল লোক স্যান্ডেল ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুঙ্গি ফেলে দৌড় দিল। অনেক ধুলো আর বাতাসের ভেতর একটা ষাঁড়ের নিঃশ্বাসের প্রায় গরম বাতাস অনুভব করলেন জীবনানন্দ দাশ। দৌড় দিলেন তিনি। দৌড়াতেই থাকলেন। আর যতবার পেছন ফিরে তাকালেন দেখলেন একটা ষাঁড় তার পেছনে তেড়ে আসছে। জীবনানন্দ দাশের পরনের লাল ফতুয়া ষাঁড়টার হয়তো মনে ধরেছে।
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আর কবিরা যখন হাঁটে তখনো কবি। যখন ঘুমায় তখনো কবি। আর যখন প্রাণভয়ে দৌড়ায় তখনও তো কবি। তাই দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন--
হাজার বছর ধরে দৌড়াইতেছি আমি ধানসিঁড়ি মাঠে
খড়-বিচালি, কচি ঘাস থেকে থকথকে গোবর সাগরে
অনেক ছুটেছি আমি; ধুলো ওড়া বালিময় ধূসর তল্লাটে
এখন রয়েছি আমি; আরো দূর না গেলে যাবো বুঝি মরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিক হৈ-হল্লায় যেন নরক গুলজার
আমারে তাড়া করিয়াছে কোথাকার কোন এক ষণ্ডামার্কা ষাঁড়॥
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন