কিছুদিন হলো আমার জীবনচর্যায় নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। সন্ধ্যা মিলাবার আগেই সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে তিন-চারজন আমার বাসায় উপস্থিত হচ্ছে। আমার মায়ের শোবার ঘরটিতে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এসি ছেড়ে দিচ্ছে। গলা উঁচিয়ে চা-নাশতার কথা বলছে। এই ফাঁকে একজন ক্যাসেট রেকর্ডার রেডি করছে। অন্য একজন ক্যামেরায় ফিল্ম ভরছে। তৃতীয়জন কাগজ-কলম নিয়ে প্রস্তুত। চতুর্থজন ব্যস্ত হয়ে মোবাইলে টেলিফোন করছে ইমদাদুল হক মিলনকে। ঔপন্যাসিক চলে এলেই কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ঔপন্যাসিক আমার ইন্টারভিউ নেবেন।
ইমদাদুল হক মিলনের সমস্যা কী আমি জানি না। ইদানীং সে সবার ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়াচ্ছে। টিভি খুললেই দেখা যায় সে কারোর না কারো ইন্টারভিউ নিচ্ছে। পত্রিকার পাতাতেও দেখছি অনেকেই তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁরাও রক্ষা পাননি। তিন দিন ধরে ক্রমাগত তাঁদের ইন্টারভিউ হলো। আমার দখিন হাওয়ার বাসাতেই হলো।
মিলন জানেও না ইন্টারভিউ নিতে নিতে তার গলার স্বরেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। চোখের দৃষ্টিও অন্য রকম। এখন তার চোখে শুধু প্রশ্ন খেলা করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ফাঁদে পা দিলাম? সন্ধ্যাটা আগে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভালোই কাটত। এখন ক্যাসেট প্লেয়ার মুখের সামনে ধরে মিলন বসে থাকে। সামান্য ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করে...
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘লীলাবতী’ দিয়েই শুরু করছি। এটা পড়ে মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্র হচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান। এই উপন্যাসটির নাম ‘সিদ্দিকুর রহমান’ বা ‘সিদ্দিকুর রহমানের জীবন’ এ রকম হতে পারত। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামে আপনার একটা বই আছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামেই যদি নামকরণ করেন, তাহলে উপন্যাসটির নাম ‘লীলাবতী’ কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো মনে করি যে, ‘লীলাবতী’ উপন্যাসে যে কটি চরিত্র এসেছে, প্রতিটিই প্রধান চরিত্র।
[ভুল উত্তর। উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রধান হতে পারে না। ঔপন্যাসিক মিলন অবশ্যই এটা জানে। কিন্তু সে এমন ভাব করল যেন সে আমার উত্তর গ্রহণ করেছে। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল]
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে ‘লীলাবতী’ নামটি কেন রাখলেন?
[প্রবল ইচ্ছা হলো বলি, আমার ইচ্ছা। তোমার কী?
এই জাতীয় উত্তর দেওয়া যায় না। অনেক পাঠক পড়বে। জ্ঞানগর্ভ কিছু বলা দরকার। জ্ঞানগর্ভ কিছু মাথায় আসছে না। কী করি? উপন্যাসের নাম নিয়ে মিলনের মাথাব্যথার কারণটাও ধরতে পারছি না। আমি বললাম...]
হুমায়ূন আহমেদ : উপন্যাসের নাম হিসেবে ‘লীলাবতী’ নামে যে মাধুর্য আছে ‘সিদ্দিকুর রহমান’ নামে কি সে মাধুর্য আছে?
ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই এটা একটা সুন্দর নাম।
[মিলন মুখে বলল, এটা একটা সুন্দর নাম; কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলো সে আমার কথাবার্তায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো, আচ্ছা, মিলন কি ভাবছে আমি ‘লীলাবতী’ নামটি বাণিজ্যিক কারণে রেখেছি? তাই যদি হয় তাহলে তো নামকরণের ব্যাপারটি ভালোমতো ব্যাখ্যা করা দরকার। বইয়ের ফ্ল্যাপে এই ব্যাখ্যা আছে। আমি পরিষ্কার বলেছি, ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কন্যার নাম ‘লীলাবতী’। এই নামটির প্রতি আমার অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তবে আমি এত ব্যাখ্যায় গেলাম না, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলাম...]
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি যদি মনে করো আমি ‘লীলাবতী’ নামটি দিয়েছি বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনায়, তাহলে ভুল করবে। আমার ভালো লেগেছে, তাই এই নাম দিয়েছি। বইয়ের নামের কারণে কিছু বই বেশি বিক্রি হবে, এটা নিয়ে আমার প্রকাশক মাথা ঘামাতে পারে। আমি ঘামাই না।
[আমার কঠিন কথায় মিলন একটু থমকে গেল এবং অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল...]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। আপনি ‘মন্দ্রসপ্তক’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই শব্দটির অর্থও অনেকে জানেন না। আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটক লিখেছিলেন 'অয়োময়'। এই শব্দের সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালি পরিচিত নন। আপনার লেখার ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। ওইভাবে আমি ভাবিনি।
হুমায়ূন আহমেদ : তার পরও কিন্তু ফ্যাক্টর থাকে, মিলন। আমি দেখেছি। অন্যপ্রকাশ আমার দুটি বই ‘বাসর’ ও ‘সৌরভ’ প্রকাশ করেছে। তুমি দেখবে, ‘বাসর’-এর বিক্রি হয়েছে অনেক বেশি। ‘বাসর’ নামটি হয়তো মানুষকে আকর্ষণ করেছে অনেক বেশি, দেখি তো কী আছে বইটিতে। ‘সৌরভ’ কিন্তু ততটা আকর্ষণ করেনি। ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম যদি ‘বাসর’ দিতাম এবং ‘বাসর’ উপন্যাসটির নাম ‘সৌরভ’ দিতাম তাহলেও একই ঘটনা ঘটত।
ইমদাদুল হক মিলন : (বিজয়ীর ভঙ্গিতে) তাহলে তো আপনি স্বীকারই করলেন যে, নামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ স্বীকার করলাম। তবে বইয়ের নাম দেওয়ার সময় বাণিজ্যিক ব্যাপারটা আমার মাথায় কখনো থাকে না। যদি থাকত তাহলে ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম দিতাম ‘গোপন বাসর’। হা হা হা।
[বুদ্ধিমান পাঠক সম্প্রদায়, আপনারা কি লক্ষ্য করছেন, মিলন আমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল যে নামের একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে। এখন আমার কি উচিত না আরো সাবধানে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া? কে জানে সে হয়তো এমন অনেক কিছু আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবে, যা আমার মনের কথা না। কাজেই Attention, সাবধান। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান। মিলন গভীর জলের পাঙ্গাশ মাছ। আমার মতো অল্প পানির ‘তেলাপিয়া’ না।]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন। অবিস্মরণীয় কিছু ভূতের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বৃহন্নলা, দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন_এই যে লেখাগুলো, এগুলোর মধ্যে আপনি আধিভৌতিক এবং রহস্যময়তার ব্যাপারগুলো সব সময়ই এনেছেন। পাশাপাশি আপনি আবার বললেন যে, বিজ্ঞানের ছাত্রদের এই বিষয়ে বিশ্বাস থাকা ঠিক না। আপনি যখন এই লেখাগুলো লেখেন, তখন কি বিজ্ঞানের ব্যাপারটি মাথায় রেখে লিখেছিলেন?
[মিলন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছি। সে আবারও আমাকে দিয়ে স্বীকার করাবে যে আমি নিজেকে ‘কনট্রাডিক্ট’ করছি। একই সঙ্গে বিজ্ঞানের কথা বলছি আবার ভূত-প্রেতের কথা বলছি। অতি সাবধানে এখন উত্তর দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া।]
হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান তো থাকবেই। কিন্তু সব ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে পারছে? মহাবিশ্বের শুরু হলো বিগ ব্যাং (Big Bang) থেকে। তার আগে কী ছিল?
[মিলন ভুলবার মানুষ না। সে এই বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল। আমাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলতে চাচ্ছে…]
ইমদাদুল হক মিলন : বিভিন্ন সময়ে অনেক আড্ডায় আপনি প্রচুর ভৌতিক গল্প বলেন। আপনাকে আমরা যত দূর জানি, আপনি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, অযৌক্তিক কোনো কিছুকে আপনার প্রশ্রয় দেওয়ার কথা না। তাহলে…?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার চরিত্রের একটি অংশ হিমু, আরেক অংশ মিসির আলী। হিমু তো যুক্তিহীন জগতের মানুষ।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার কথা শুনে মনে হয়, আপনার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করে।
হুমায়ূন আহমেদ : শুধু আমার মধ্যে কেন, সবার মধ্যেই বাস করে। মিলন! তোমার মধ্যে কি বাস করে না? ‘A man has many faces’. শুধু জন্তুর একটাই ‘Face’ থাকে। মানুষ জন্তু না।
[মোটামুটি ‘জ্ঞানগর্ভ’ উত্তর দেওয়া হলো। আমি খুশি। মিলনকে তেমন খুশি মনে হচ্ছে না।]
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি, মানুষ হিসেবে আপনি নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন এবং নিজেকে কোন স্তরের মনে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি খুবই উঁচু স্তরের। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি খুবই নিম্নস্তরের একজন মানুষ।
ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে এমন মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : কখনো কখনো আমি এমন সব কাজ করি যে মনটা খুবই খারাপ হয়, তখন মনে হয় এই কাজটা কিভাবে করলাম? কেন করলাম?
ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি রিসেন্ট কোনো ঘটনায় আপনার মনে হয়েছে! আপনার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় বা…
[ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় যদি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবস্থা থাকত তাহলে এ পর্যায়ে ব্যং করে একটা শব্দ হতো এবং টেনশন মিউজিক শুরু হতো।]
ইমদাদুল হক মিলন : প্রশ্নের জবাব দিতে না চাইলে দিতে হবে না।
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছি, তখন তোমার সব প্রশ্নেরই উত্তর দেব। মানুষ হিসেবে আমি কখনো নিজেকে অতি উচ্চস্তরের ভাবি আবার কখনো নিম্নস্তরের ভাবি অনেক আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বহু দিন ধরে টিভিতে, পত্র-পত্রিকায়, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী? আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান? আপনি বলছেন সব কিছু পরিষ্কার বলতে চান, কিন্তু আপনি তো বলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ : শোনো, এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালেখি জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে বেশির ভাগ সময়। তা ছাড়া হয়েছে কী, মানুষ তো গাছের মতো। গাছ কী করে? শিকড় বসায়। প্রতিটি মানুষেরই শিকড় আছে। আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত যে শিকড় আছে, সেগুলো ছিঁড়ে গেছে। আমি ফর ফাইভ ইয়ারস বাইরে বাইরে ঘুরেছি। কখনো মায়ের কাছে থেকেছি, কখনো হোটেলে থেকেছি, কখনো উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া করে থেকেছি, কখনো বন্ধুর বাসায় থেকেছি, দখিন হাওয়ায় থেকেছি। যখন দখিন হাওয়ায় থাকতে শুরু করলাম তখনো সমস্যা। সপ্তাহের তিন দিন থাকি দখিন হাওয়ায়, চার দিন থাকি গাজীপুরে। প্রায়ই রাতে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, আমি এখন কোথায়? ঢাকায় না গাজীপুরে? একজন মানুষের শিকড় যখন ছিঁড়ে যায়, তখন তাকে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এই অস্থিরতার জন্যই বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, নিজের মতো থাকি। ঘরে বসে থাকি, ছবি দেখি, গান শুনি। আমি এই বয়সে এসে এ রকম একটা সময় পার করছি। গর্তজীবী হওয়ার পেছনে এটাও হয়তো কারণ।
এখন নতুন শিকড় গজাচ্ছে। অস্থিরতা কমে আসছে। গর্ত থেকে বেরোতে শুরু করেছি। তোমাকে দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে যে রাজি হলাম এটা কি তা প্রমাণ করে না?
ইমদাদুল হক মিলন : আপনাকে অনেকে রুক্ষ মানুষ মনে করে, ভয় পায়। কিন্তু আপনার লেখা যারা পড়েছে তারা জানে যে, আপনি অসম্ভব মমতাবান একজন মানুষ। মানুষকে আপনি পছন্দ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ : লেখা পড়ে তো একজন মানুষকে বিচার করা যায় না।
ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই করা যায়। কেন যাবে না? একজনের লেখা পড়ে আমরা কি বুঝতে পারব না, সে কোন ধরনের মানুষ এবং এটা আপনার তো বিশ্বাস করার কথা। একজন লেখক জীবনের নানা রকম কথা তাঁর লেখার বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে বলেন।
হুমায়ূন আহমেদ : হেমিংওয়ের লেখা পড়ে আমরা কখনোই বুঝতে পারি না যে, হেমিংওয়ে নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারেন। তিনি অসম্ভব জীবনবাদী একজন লেখক। তাঁর লেখা পড়ে যদি তাঁকে আমরা বিচার করতে যাই, তাহলে কিন্তু আমরা একটা ধাক্কা খাব। মায়কোভস্কি পড়ে কখনোই বুঝতে পারব না যে, মায়কোভস্কি আত্মহত্যা করার মানুষ। আমরা কাওয়াবাতা পড়ে কখনো বুঝতে পারব না যে, কাওয়াবাতা হারিকিরি করে নিজেকে মেরে ফেলবেন। এঁরা প্রত্যেকেই জীবনবাদী লেখক। জীবনবাদী লেখকদের পরিণতি দেখা গেল ভয়ংকর। তার মানে কী? তার মানে কী দাঁড়ায়? লেখকরা কি সত্যি সত্যি তাঁদের লেখায় নিজেকে প্রতিফলিত করেন? নাকি তাঁদের শুদ্ধ কল্পনাকে প্রতিফলিত করেন?
ইমদাদুল হক মিলন : ঘুরে ফিরে ‘লীলাবতী’র প্রসঙ্গটায় আবার আসি। আপনার এ লেখাটা এমন আচ্ছন্ন করেছে আমাকে, এর আগে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়ে এমন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। লীলাবতীতে মাসুদ নামের একটি ছেলে গোপনে এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে, পরীবানু যার নাম, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। সে চরিত্রটা আবার আত্মহত্যা করল। আপনি মানুষকে এত নির্মমভাবে মেরে ফেলেন কেন আপনার লেখায়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমাদের জগৎটা কিন্তু খুব নির্মম। এ জগতে মানুষ যখন মরে যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে মরে যায়। সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু নির্মম। এই যে সুনামিতে দেড় লক্ষ দুই লক্ষ লোক মারা গেল, তিনি নির্মম বলেই তো এত লোক মারা গেল। এই নির্মমতাটা কিন্তু আমাদের মধ্যেও আছে। কথা নেই বার্তা নেই একজন গলায় দড়ি দিচ্ছে, হঠাৎ করে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে নিচ্ছে। যে ঘুমের বড়িটা খাচ্ছে, সে কিন্তু খুব আয়োজন করে খাচ্ছে তা না। মনে হলো খেয়ে নিল। জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে, ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ/…বধূ শুয়ে ছিল পাশে_শিশুটিও ছিল/প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জ্যোৎস্নায়, তবু সে দেখিল কোন ভূত/ ঘুম ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি তো ঘুম বহুকাল/ লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি/ রক্তফেনা-মাখা মুখে/ মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি/ আঁধার গুজির বুকে ঘুমায় এবার;/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ জাগিবার গাঢ় বেদনার/ অবিরাম অবিরাম ভার/ সহিবে না আর।’ [এই পর্যায়ে আমি জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতার প্রায় সবটাই চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করলাম। কারণ? আশপাশে সবাইকে জানান দেওয়া যে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবিতা মুখস্থ বলতে পারি। মিলনকে সামান্য ভড়কে দেওয়ার ইচ্ছাও যে ছিল না, তা না।]
ইমদাদুল হক মিলন : এই ‘লীলাবতী’ উপন্যাসটা আপনি জীবনানন্দকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গের ভাষাটা হচ্ছে এ রকম, তিনি জীবিত, আপনি কবির উদ্দেশে বলছেন- কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাইনি। আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি। হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেওয়া হয়নি।
হুমায়ূন আহমেদ : জীবনানন্দ দাশের কবিতা যখন পড়ি, তখন মনে হয় কবি যেন পাশেই আছেন। আমি যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর কবিতাটি পাঠ করছি তিনি সেটা শুনতে পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও আমার এই ব্যাপারটি ঘটে। যখন রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ি, তখন মনে হয়, তিনি বুঝি আশপাশেই আছেন। অল্প কিছুদিন আগে বিভূতিভূষণের ‘কিন্নরদল’ গল্পটি পড়ছিলাম…
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, এটা আপনার খুব প্রিয় একটা গল্প…
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন গল্পটি পড়ছি, তখন আমার মনে হলো, তিনি আমার পাশেই আছেন। গল্পটি পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি এবং সেই আনন্দটা তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমার ছেলেমানুষি হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আমার প্রায়ই হয়। যেকোনো ভালো লেখা পড়ার সময়ই আমার মনে হয় লেখক আমার পাশে আছেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, ধরেন আপনি লিখছেন, কিন্তু এর পরে কোন লাইনটা লিখবেন আপনি জানেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখক আছেন, যাঁরা প্রতিটি লাইন খুবই চিন্তাভাবনা করে লেখেন। আবার একধরনের লেখক আছেন, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। মাথায় যেটা আসবে সেটা লিখবে। আমার লেখার ওপর খুব একটা কন্ট্রোল আছে তা না, কন্ট্রোল আছে হালকা, আমার মনে হয় যে আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা বেশি কাজ করে। কিন্তু আমি যখন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখেছি তখন কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখব আমি জানি। আমি যখন মিসির আলী লিখি তখন কিন্তু আমি জানি এই লাইনটার পরে আমি কোন লাইন লিখব। সায়েন্স ফিকশন লেখার সময় আমি জানি কোন লাইনটা লিখব। ওই বাকি লেখাগুলোর সময় আমার আর কন্ট্রোল থাকে না।
ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’ লেখার সময় জানতেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না।
ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’র একটা ছোট চরিত্রের কথা বলি, চঞ্চলী, সে রমিলার বোন। রমিলা মাঝে মাঝে বলে আমি পানিতে ডুবে গেলাম। আমার বোন আমার জন্য ঝাঁপ দিল, আমি উঠে গেলাম কিন্তু সে আর উঠল না। সে এখন সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। মাগো, এই জন্য আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব না। এই যে চরিত্রটা, আপনি জেনেই লিখেছেন নাকি হঠাৎ?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ হঠাৎ…হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে, আবার হঠাৎ করেই চলে গেছে। চলে গেছে যখন এটা নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাইনি। যেমন দীঘির জলে একটা মাছের লেজ ভেসে উঠল। জলে ঘাই দিয়ে তলিয়ে গেল।
ইমদাদুল হক মিলন : এটি ১৩৫৭ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, এখানে আনিস চরিত্রটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে?
[বুঝতে পারছি মিলন এখন প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, আনিস চরিত্রটি যৌক্তিক না। আমাকে এই মুহূর্তে কঠিন অবস্থানে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।]
হুমায়ূন আহমেদ : (কঠিন গলা) মিলন যথেষ্ট হয়েছে। রেকর্ডার বন্ধ কর। চা খাও। আজকের মতো এখানেই ইতি।
[মিলন রেকর্ডার বন্ধ করল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অনেক দিন আগের একটি স্মৃতি আমার মনে পড়ল। তখন শ্যামলীর এক ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমার হয়েছে ভয়াবহ জন্ডিস। মিলন প্রচুর ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। তার মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে আমার বিছানার পাশে বসল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। মুখে কিছুই বলল না। এভাবে সে বসে থাকল দীর্ঘ সময়। ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা লেখকদের চেয়ে ভালো কেউ জানেন না। কিন্তু গভীর আবেগের সময় যে তারা কিছুই বলেন না- এই তথ্য কি সবাই জানে?
অনেক বছর আগে আমার হাত চেপে ধরে মিলন যে আবেগ প্রকাশ করেছিল, আজও সে তাই করল। হাত সে ধরে আছে ধরেই আছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি এত ভাগ্যবান কেন? মানুষের এত ভালোবাসা কেন আমার জন্য? আমার ঘরভর্তি চাঁদের আলো। এই আলো আমি কোথায় রাখব?]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন