গ্রন্থের নাম: হ্যারি পটার সমগ্র
লেখক: পৃথ্বীরাজ সেন
প্রকাশনা: কামিনী
দাম: অমূল্য
বাড়ি ফিরে বইটা যখন বের করলাম তাক থেকে, মা বলল, 'এ বইয়ের জন্যে কী কাণ্ড করেছিলি মনে আছে?'
তা আবার না মনে থাকে? দারুণ ঝড়বৃষ্টি, ঘনঘন বাজ পড়ছে, লোডশেডিং; আর আমি ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেয় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত গড়াগড়ি দিয়ে চলেছি; সঙ্গে চিলচিৎকার। আমায় কিনে দিতেই হবে ওই বইটা। এবং এখনই কিনে দিতে হবে। নইলে মেঝেয় হারিকেন ফেলে দেব, খাটের উপর জলের গ্লাস উল্টে দেব, গামছা পরে স্কুল চলে যাব– আরও কত কী। তাও দিল না কিনে। পরদিন আবার এক কাণ্ড। আবারও বিফল। পরপর পাঁচদিন চলল এই তাণ্ডবের পুনরাভিনয়। অবশেষে আমার অধ্যবসায়ে মুগ্ধ হয়ে মা রণে ভঙ্গ দিল। বইটি পেলুম আমি।
মলাট উল্টে দেখলুম, প্রথম পাতায় দেবাক্ষরে অজস্র হিজিবিজি লেখা। সেই লেখা থেকে যা যা তথ্য আবিষ্কৃত হল, তা এরকম– এক, বইটা কেনা দুই হাজার সাত সালে। দুই, বইয়ের ভেতর লেখা আছে ‘জন্মদিনের উপহার’, যদিও আমি নিশ্চিত ওটা জোর করে লিখিয়েছিলাম। তিন, তখন বইপত্র পড়া শেষ হলে আমি নম্বর দিতাম, দশের মধ্যে কত পেল বইটি- এই বইয়ে ওসব দেওয়া নেই। অর্থাৎ এ বই নম্বর-টম্বরের ঊর্ধ্বে।
পৃথ্বীরাজ সেন অনেক বিদেশি সাহিত্যিকের লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছেন, যথা: আগাথা ক্রিস্টি, আর্থার কনান ডয়েল, মঁপাসা, ও' হেনরি প্রমুখ; এবং সবকটা বই এখনও বাজারে সুলভ। আমার ব্যক্তিগত বিচারে, যাঁর লেখার অনুবাদ করলে পৃথ্বীরাজ সেনের অনুবাদক্ষমতা যথার্থ স্বীকৃতি পেত তিনি হলেন বিষ্ণু দে। বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। এইসব মহান কবিদের বাংলা(?) কবিতা বাংলায় অনুবাদ করার মতো অবশ্যকর্তব্য ছেড়ে উনি কেন যে খামোখা হ্যারি পটারে হাত দিলেন খোদায় মালুম। অনেকে কমলকুমারকে বাংলা ভাষার দুর্বোধ্যতম লেখক বলে থাকেন, তাঁদের উচিত এই বইটি একবার পড়ে দেখা। মানে পড়ার ‘চেষ্টা করে দেখা’। এই বই পড়া অসম্ভব। দু-হাজার সাত থেকে আজ দু-হাজার উনিশ– বারো বছর কেটে গেল, তাও বইটার দুর্বোধ্যতা এক ফোঁটা কমেনি আমার কাছে।
কেউ কেউ খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, আলোচনার একদম শুরুতে আমি পৃথ্বীরাজ সেনকে অনুবাদক না বলে সরাসরি লেখক বলেছি। এই কারণেই বলেছি, এই তথাকথিত অনুবাদ বইটির ন্যূনতম ষাট শতাংশ আসলে মৌলিক রচনা। ষাট শতাংশ বলতে, বইয়ে রয়েছে পাঁচটি কাহিনী– তার মধ্যে প্রথম দুটোর সঙ্গে জনৈকা জে কে রাউলিং লিখিত হ্যারি পটারের প্রথম দুই কাহিনীর সামান্য হলেও মিল পাওয়া যায়, বাকি তিনটিকে প্রায় নিজস্ব রচনা বলা চলে। অনুবাদ এভাবে যখন একটি স্বতন্ত্র ন্যারেটিভের জন্ম দিচ্ছে, এবং এতখানি স্বতন্ত্র – যাতে কিনা আসল লেখাকে চেনারই উপায় থাকছে না– তখন সেটাকে আর অনুবাদ বলা যায় না। ও প্রায় মৌলিক সৃষ্টিই হয়ে দাঁড়ায়। যিনি ‘অনুবাদ’ করেছেন, তিনি হয়ে ওঠেন লেখক।
যে পাঁচটি কাহিনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই বইয়ে, তাদের নামগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক–
ক. পরশ পাথরের সন্ধানে (ধরে নিতে হবে এটি ‘ফিলজফারস স্টোন’ এর 'অনুবাদ'!)
খ. রহস্যের গোপন মহল (ধরে নিতে হবে এটি ‘চেম্বার অফ সিক্রেটস’ এর 'অনুবাদ'!)
গ. অন্ধ কারার বন্দী (ধরে নিতে হবে এটি ‘প্রিজনার অফ আজকাবান’ এর 'অনুবাদ'!)
ঘ. সর্বনাশের সঙ্কেত (ধরে নিতে হবে এটি ‘গবলেট অফ ফায়ার’ এর 'অনুবাদ'!)
ঙ. আগুন পাখির আর্তনাদ (ধরে নিতে হবে এটি ‘অর্ডার অফ দ্যা ফিনিক্স’ এর 'অনুবাদ'!)
আলোচনার পরবর্তী অংশে বইটির মৌলিকত্বের কিছু নমুনা দিতে চলেছি-
১. ‘আগুন পাখির আর্তনাদ’ থেকে
'হো হো করে হেসে উঠেছেন ভলডেমর্ট। বলছেন তিনি, (ডাম্বেলডোরকে) তুমি কি মৃত্যুর উপত্যকায় পা রাখতে চাইছো? এসো, তোমাকে আমি একটা গোপন অভিশাপ দিচ্ছি।'
‘এসো, তোমাকে আমি একটা গোপন অভিশাপ দিচ্ছি’ এই ধরনের মরমি ও শৈল্পিক বাক্য আমি বাংলা তো দূরে থাক, বিশ্বসাহিত্যের কোনও গ্রন্থে আজ পর্যন্ত পড়িনি। এই লাইনটি পড়েছি সেই গতকাল বিকেলে (পয়লা ডিসেম্বর), বিস্ময়ের রেশ কাটেনি এখনও। আজ সকালে রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠলাম। আসল বাক্যটা কি এরকমই ছিল? ‘সিক্রেট কার্স’ বা ওই জাতীয় কিছু? ইংরেজি বইখানা বের করে খুঁজলাম প্রচুর– কিছুই পেলাম না, এবং এটি অনুবাদকের (লেখকের) নিজস্ব সৃষ্টি জেনে এক নির্মল প্রশান্তি অনুভব করলাম।
(মাননীয় সুয়াভো টেক্কা মুখার্জ্জীর সংযোজন– 'এই মৃত্যু উপত্যকা কি ডাম্বেলডোরের দেশ? এইটা না জানিয়েই উনি মারা গেলেন। আমরা হতাশ'।)
শুধু এই একটি উক্তিই না, ছত্রে ছত্রে রোমহর্ষণ ছড়িয়ে রেখেছেন লেখক। যথা, ওই একই পাতায়, এই কথোপকথনের এক ইঞ্চি পরেই-
'ভলডেমর্টকে আবার দেখা গেল। প্রবল বিক্রমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।'
ঝাঁপিয়ে পড়ে কী করলেন ?
'শূন্য থেকে কি যেন নিয়ে এসেছেন। জলের গ্লাস কি? তা ছিটিয়ে দিচ্ছেন চারপাশে।'
ভলডেমর্ট প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের গ্লাস এনে জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন– কোনও সচেতন ব্যক্তি এই ব্যাপারটিকে অনুবাদ বলতে পারেন না। শান্তিজল ছেটানোর এক নিখুঁত দৃশ্যকল্প। এ সৃষ্টি মৌলিক না হয়ে যায় না।
এরপরেও কাহিনীর মৌলিকত্ব নিয়ে কারুর সামান্যতম সন্দেহ থেকে থাকলে, তা দূর করার জন্য রইল–
'বেলাট্রিক্স বলে ওঠে– প্রভু আপনার খেলা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, ভলডেমর্ট এবার বোধহয় উড়তে শুরু করেছেন।'
আশা করি এতেই যথেষ্ট হবে।
২. আবারও ‘আগুন পাখির আর্তনাদ’ থেকে
'লুসিয়াস ম্যালফয় হাসতে থাকে। এতক্ষণে সে একটা জবর শিকারকে জব্দ করতে পেরেছে।
সে বলতে থাকে– ...পটার এখনো কথা বলো। মাথা গরম করো না। তোমার যা কিছু সম্পত্তি আমাকে দিয়ে দাও। তা না হলে এ যাত্রা তুমি মুক্তি পাবে না।'
গোটা ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল যেন। নয়ের দশকের অজস্র বাংলা সিনেমায় দেখেছি এই দৃশ্য। সম্পত্তিলোভী ভিলেন বাড়ির মালিককে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে হুবহু এই কথাগুলি বলত। আমরা আশা করব, হ্যারি এই অবস্থা থেকে শীঘ্রই মুক্তি পেয়ে লুসিয়াস ম্যালফয়ের নামে একটি দেওয়ানী মামলা করবে এবং ন্যায়বিচার পাবে। সম্পত্তি হাতানোর চেষ্টার দায়ে লুসিয়াস ম্যালফয়কে পাঠানো হবে আজকাবানে।
(সুয়াভো মুখুজ্জের সংযোজন: 'গল্পটি আমূল বদলে কৃষ্ণকান্তের উইল বানিয়ে ফেলা হয়েছে দেখছি।')
৩. ‘পরশ পাথরের সন্ধানে’ থেকে
'হ্যাগরিড একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেছিল লিকি কলড্রন– বিখ্যাত জায়গা। এটা ছোটো বটতলা ধরনের লেখকদের প্রকাশন কেন্দ্র।'
এটা আমি না দেখলে তাও বিশ্বাস করতাম, দেখার পর আর কিছুতেই বিশ্বাস হল না। বটতলা নাকি! গৌতম ভদ্র জানেন এ ব্যাপারে?
৪. কোন লেখা থেকে বলবো না
'ওঃ যদি না ভাব আমি সুন্দর
কিন্তু শুধু চোখে দেখে কোরো না বিচার।
আমি নিজেই যাব। যদি তোমরা দেখ
কোন ভদ্র টুপি আমার চেয়ে
তোমরা রাখতে পার তোমাদের।
পশমী টুপি কালো।
তোমাদের সম্মানে টুপি নরম মসৃণ চকচকে
এবং লম্বা।
কেন না আমি হগওয়ার্টসের বাছাই করা টুপি
এবং আমি সকলকেই টুপি পরাতে পারি।'
ইত্যাদি।
চাইলে বইটার প্রতিটি পাতাই উদ্ধৃত করে দেওয়া যায়; কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় ‘স্ট্রিম অফ কনসাশনেস’-এর এত বাড়াবাড়ি, অনেকের বুঝতে অসুবিধা হবে কোথা থেকে কী হয়ে গেল। পৃথ্বীরাজ সেন এই একটি ব্যাপারে যা দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন; আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জেমস জয়েস পর্যন্ত ঈর্ষায় নীল হয়ে উঠতেন।
ছোটবেলার একটি ঘটনা মনে পড়ে। সদ্য হ্যারি পটারের পঞ্চম সিনেমাটি রিলিজ করেছে। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে আনন্দবাজার লাগিয়ে দিয়েছে তুমুল হইচই। হ্যারি পটার এই বঙ্গে বরাবর ‘ছোটদের বই’ বলেই পরিচিত, আর ওই ছোটদের সিনেমায় কিনা হ্যারি চুমু খেয়ে নিল! কী অন্যায়! সঙ্গে সঙ্গে যা হয়, আনন্দবাজারে একাধিক আর্টিকেল বেরিয়ে গেল চুমু নিয়ে। ওরকমই একটা আর্টিকেলের হেডিং ছিল, মনে পড়ে- ‘নিষ্প্রাণ চুমু’, তা আবার ছবিসহ। সেসব দেখে আমার অবস্থা তো, যাকে বলে খুবই হাউমাউ। ওই মহান অনুবাদগ্রন্থটি তাকে তুলে দিয়েছিলাম অনেক আগে (পড়ার চেষ্টায় বিফল হয়ে, বলাই বাহুল্য)। বাধ্য হয়ে নামাতে হল আবার। তারপর পাতা ধরে ধরে স্ক্যান শুরু। সিনেমা অনুযায়ী চুমু থাকার কথা ফিফথ পার্টে, কিন্তু বইয়ের যা অপার্থিব অনুবাদ, ঘটনাটা যে কোনও জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। ফলে একটি পাতাও বাদ দেওয়া যায় না। চুমু খেয়েছে হ্যারি ও চো চ্যাং। আমি গোটা বইয়ে 'চো' বা 'চুমু'– কোনও একটি শব্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব। বিস্তর সন্ধান করার পরেও উৎসাহব্যঞ্জক কিছু পেলুম না। প্রবল হতাশায় বইটা প্রায় বন্ধ করেই দেব, এমন সময় দেখি একটা প্যারাগ্রাফে হ্যারি আর চো হেঁটে বেড়াচ্ছে। সোৎসাহে পড়া শুরু করলুম। কিন্তু তারপর যা দেখলুম সে এক আতঙ্কের স্মৃতি।
হ্যারি আর চো হাঁটছে। পরের লাইনে হ্যাগ্রিডের ঘর পুড়ে গেল। তার পরের লাইনে ডাম্বেলডোর না কে যেন উড়ে চলে গেলেন। তারপর হ্যাগ্রিড কাঁদল। ঘরের আগুন নিভে গেল। কোত্থেকে যেন রন দৌড়ে পালাল। তারপর হ্যারি একাই হাঁটছে। হ্যাগ্রিড হাসছেন।
কী ভয়াবহ ব্যাপার!
আমার বইটার উপর এত রাগ হল আর বলার নয়। ওটাকে ত্যাজ্যবই করে সেই যে আবার তাকে তুলে দিলুম; এই গত পরশু আবার নামল। প্রায় এগারো বছর পর।
আমাদের আলোচনা প্রায় শেষের দিকে। কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বই সম্পর্কে কী বলেছেন একটু দেখে নিই –
'অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। অর্থহীন বাক্যসমষ্টির এই মাপের কালেকশন আর কোনও ভাষায় নেই।'
- ব্রজদুলাল সমাজপতি (বিখ্যাত ইতিহাসবিদ)
'গুগল ট্র্যান্সলেটের অ্যালগরিদম এই বইয়ের উপর ভিত্তি করেই বানানো।'
- হরিমোহন ন্যায়-তর্কবাগীশ (বিখ্যাত সূর্যগবেষক)
‘একটু সময় নিয়ে পড়লেই বুঝে যাবো– বাংলা গল্পের বই যদি ধরা হয়, তাহলে এক কমলকুমার ছাড়া একমাত্র এই বইটি সম্পর্কেই আমায় এ কথা ভাবতে হয়েছে।'
- বিশ্বেশ্বর পালিত (বিখ্যাত কবি ও ডাইনোসরবিদ)
'এ এক অদ্ভুত অনুবাদ, যা পড়তে গেলে পাশে অরিজিনাল বই নিয়ে বসতে হয়।'
- দুলালচন্দ্র ভড় (অধ্যাপক)
এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সুয়াভো টেক্কা মুখুজ্জের কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। আরও জানিয়ে রাখি, এই বইয়ের সূত্র ধরে আমরা পৃথ্বীরাজ সেন সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। একটি চমৎকার তথ্যসূত্র থেকে জানতে পারি, উনি মৌলিক ও অনুদিত গ্রন্থ মিলিয়ে মোট এগারোশো গ্রন্থের রচয়িতা (হ্যারি পটার বইটিকে মৌলিক গ্রন্থ হিসেবেই ধরা হয়েছে আশা রাখছি।), বিশ্বের সর্বাধিক গ্রন্থের লেখকের স্বীকৃতির জন্য তাঁর নাম পাঠানো হয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন থেকে পেয়েছেন একটি সোনার কলম ও বইমেলা থেকে তিনবার গোল্ডেন ডিস্ক।
এই গোল্ডেন ডিস্ক ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে প্রথমে একটু সমস্যা হচ্ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, গোল্ডেন ডিস্ক গানের ক্যাসেটকে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেই মনে হল, ওঁর অনুবাদগুলিকে গান বলে ধরে নেওয়াটা খুব অস্বাভাবিক না। বিশেষ করে ডাম্বেলডোর-ভলডেমর্ট ডুয়েলের যা বিবরণ দিয়েছেন উনি- ওতে খুব সহজেই সুর লাগিয়ে একটি অসামান্য ভক্তিগীতি বানিয়ে ফেলা যায়। তাই যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই উনি গোল্ডেন ডিস্ক পেয়েছেন বলা চলে।
এই সুযোগে দিন কুড়ি আগের একটি ঘটনা উল্লেখ করি। তখন আমি হোস্টেলে। সেমিস্টার শেষ হব-হব করছে। এক সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছি; চারদিকে গাছগাছালির শোভা, ঘাসে টুপটাপ শিশির পড়ছে, পাখি-টাখি ডাকছে ক্যাওঁম্যাওঁ করে, দলে দলে লোকজন মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। এমন ব্রাহ্মমুহূর্তে হঠাৎ করে আমার মনে উদয় হল এই বইটির কথা। সঙ্গে সঙ্গে না জানি কী হয়ে গেল, এর ব্যাখ্যা হয় না, আমি মাটিতে প্রায় শুয়ে পড়লাম হাসতে হাসতে। একেই চুল কাটিনি বহুদিন, একগোছা চুল সর্বক্ষণ সামনের দিকে ঝুলে রিং সিনেমার সেই ভূতটার মতো লাগে, তার উপর অমন হাসি– লোকে যেরকম চোখ করে তাকাচ্ছিল সে কহতব্য না। আমি আর ঝামেলা না বাড়িয়ে ঘরে ফিরে আসি। তারপর ভাবি, বারো বছর আগে যে বইয়ের জন্য কেঁদে গড়াগড়ি দিয়েছি, আজ সেই একই বইয়ের কারণে আমার হেসে গড়াগড়ি দেওয়ার জোগাড়। আমার মধ্যে আবেগের এই বিপুল পরিবর্তন আনল যে বইটি– তা যদি ক্লাসিক না হয়, তবে ক্লাসিক কী?
উপসংহারে, এই বই থেকে আমি যা সিদ্ধান্তে এলাম তা সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি। সুনীল গাঙ্গুলি, সমরেশ মজুমদার থেকে শুরু করে যে সমস্ত বাংলা সাহিত্যিক একসময় নিয়ম করে হ্যারি পটারকে গাল পাড়তেন, তাঁরা খুব সম্ভবত এই বইটি পড়েই হ্যারি পটারের মূল্যায়নে নেমেছিলেন। এক কমলকুমারই সুনীলকে যথেষ্ট তিতিবিরক্ত করে তুলেছিল, তারপর আর এই বইটা ওঁর পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে না, এ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এটি নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত ধারণা, যদিও বিখ্যাত কবি তথা ডাইনোসরবিদ বিশ্বেশ্বর পালিত আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রকাশের এতকাল পরেও বইটি তার উপযুক্ত সম্মান পায়নি। পর্যাপ্ত আলোচনার অভাবে এই ক্লাসিক গ্রন্থটি তলিয়ে যেতে চলেছে বিস্মৃতির অতলে। তাই আপনাদের সকলকে অনুরোধ, বইটি পড়ুন (পড়ার চেষ্টা করুন)। জীবনের নতুন মানে খুঁজে পাবেন। অনেক শুভেচ্ছা রইল। সর্টিং হ্যাটের গান থেকে সেই বিখ্যাত দুটি লাইন দিয়ে আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ করছি–
'কেন না আমি হগওয়ার্টসের বাছাই করা টুপি
এবং আমি সকলকেই টুপি পরাতে পারি।'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন