পৃথিবী করোনাক্রান্ত হবে, মহামারির কবলে পড়বে এ কথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন। পাশাপাশি বাঙালি জাতিকেও চিনতেন হাঁড়ে হাঁড়ে। মহামারি হবে, মহামারিতে ঘর থেকে বের হতে বারণ করা হবে এ কথাও তার জানা ছিল। ওই যে বললাম বাঙালিকে তিনি হাঁড়ে হাঁড়ে চিনতেন! তাই আঁচ করতে পেরেছিলেন, এই বাঙালিকে পুলিশ ডান্ডা দিয়েও ঘরে পাঠাতে পারবে না।
লকডাউন হবে ঘরের বেড়া খুলে দিয়ে দরজায় তালা দেওয়ার মতো। পকেট পুরে প্রণোদনা নিয়ে সেই টাকায় বিড়ি ফুকতে বের হবে। দোকানের শাটারে টরে টক্কা টরে টক্কা করে পুরনো টেলিগ্রাম রীতি ফিরিয়ে আনবে। টক্কা টরে আওয়াজ দিলেই ভেতর থেকেও আওয়াজ আসবে, বেনসন না গোল্ডলিফ। রঙ চা না কি দুধ চা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধও কেউ কানে তুলবে না। এসব জানতেন বলেই কবিগুরুর সাধ জাগল কবিতার পঙক্তি দিয়ে বাঙালিকে অনুরোধ করার। যেন তারা ঘরের বাইরে না যায়। তিনি লিখলেন, ওগো! তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, কবিগুরু এটা আঁচ করতে পারেননি যে, করোনা মহামারির পাশাপাশি আরো একটা মহামারি থাকবে। যেটার সংক্রমণের কবলে পড়বে শতকরা নব্বইভাগ লোক। মাথা নিচু করে রাস্তায় হাঁটা, খাটের উপর উবু হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকা, বৃদ্ধাঙ্গুলির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কিছু একটা ক্রমাগত নিচের দিকে টানা (স্ক্রল করা) হবে যার উপসর্গ। এই টানাটানি কিংবা উবু হয়ে শুয়ে থাকার মহামারির (ফেসবুক, ইউটিউব) কবলে পড়ে মানুষের চোখ আর বইয়ের পাতায় থাকবে না, মানুষের সময় হবে না ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে’ কবিতা পাঠের। মানুষ যে তার কাব্য আহ্বানকেও পাত্তা দেবে না, এটা আঁচ করতে পারলে হয় তো অন্য কিছু রচনা করতেন।
কোয়ারেন্টাইন বা লকডাউনে ঘরে বন্দি হয়ে দিনাতিপাত করার অসহনীয় যন্ত্রণা বোধ হয় টের পেয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারুণ্যের অদম্য ইচ্ছা সম্পর্কে তার ভালো জ্ঞান ছিল। তিনি জানতেন দিনের পর দিন ঘরে বন্দি থাকা বাঙালি তরুণদের কাজ নয়। সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সমাজের উদ্দেশে তিনি যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, যার লিখিত রূপ ‘যৌবনের গান’ হিসেবে পরিচিত, তারপর আর এ দেশের যুবকদের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি থাকার কথা নয়।তিনি ভাবলেন, এই তারুণ্য তার ‘যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকে তাহাই বার্ধক্য’ বাণীকে অস্বীকার করে সুবিধা করতে পারবে না। তারা লকডাউন মানবে না। তরুণদের মনের যন্ত্রণার কথা বিবেচনা করেই নজরুল রচনা করলেন,
থাকব না কো বদ্ধ করে দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
করোনাকালে এটাই যেন বাঙালির একমাত্র সংকল্প হয়ে উঠল। জগৎ দেখার নেশায় তারা লকডাউন ভেঙে ঘরের বাইরে চলে এল পিপীলিকার মতো পিলপিল করে। তবে দলবল ছাড়ি একা নয়, সদলবলে।
করোনাকালে মানুষ ভিটামিন ডি নিয়ে বেশ সোচ্চার হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে রোদে গা পুড়িয়ে ভিটামিন সঞ্চয় করার দরকার পড়বে। সাধারণ ছুটি পেয়ে খুশিতে বাকবাকুম বাক বাকুম করতে করতে আবেগ প্রকাশের ভাষা হারিয়ে দিগ্বিদিক়্ লাফিয়ে বেড়াবে। এটাও বুঝতে পেরেছিলেন বলেই অন্যদিকে কবিগুরু বাঙালির ভাষা সঙ্কট কাটাতে এবং রোদ পোহানোর আহ্বান করে লিখলেন,
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি
আজ আমাদের ছুটিও ভাই আজ আমাদের ছুটি।
কী করি আজ ভেবে না পাই পথ হারিয়ে কোন বনে যাই
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি।।
অতএব তোমরা ঘরের বাইরে এসে রোদ পোহাতে থাক। অথবা ‘আজ ধানের ক্ষেত্রে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলোরে ভাই লুকোচুরি খেলো। লোকালয় ছেড়ে সামাজিক দুরত্ব মেনে ধানের ক্ষেতে লুকোচুরি খেল গে।পুলিশ পেটালে পেটাক, ডাকলে ডাকুক। তোমরা শুধু বলবে তখন,
ওরে যাবো না আজ ঘরে রে ভাই,
যাবো না আজ ঘরে!
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
নেব রে লুঠ করে।
কবিগুরু ও জাতীয় কবির আহ্বান কেউ উপেক্ষা করতে পারেনি। ধানের ক্ষেতে লুকোচুরি না খেললেও, রাস্তায় ঠিকই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে লকডাউনের দিনগুলোতে ভালোই খেলেছে। বাহিরকে লুট করার নেশায় মেতেছে।
লেখা: মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন