বইমেলার পর যেভাবে আমার জীবন অন্যরকম হয়ে গেলো

১৩৪৯ পঠিত ... ১৮:৩৩, মে ২৩, ২০১৮

বইমেলা উপলক্ষে একবার আমার একটা বই বের হয়েছিল। তারপর থেকে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে গেল।

বইটা যে খুব ভালো মানের ছিল, তা নয়। নিতান্তই এলেবেলে আর ফালতু ধরনের কিছু লেখালেখির সংকলন।

আমার ধারণা ছিল, আমার বন্ধুবান্ধব আর চেনা-পরিচত লোকজন ভদ্রতা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশেক কপি কিনবে। আর আমাকে হয়তো গোপনে রকমারি ডটকম থেকে আরও বিশ কপি অর্ডার দিয়ে কিনে আনতে হবে, যাতে কিছু মানুষকে উপহার দিতে পারি। তারপর অবশিষ্ট বইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে প্রকাশক বেচারা হয়তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়বে। বলা যায় না, আমাকে লাঠি নিয়ে খুঁজতে বেরও হয়ে যেতে পারে তাকে ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে দাঁড়া করিয়ে দেওয়ার জন্যে।

বাস্তবে অবশ্য পরিস্থিতি এতটা খারাপ হলো না। আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে পূর্বধারণার চেয়ে সামান্য কিছু বই বেশি বিক্রি হয়ে গেল।

আমি ফেসবুকে নানা রকম পোস্ট দিয়ে নিজের বইয়ের কিছু কিছু প্রচার চালিয়েছিলাম। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে যারা আগে থাকতেই অনেক বিখ্যাত এবং হাজার হাজার ফলোয়ারের মালিক, চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে গোপনে ইনবক্সে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুনয়-বিনয় করে রাজি করালাম, তারাও যেন আমার বই নিয়ে ভালো-ভালো কিছু কথা লিখে পোস্ট দেয়। আমার চাপাচাপিতে হোক, আর যে কারণেই হোক, তারা তাদের কথা রাখল। বইয়ের প্রচ্ছদ-সহ নানা রকম পজিটিভ রিভিউ প্রকাশিত হলো।

অলংকরণ: সামির

চারিদিকে বইয়ের ব্যাপক প্রচার দেখে ফেসবুকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টের অনেকেই ঘোষণা দিল, তারা এই বই কিনবে। আমি তাদের এই ঘোষণায় মোটেও বিভ্রান্ত হলাম না। ফেসবুকবাসী লোকজনের ওপর আমার ভরসা আগে থেকেই অতি সামান্য। বহুবার দেখেছি, কোনো একটা ইভেন্টে হাজার হাজার মানুষ ‘গোয়িং’ দিয়ে বসে আছে। কিন্তু যথাসময়ে ইভেন্টে উপস্থিত হয়েছে হাতে গোনা চার-পাঁচজন।

আমার পূর্বানুমান ভুল প্রমাণিত করে ফেসবুকে দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী অনেকেই চলে এলো বই কিনতে। স্টলের লোকজনের দম ফেলার সময় নেই, এমন অবস্থা। সব বই হট-কেকের মতো বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল বলে দম ফেলা যাচ্ছিল না, তেমন না। ক্রেতাকে হয়তো একটা বই দেওয়া হলো, তিনি নেড়েচেড়ে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘এটা বদলায়া দেন, এটার বাঁধাই ভালো না।’

তাকে আরেকটা বই দেওয়া হলে, সেটাও নেড়েচেড়ে দেখার পর ফেরত আসে, ‘এটাও বদলায়া দেন, এটার মলাট ছেঁড়া।’

তাকে আরও একটা বই দেওয়া হলে, সেটাও নেড়েচেড়ে দেখার পর ফেরত আসে, ‘এটাও বদলায়া দেন, এটার ছাপা খারাপ।’

এভাবে বই বিনিময় করতে করতেই পাঁচ মিনিট চলে যায়। তার ওপর ডিসকাউন্ট দিয়ে বইয়ের দাম আসে ১৯৭ টাকা। কেউ তো আর এই টাকা খুচরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। ফলে সবাইকে ৩ টাকা করে ভাংতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। স্টলের লোকজন এই খুচরা টাকা যোগাড় করতে গিয়ে মহাবিরক্ত।

আমি নিজে অবশ্য প্রতিদিন বিকেলের পর স্টলের সামনে কলমের মাথা খুলে অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। যদি কেউ বই কিনতে আসে!

অটোগ্রাফ দেওয়া নিয়েও দেখি আরেক বিপদ।

আমি বেশিরভাগ মানুষের নাম মনে রাখতে পারি না। কেউ যখন বই কিনে হাসিমুখে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে অটোগ্রাফ চায়, আমি মহাবিপদে পড়ে যাই। কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারি না।

খুব কায়দা করে জানতে চাই, ‘আচ্ছা। আপনি কি নামের বানান হ্রস্ব-ই দিয়ে লেখেন নাকি দীর্ঘ-উ দিয়ে লেখেন?’

সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মুখ কালো হয়ে যায়, ‘আমার নাম তো অমুক। হ্রস্ব-উ, দীর্ঘ-উ কোথায় পেলেন?’

আমি তাড়াতাড়ি বিগলিত কণ্ঠে বলি, ‘ওহ্। তাই তো... আসলে আমি ভেবেছিলাম ডাকনামের বদলে ভালো নাম দিয়ে লিখব। ফেসবুকে তো কী জানি একটা খটোমটো নাম দেখি...।’

বই-ক্রেতা সন্দেহের সুরে বলেন, ‘আপনি আসলে আমার নাম ভুলে গিয়েছেন, তাই না? সত্যি করে বলেন...।’

আমাকে তখন দুর্বল গলায় বলতে হয়, ‘আশ্চর্য! নাম ভুলে যাব কেন? কী যে অদ্ভুত কথা বলেন না...।’

তারপর আর কথা না বাড়িয়ে খসখস করে অটোগ্রাফ দিয়ে বই-ক্রেতার সঙ্গে ঝটপট সেলফি তুলে ফেলি।

বইমেলায় ওই বই শেষ পর্যন্ত কেমন বিক্রি হয়েছিল, জানি না। তবে বই লেখার কারণে অন্যদিক থেকে চরম সর্বনাশ হয়ে গেল। বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা থেকে লেখার জন্যে বায়না আসতে শুরু করল। একেকজনের একেক রকম বায়না। বইমেলা শেষ হওয়ার আগেই কয়েক ধরনের বায়নার তালিকা হাতে পেয়ে গেলাম। সেগুলো এ রকম :

১. সায়েন্স ফিকশন। একদম বিশুদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প। কোনো ফ্যান্টাসি না। রূপকথা মেশানো যাবে না। ধারাবাহিক হলেও চলবে।

২. বাচ্চাদের গল্প। দুই হাজার শব্দের বেশি না। এর চেয়ে বেশি হলে ছাপানো মুশকিল। একদম কম বয়সী বাচ্চা না, আবার বেশি বড়ও না। কিশোরদের উপযোগী গল্প। রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার, হরর... যা খুশি।

৩. খাঁটি রম্য রচনা। লেখার পরতে পরতে দম ফাটানো হাসির উপাদান থাকতে হবে। নির্ভেজাল হিউমার। সাবধান, ভাঁড়ামি যেন মনে না হয়।

৪. বড়দের উপন্যাস। প্রেম, দাম্পত্য, বিরহ, জীবনঘনিষ্ঠ, হতাশা, ব্যর্থতা। একটুখানি উসকানি।

অলংকরণ: সামির

আমি লেখালেখি সংক্রান্ত এই বায়নার তালিকা হাতে নিয়ে বিমর্ষ মুখে বসে থাকি। আমি তো লেখক না। আমি এসব কঠিন কঠিন রচনা কীভাবে লিখব? আমার নিরেট মাথা থেকে তো কিছু বের হয় না। কেউ কি আমার হয়ে লিখে দেবে?

আমি ঠিক করলাম, বই আর লেখালেখি সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যত বেশি কথা, তত বেশি পচানি খাওয়ার ঝুঁকি। নিজে থেকে তো কিছু বলবই না, কেউ বলতে এলেও মুখ বন্ধ রাখব।

আমার বাকি আর দশটা পরিকল্পনার মতো এই পরিকল্পনাও শেষ পর্যন্ত মাঠে মারা গেল। একটা এফএম রেডিও থেকে আমার ডাক পড়ল ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যে।

আমি কিছুদিন রেডিও আর টেলিভিশনে কাজ করেছিলাম বলে আমার আগে থাকতেই অল্প অল্প ধারণা ছিল এই জাতীয় ইন্টারভিউতে কেমন করে কথা বলতে হয়।

কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। আমি মোটেই গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। কথাবার্তা হয়তো শুরু করলাম, কয়েক লাইন বলার পরেই খেই হারিয়ে মূল প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে অন্য লাইনে চলে যাই। শ্রোতারা মহাবিরক্ত হয়। এ ছাড়া মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলতে গেলে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, পেটের মধ্যে শিরশিরে ভাব হতে থাকে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

কাজেই এফএম রেডিও থেকে একজন মানুষ যখন ফোন দিয়ে চিকন গলায় বলল, ‘ভাই, অমুক দিন আপনি আমাদের লাইভ শোতে আপনার বই নিয়ে একটু কথাবার্তা বলে যান,’ ...আমি ঠিকমতো আপত্তি জানাতেও পারলাম না।

আমি তাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি বাক্য বলার চেষ্টা করলাম--

‘ভাই শোনেন, আমি আসলে কথাবার্তা ভালো করে বলতে পারি না।’

‘আমার লেখা বইটাও সেই রকম পদের কিছু হয় নাই।’

‘এই বই নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো।’

কিন্তু একে তো গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তার ওপর কাউকে মুখের ওপর ‘না’-ও বলতে পারি না; কাজেই আমি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘জি আচ্ছা’ বলে রাজি হয়ে গেলাম।

এফএম রেডিও থেকে ফোন করা মানুষটা জরুরি কিছু তথ্য দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার লাইভ শো হবে। রেডিওতে তো চেহারা দেখা যায় না, আমরা পুরা শো ফেসবুকে লাইভ করব। আপনি কিন্তু ভালো জামা-কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে আসবেন।’

আমি টেলিফোনের এ-পাশে দ্রুত মাথা নেড়ে আবারও সম্মতিসূচক ধ্বনি করলাম। ফোনের ও-পাশের মানুষটা দ্রুত আমাকে তাদের অফিসের ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে ফোন রেখে দিল।

নির্ধারিত দিন আমি লাইভ শোতে যাওয়ার জন্যে সকাল-সকাল সুন্দর জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হলাম। যদিও রেডিওতে শো, তারপর নতুন ব্লেড দিয়ে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে আয়নায় নিজেকে ভালোমতো দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম, যথেষ্ট ফিটফাট লাগছে কিনা।

উবারে গাড়ি ডাকতেই এক মিনিটের মধ্যেই ঝাঁ-চকচকে একটা টয়োটা এলিয়ন এসে উপস্থিত। চারিদিকে ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও সেই গাড়ির ভেতর শীত-শীত আবহাওয়া আর ফুলের সুবাস।

আনন্দিত চিত্তে রওনা হলাম।

জীবনের প্রথমবার কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি। অল্প অল্প নার্ভাস। তবে মনে মনে পুলকিতও বটে। যা-ই দেখি, তা-ই ভালো লাগে। নীল নীল আকাশ, সাদা সাদা মেঘ। হাতিরঝিলের পানিতে সেই আকাশ এবং মেঘের অদ্ভুত প্রতিফলন। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি আটকে আছে, সেটাও মনে হলো অতি সুমধুর দৃশ্য।

এর মধ্যে আমি ওই এফএম রেডিওর ফেসবুক পেইজে ঢুকে দেখি, দুইদিন আগেই তারা একজন ফেসবুক সেলিব্রিটিকে তাদের শোতে ডেকে এনে বিশাল ইন্টারভিউ করেছে। ফেসবুক পেইজ-জুড়ে সেই সেলিব্রিটির হাসিমাখা ছবি সংবলিত নানা রকম বিজ্ঞাপনী পোস্ট। সেই পোস্টে হাজার হাজার লাইক।

আমি একটু আগে-পিছে করে খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম, বাই চান্স আমাকে নিয়েও একই ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন করা হয়েছে কিনা। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে খুব ছোট্ট করে লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হলো। আমি কোথাকার কে, বিজ্ঞাপন করার কথা আসবে কোথা থেকে!

রাস্তায় জ্যামের কারণে আমার পৌঁছাতে আধঘণ্টা দেরি হলো।

গুগল ম্যাপ দেখে ঠিকানা মিলিয়ে জায়গামতো গিয়ে দেখি সেখানে একটা বহুতল ভবন অবস্থিত। লিফট থেকে ১৫-তলায় নেমে একটু ধাক্কার মতো খেলাম। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু জুতা আর জুতা। নানা রঙের, নানা সাইজের। কোনোটা মেয়েদের, কোনোটা ছেলেদের।

‘এখানে জুতা খুলেন। তারপর ভিতরে ঢুকবেন।’

নীল ইউনিফরম পরা সিকিউরিটি গার্ড। দুই চোখে রাজ্যের সন্দেহ নিয়ে আমাকে দেখছে।

আমি জুতা খুলে সমীহের সঙ্গে এফএম রেডিওর অফিসের ভেতরে ঢুকলাম। রিসিপশনে দেখি একজন নারী আর একজন পুরুষ মুখ ভোঁতা করে বসে আছে।

যে মানুষটা আমাকে ইন্টারভিউতে আসার জন্যে ফোন দিয়েছিল, আমি তার নাম বললাম। ভোঁতামুখী নারী বিরক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, কোনো কথা বলল না। ভোঁতামুখী পুরুষটি নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘উনি আসেন নাই। বসতে হবে।’

আমি রিসিপশন টেবিলের সামনে রাখা সোফায় বসতে বসতে চট করে ঘড়ি দেখে নিলাম। দেড়টার মতো বাজে। যেই মানুষটা আমাকে ফোন দিয়েছিল, সে আসেনি। এর অর্থ হলো, শো নিশ্চয়ই ক্যানসেল হয়ে গেছে। আমি সামান্য মানুষ, তাই মনে হয় আমাকে আর আগ বাড়িয়ে সেই তথ্য জানানোর সময় পায়নি। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে সেই মানুষটাকে কয়েকবার ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। বুঝতে পারছি না, চলে যাব নাকি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব।

আমি বসে বসে এফএম রেডিও অফিসের রিসিপশন কক্ষে সাজানো নানা রকম ছবি আর গ্রাফিক্যাল জিনিসপত্র দেখছি, এই সময় একজন অল্প-বয়েসি রূপবতী (প্রায়) তরুণী এসে বলল, ‘আপনি কি মিস্টার ইমতিয়াজ? দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।’

আমি অল্প-বয়েসি রূপবতী (প্রায়) তরুণীকে অনুসরণ করে রিসিপশন থেকে মূল অফিসের ভেতরে ঢুকে গেলাম। ছোট্ট অফিস। অল্প জায়গা। সেখানে নানা কায়দায় অনেকগুলো ওয়ার্ক-স্টেশন বসানো আছে। চারপাশের প্রত্যেকটা দেয়াল উজ্জ্বল রঙে রঙ করা। ওয়ার্ক-স্টেশনগুলোর মাঝে বেশ কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে বসে কাজ করছে।

আমাকে একজন হাসিখুশি চেহারার গুল্লুগাল্লু আরেক রূপবতীর সামনে উপস্থিত করানো হলো। সে খুব গাঢ় গলায় আমাকে এক ধরনের অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘আমি আরজে অমুক। আপনি নিশ্চয়ই সেই রাইটার, যার আসার কথা ছিল। কিন্তু আপনি তো ভাইয়া অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আমরা খুব বেশি হলে দশ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাব। আসুন, আপনাকে স্টুডিওতে নিয়ে যাই।’

আমি মিনমিন করে নিম্নলিখিত দুটো বাক্য বলার চেষ্টা করলাম :

‘আমি একটু পানি খাব।’

‘আমি একটু টয়লেটে যাব।’

কিন্তু যেহেতু গুছিয়ে বলতে পারি না এবং মনে মনে যা বলব বলে স্থির করি, বেশিরভাগ সময় তার উল্টো কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, কাজেই আমার মুখ দিয়ে বের হলো, ‘জি আচ্ছা। অবশ্যই। স্যরি, অনেক দেরি করে ফেললাম।’

আরজে অমুক আমাকে স্টুডিওতে নিয়ে বসাল। আমি খুব সাবধানে হাত-পা গুটিয়ে একটা চেয়ার দেখে বসে গেলাম।

স্টুডিওর মেঝেতে নানা রকম ক্যাবল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। এখানে-ওখানে মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড। কখন কোথায় অসতর্কতার কারণে ধাক্কা-ধুক্কা লেগে কী না কী গোলমাল হয়ে যায়, সেই ভয়ে আমি খুব তটস্থ হয়ে নিজেকে যথাসম্ভব গুটিয়ে রাখলাম।

আরজে অমুক কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া। এখানে আপনি আপনার নাম এবং আপনার বইয়ের নামটা লিখে দেবেন প্লিজ।’

আমি দুর্বল গলায় বললাম, ‘শুধু নিজের নামটা লিখি? বইয়ের নামটা থাক। বইটা আসলে খুব বেশি পদের কিছু না। ফালতু ধরনের বই। এটা নিয়ে কথা বললে লোকে হাসাহাসি করবে।’

আরজে অমুক সরু চোখে কিছুক্ষণ আমাকে জরিপ করে বলল, ‘আচ্ছা। আপনি আপনার নামটাই লিখে দেন। কিন্তু বই নিয়ে কথা না বললে, আমরা কী নিয়ে কথা বলব?’

আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘তা তো জানি না। তারচেয়ে আজকে আমি চলে যাই? আলোচনার বিষয় যেহেতু নাই...। তার ওপর, দেরি করে এসেছি। সময়ও তো বেশি পাব না। আরেক দিন আসব।’

‘না না। চলে যাবেন কেন? আশ্চর্য। ...আচ্ছা, আপনি নিজের সম্পর্কে বলেন। আপনি কী কী করেন?’

আমি কী কী করি, সেটা অল্প কথায় গুছিয়ে বলা কঠিন। কোনটা রেখে কোনটা বলব, তা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে কিছু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বললাম, ‘আমি গাড়ি চালাই।’

আরজে অমুক ফিক করে হেসে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, ‘ইন্টারেস্টিং। আর কিছু? কী করতে পছন্দ করেন?’

আমি আবারও কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বললাম, ‘ঘুমাতে পছন্দ করি।’

আরজে অমুক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা। আপনি বরং ভাবতে থাকুন। এখনই নিউজ শুরু হবে। পাঁচ মিনিটের নিউজ। এরপর আমরা আলোচনা শুরু করব। আপনি তাহলে বসুন। কেমন?’

আরজে অমুক বেরিয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন তরুণী আর একজন তরুণ এসে স্টুডিওতে ঢুকে ঝটপট কানে হেডফোন লাগিয়ে কম্পিউটারে কী কী জানি করতে শুরু করল।

এতক্ষণ গান বাজছিল। সেটা থেমে গিয়ে নিউজ বুলেটিনের মিউজিক বেজে উঠল। সেটা শেষ হতে ব্রডকাস্টার তরুণ-তরুণী খবর পড়া শুরু করল।

এর মধ্যে আমি ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম। অনেকক্ষণ ধরেই আমার হাঁচি আসছিল। ব্যাপক সাধনা করে সেটা ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। নিউজ শুরু হওয়া মাত্র সেটা আর নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল না। বিকট শব্দে পরপর ছয়-সাতবার হাঁচি দিয়ে ফেললাম। হাঁচি এমন একটা জিনিস, একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না এবং সেটার ভলিউম ও শব্দতরঙ্গও নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়।

উপর্যুপরি হাঁচি থামার পরে একটু সুস্থির হয়ে দেখি সংবাদ-পাঠক দুই তরুণ-তরুণী প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।

রূপবতী তরুণীটি দুর্নিবার ভর্ৎসনার সুরে আমাকে বলল, ‘আপনি হয় বাইরে গিয়ে বসেন অথবা হাঁচি এলে মুখে রুমাল চাপা দিবেন।’

আমি ঘাড় কাত করে ‘জি আচ্ছা’ বলে হাতে রুমাল নিয়ে রেডি থাকলাম, আবার যদি সত্যি সত্যি হাঁচি আসে, তাহলে সেটা দিয়ে মুখ চাপা দিতে হবে। তবে ভাগ্য ভালো যে নতুন করে আর হাঁচি এলো না। তারপরও নিউজ বুলেটিনের বাকি সময় আমি খুব তটস্থ হয়ে রইলাম, যাতে আর কোনো বিপদ না হয়।

নিউজ বুলেটিন শেষ হওয়ার পরে আরজে অমুক ফিরে এলো। এবার তার সঙ্গে আরেকজন রূপবতী তরুণী। আরজে অমুক হাসিখুশি প্রকৃতির। তার সঙ্গের রূপবতী তরুণীটি অনেক গম্ভীর, রাগী রাগী চেহারা, সে সম্ভবত এই শোয়ের প্রডিউসার। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কী নিয়ে কথা বলবেন, সেটা কিন্তু আমরা জানি না। দয়া করে একটু কো-অপারেট করেন।’

আমি বললাম, ‘আমি আসলে নার্ভাস। কোনোদিন ইন্টারভিউ দেইনি তো...।’

রাগী চেহারার প্রডিউসার কিছুটা নরম হয়ে বলল, ‘আচ্ছা। টেক ইট ইজি। আমরা আসলে আপনার সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। আমাদের বলা হয়েছে, আপনি একজন সাংবাদিক। এবারের বইমেলায় বই বের হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে... আর কোনো তথ্য যদি দেন...।’

‘আপা। আজকে আমাকে ছেড়ে দেন। আমি আসলে কথা বলতে খুব ভয় পাই।’

রাগী চেহারার প্রডিউসার আর আরজে অমুক নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরজে অমুক বলল, ‘আচ্ছা, অসুবিধা নাই। আপনি একদম ঘাবড়াবেন না। আমরা তাহলে আলোচনা শুরু করে দেই।’

রাগী চেহারার প্রডিউসার আমার সামনে একটা মাইক্রোফোন টেনে এনে সেট করে দিল। আমি তার পারফিউমের সুবাস পেলাম। চেহারা রাগী রাগী হলেও তার পারফিউমের ঘ্রাণ অতীব মিষ্টি।

অলংকরণ: সামির

আরজে অমুক গান থামিয়ে দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি তার কথা শুনতে পেলাম, ‘...এই মধ্য দুপুরে এই মিষ্টি গানের সঙ্গে আবারও জানিয়ে দিতে চাই, আপনার শুনছেন এফএম রেডিও এত পয়েন্ট এত...। আর আপনাদের সঙ্গে আছি আমি আরজে অমুক। থাকব ঠিক দুপুর দুটো পর্যন্ত। খুব বেশি আর বাকি নেই দুটো বেজে যেতে।

‘আমরা আরও গান শুনব। গান শুনতে শুনতেই কাটবে সারা বেলা। তবে এখন পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, এমন একজন মানুষের সঙ্গে, যিনি একজন লেখক। তার নাম নওরোজ ইমতিয়াজ। এবারের বইমেলায় তার একটা বই বেরিয়েছে। তবে তিনি সেই বই নিয়ে কথা বলতে একদম ইচ্ছুক নন। তিনি কী কী করেন, সেটা জানতে চাইলে, তিনি একরাশ হাসি দিয়ে বলেন, তিনি গাড়ি চালান। হাহাহা... প্রিয় শ্রোতা, এমন একজনকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, তার হাসিটা খুব সুন্দর। খুব মিষ্টি করে তিনি হাসেন।’

যদিও রেডিওতে দেখা যায় না, আর ফেসবুক লাইভেরও কোনো নমুনা দেখতে পাচ্ছি না, তারপরও আমি মিষ্টি করে সুন্দর একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

আরজে অমুক বলে যাচ্ছেন, ‘এই মিষ্টি হাসির মানুষটার সঙ্গে আমরা কথা বলব। শুনব তার ভাবনা, শুনব তার সব কথা। ...নওরোজ, ধন্যবাদ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্যে। আমরা একটু ভিন্ন বিষয়ে আপনার কাছে কিছু কথা শুনতে চাই। এই যে আজকাল আমরা দেখছি, ছোট ছোট বাচ্চারা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে অদ্ভুত বাংলিশ ভাষায় কথা বলছে। তারা বাংলা ভাষাটাও ঠিকমতো জানে না। আপনি কি মনে করেন না যে এই প্রবণতা রোধ করতে বাবা-মায়েদের এগিয়ে আসা উচিত? সন্তানের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে বাবা-মায়েদেরই অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত?’

আমি দুর্বল গলায় বললাম, ‘এটা কি লাইভ হচ্ছে?’

আরজে অমুক শীতল গলায় বলল, ‘জি। লাইভ হচ্ছে।’

আমি চিঁ-চিঁ করে বললাম, ‘আপনি কি আপনার প্রশ্নটা আবার বলবেন? আমি আসলে শুনি নাই ভালো করে।’

আরজে অমুক এবার চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার ভঙ্গিতে প্রশ্নটা রিপিট করল এবং সঙ্গে যোগ করল, ‘আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুরক্ষা দিতে আমাদের কি এখনই কোনো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার কিনা, আপনি কী মনে করেন।’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁ। তা তো ঠিকই।’

আরজে অমুক কড়া গলায় বলল, ‘আমরা আসলে আপনার ভাবনটা শুনতে চাইছিলাম।’

‘আমার ভাবনা? ইয়ে...আমার তো আসলে এ বিষয়ে কোনো ভাবনা নাই। মানে আগে কখনও ভাবি নাই। আজকে বাসায় গিয়ে ভাবব।’

‘ঠিক এই মুহূর্তে কি আপনি কিছু বলতে চান কিনা...।’

‘না। ...কী আর বলব!’

আরজে অমুক চট করে তার পাশে দাঁড়ানো রাগী রাগী চেহারার প্রডিউসারের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে নিল। আমি পরিষ্কার দেখলাম, তাদের দুজনের চোখে বিরক্তি, হতাশা এবং বিস্ময়।

‘আচ্ছা। আমরা তাহলে অন্য প্রসঙ্গে যাই। এবারের বইমেলায় তো গিয়েছেন...।’

‘জি। গিয়েছি।’

‘বইমেলায় নারীদের সিকিউরিটি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? আপনি কি মনে করেন, বইমেলার সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট ঠিক আছে? বিশেষ করে নারীরা কি নিরাপদ? ছুটির দিনগুলোতে যখন অনেক ভিড় হয়, তখন নানা রকম মানুষ মেলায় আসেন। সেখানে সবাই যে বইপ্রেমী কিংবা বই কিনতে আসেন, তা তো না। সিকিউরিটি প্রবলেম আছে কিনা, আপনি কী মনে করেন?’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আমি আসলে ভাবি নাই বিষয়টা নিয়ে। আসলে যারা এই মেলার আয়োজন করেছে, তারা তাদের সাধ্যমতো যা পেরেছে চেষ্টা করেছে। পরেরবার নিশ্চয়ই আরও ভালো করার চেষ্টা করবে।’

আরজে অমুক বলল, ‘আপনার উত্তর কি একটু দায় এড়ানোর মতো হয়ে গেল না? আপনারা যারা লেখক, তারা যদি এইসব বিষয়ে সোচ্চার না হন, তাহলে কর্তৃপক্ষের টনক কীভাবে নড়বে?’

আমি হতাশ ভঙ্গিতে বললাম, ‘টনক নাড়ানো অনেক কঠিন।’

‘আপনি বাংলিশ চর্চার বিষয়টাও এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু একটা ভাষা এগিয়ে চলে সাহিত্যের ওপর ভর করে। আর আপনারা যারা সাহিত্যিক, তারা বাংলা ভাষাটাকে টিকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করছেন না। আপনি কি মনে করেন না যে ভবিষ্যত প্রজন্ম এ জন্যে আপনাদেরই দায়ী করবে?’

ভবিষ্যত প্রজন্ম কী বলল না বলল, তা নিয়ে সত্যি বলতে কী, আমার আসলে বড় কোনো মাথাব্যথা নেই। তারপরও আরজে অমুকের উসকানি হোক অথবা অদৃশ্য কোনো জাদুর বলে হোক, আমার মধ্যে কীভাবে কীভাবে জানি এক ধরনের অমিত সাহস এসে ভর করল।

আমি বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বলা শুরু করলাম, ‘নতুন প্রজন্ম আমাদের শুধু এই কারণে দায়ী করবে না। দায়ী করার মতো আরও হাজারটা জরুরি ইস্যু রয়েছে। শুধু ভাষা না, যে হারে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও তারা আমাদের অভিযুক্ত করবে। আমরা সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছি, সেই জন্যেও তারা আমাদের দায়ী করবে। আর ভাষা একটা চলমান বিষয়। প্রতিনিয়ত নানা ভাষার শব্দ একটা ভাষায় সংযোজিত হয়। তরুণদের হাত ধরে নতুন নতুন শব্দ আর নতুন নতুন টার্ম সৃষ্টি হয়। আইন করে বা বাধ্যবাধ্যকতা দিয়ে ভাষার পরিবর্তন ঠেকানো যাবে না, ভাষা তার মতো পরিবর্তিত হবেই। বরং বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে যে গবেষক আর জ্ঞানী ব্যক্তিরা কাজ করেন, তাদের সঙ্গে তরুণদের একটা মেলবন্ধন ঘটিয়ে যদি ভাষার বিষয়টা দেখে-শুনে রাখার ব্যবস্থা করা যায়...।’

আমার আরও অনেক কিছু বলার ছিল, তার আগেই আরজে অমুক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ মিস্টার ইমতিয়াজ। আপনার সঙ্গে কথা বলে অনেক ভালো লাগল। ...প্রিয় শ্রোতা, কথা বলছিলাম এমন একজন মানুষের সঙ্গে, যিনি শুধু সুন্দর করে হাসেনই না, তার কাছ থেকে বাংলা ভাষার প্রবাহমানতা নিয়েও আমরা চমৎকার কিছু কথা শুনছিলাম...।’

আমি একটু বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমি আরও কয়েকটা কথা বলতে চাই।’

আরজে অমুক গাঢ় গলায় বলল, ‘নিশ্চয়ই। কিন্তু আজকে তো আর সময় নেই। আমরা অবশ্যই আরেকদিন সময় করে আপনার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেব। সেদিন সব কথা শুনব। ...প্রিয় শ্রোতা... বিদায় নিতে হচ্ছে...।’ ইত্যাদি ইত্যাদি....

আরজে অমুক বিদায়সূচক কথাবার্তা শেষ করে কী একটা গান বাজিয়ে দিয়ে আমার দিকে হাসিমুখে বলল, ‘থ্যাংক ইউ ভাইয়া। অনেক সুন্দর শো হয়েছে।’

স্টুডিও থেকে বের হওয়ার পরে একজন তরুণ এগিয়ে এসে বলল, ‘ভাই আমার সঙ্গে আসেন। তাড়া নাই তো? গল্প-গুজব করি...।’

আমার সত্যি সত্যি অনেক তাড়া ছিল। কিন্তু সেটা তো আর মুখের ওপর বলে দেওয়া যায় না, আমি বিগলিত গলায় বললাম, ‘না না। তাড়া কীসের? এমনিতেই দেরি করে এসেছি।’

তরুণটি আমাকে নিয়ে গল্প-গুজব করার জন্যে প্রথমে একটা বোর্ডরুমের মতো একটা বড় কক্ষে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। সেখানে আগে থেকেই একটা বড় টেবিল ঘিরে বসে কয়েকজন মানুষ কথাবার্তা বলছিল। ফলে তরুণটি সেখানে ঢুকল না। সে একটা বড় দরজা খুলে ব্যালকনিতেও উঁকি দিল। সেখানেও কয়েকজন মানুষ সিগারেট খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। সেখানেও ঢোকা গেল না।

তরুণটি বিব্রত মুখে আমাকে তার নিজের ডেস্কের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে একটা চেয়ার ধরে টানাটানি করতে করতে বলল, ‘ভাইয়া, এখানে বসেন।’

আমি দেখলাম, জায়গাটা বেশি বড় নয়। সত্যি সত্যি সেই চেয়ারে বসতে গেলে উল্টোদিকে দুটো মেয়ে বসে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে ধাক্কা লাগার ঝুঁকি। কাজেই আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘না না। ঠিক আছে। আমার তো আর কোনো দরকার নাই, আমি তাহলে আজকে যাই?’

তরুণটি বলল, ‘একটু বসেন। আপনার জন্যে একটা খাম আছে।’

খাম শুনে আমি মনে মনে একটু আশাবাদী হলাম। সাধারণত এ রকম শোতে অতিথি এলে তাদের কিছু না কিছু সম্মানী দেওয়া হয়। টেলিভিশন টক শোয়ের তুলনায় রেডিওর লাইভ শোয়ের সম্মানী বেশি হয় বলে শুনেছি।

বসার জন্যে জায়গাটা যে একটু ছোট, সেটা তরুণটিও বুঝতে পেরেছে। সে আর চাপাচাপি করল না। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে আর অপেক্ষা করা যায় না। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আজকাল চমৎকার সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোবাইল ফোন। নিজের গুরুত্ব অক্ষুন্ন রেখে দিব্যি মোবাইল টিপতে টিপতে খুব ব্যস্ত মানুষের মতো সময় পার করে দেওয়া যায়।

অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হলো না। একজন তরুণী এসে আমার একটা বড় সাইজের একটা খাম ধরিয়ে দিল, ‘এটা আপনার জন্যে ভাইয়া।’

আমি হাসি হাসি মুখে বললাম, ‘থ্যাংক ইউ। এইবার কি আমি যেতে পারি?’

তরুণী মাথা দোলাল। আমি বেরিয়ে এসে জুতা পরে লিফটে করে নামতে নামতে খাম খুললাম। খামটা যত বড়, ভেতরের জিনিসপত্র তত বেশি না। একটা চাবি রিং আর একটা নোটপ্যাড। নোডপ্যাডের কভারে ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িঅলা একজন মানুষের ছবি। নিচে লেখা : এনাকে অমুক নির্বাচনে অমুক পরিষদে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।

ফ্রেঞ্চকাট ভদ্রলোক মনে হয় এই এফএম রেডিও কোম্পানির মালিক। আমি তার নির্বাচনী তৎপরতার প্রতি শুভকামনা জানিয়ে নিচে নেমে উবার খুঁজতে শুরু করলাম।

১৩৪৯ পঠিত ... ১৮:৩৩, মে ২৩, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top