বহু বহু বছর আগের কথা। আমার দাদা হাট থেকে গরু কিনে এনেছেন। এখন যেমন শহরে গরু এনে আমরা গ্যারেজে পুরে রাখি, গ্রামের দেশে ব্যাপারটা তেমন না। গরু নিয়ে আসার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় কুরবানির উৎসব। গরুকে খাওয়ানো, গরুকে গোসল করানো এইসব নিয়েই মত্ত হয়ে পড়ে সবাই। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে খড় বিচুলি দিয়ে গরুকে খাওয়ানো হয়- যাতে তাদের অন্তরে পশুর প্রতি মায়া-মহব্বত তৈরী হয়।
এহেন আদর-যত্নের মধ্যে থেকেও সেবারের গরু একটা অসাধ্য সাধন করে ফেললো। একটু সবাই চোখ ফিরিয়েছে, ব্যস... গরু মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া! হাওয়া তো হাওয়াই... গরুর আর কোন পাত্তা নেই! আক্ষরিক অর্থে গরুখোঁজার পর যখন নিশ্চিত হওয়া গেলো, গরু মাসুদ রানা স্টাইলে গ্রাম থেকেই পালিয়ে গেছে- ভগ্ন মনোরথে সবাই আরেকটা গরু কিনতে রওনা দিলেন। কুরবানির জন্য যদি গরু কিনে থাকেন, তাহলে যেটাই হোক- কুরবানি আপনাকে দিতেই হবে। এটাই বিধান।
এদিকে আরেক গ্রামে বসে আমার ফুপা যখন খবর পেলেন যে তাঁর শ্বশুরসাহেবের গরু হারিয়ে গেছে, তিনি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। সাথে সাথেই আমাদের গ্রামে লোক দিয়ে একটা গরু পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
ফিরে আসা যাক আবার আমাদের বাড়িতে। হাটে যারা গরু কিনতে গিয়েছিলেন, তারা ফিরেছেন নতুন গরু নিয়ে। এরমধ্যেই জামাইবাড়ি থেকে পাঠানো গরু এসে হাজির। দুই গরু সামলানো নিয়ে ব্যস্ত বাড়ির লোকজন। কিন্তু দূরে কিসের যেন হইচই...
কী ব্যাপার? যে গরুটা প্রথমে হারিয়ে গিয়েছিলো, সে ব্যাটা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে দুই গ্রাম পরে! সেটাকে ধরে বেঁধে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এক গরু থেকে আমার দাদার সেবার কুরবানি দিতে হলো তিন গরু!
তখন তো আর এখনকার মতো ফ্রিজের সিস্টেম ছিলো না যে একটুখানি হাঁড়িতে চড়িয়ে বাকিটা ফ্রিজের পেটে ঢুকিয়ে ফ্যালো! নিজেরা খাওয়া হলো পেটপুরে, গ্রামের মানুষকে দেয়া হলো জান ভরে, মিসকীনরা পেলো দু'হাত ভরে। আর আমার চাচা-ফুপুরা যেন কয়েকদিন মাংসের উপরেই ভাসলেন। এই বড় বড় তামার হাঁড়ি, তাতে কত রকমের মাংসের ভেলকি! ঝুরঝুরা মাংস, তেলতেলা মাংস, নলার হাড়, হাড় ছাড়া মাংস, সল্টেড বিফ... সেইসব দিনের কথা বলতে গিয়ে তাঁরা যেন আবার সেই ছেলেবেলায় ফিরে যান। তাঁদের চকচকে চোখে যেন ফিরে ফিরে আসে ছোটবেলার সেই বাঁধনহারা খুশির ঝলক!
যে খুশি তাঁদের চোখে দেখি, ঈদের আনন্দ যেন এইভাবেই চোখেমুখে ভেসে থাকে ছোট ছোট শিশুদের, যুবাদের, বয়ষ্কদের চোখে মুখে। ঈদ সবার জন্যই বয়ে নিয়ে আসুক আনন্দের বার্তা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন