পলায়নের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে শেষ ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা ততক্ষণে শাহবাগ থেকে গণভবন অভিমুখে রওয়ানা দিয়ে ফেলায় সেনাপ্রধান হাসিনাকে বলেন ভাষণ রেকর্ড করতে বসলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না। ফলে, হাসিনা হেলিকপ্টারে চড়ে বসেন। তিনি যদি ভাষণ রেকর্ড করতেই পারতেন, তা হলে কেমন হতো তার বক্তব্য? মোটামুটি হুবহু লিখে দিচ্ছি—
আস সালামু আলাইকুম, প্রিয় দেশবাসী। আশা করি, সবাই ভালো আছেন। ভালো থাকারই কথা। পনেরো বছরে আপনাদেরকে যতটা ভালো আমি রেখেছি, বিশ্বের বুকে তা নজিরবিহীন। বক্তব্যের শুরুতেই আমি স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং পনেরোই আগস্ট কালরাতে বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে নিহত তার পরিবারবর্গকে। আমি আরো স্মরণ করছি আমাকে। দেশবাসী, আপনারা জানেন ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আমি বাংলাদেশ আওয়ামি লিগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এর দীর্ঘ পনেরো বছর পর আমি প্রধানমন্ত্রী হই এবং ২০০৮ থেকে একই পদে আসীন আছি। আমি জনগণের সুষ্ঠু ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। আমার ভোট চুরি করার দরকার পড়ে না। রাতের আঁধারে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার রাজনীতি? আমি করি না। ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙা সুটকেসের গল্প শুনিয়ে হাজার-হাজার কোটি টাকা লুটপাটও আমি করি না। ওগুলো আমার অভ্যাসে নাই। আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ, করে দিয়েছি; স্মার্ট বাংলাদেশ, করে দিয়েছি। আমি ক্ষমতায় আসার আগে দেশে ইন্টারনেট ছিল না, আমি করে দিয়েছি। আর কেউ করেনি। হাতে-হাতে মোবাইল ফোন, আমিই করেছি। আমি আরো যা যা করেছি, সব বলতে পারছি না। সময় বড্ড স্বল্প।
২০১৮ সালে কিছু ছেলেমেয়ে কোটাসংস্কার কোটাসংস্কার করল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম থাকবে না কোটা। এর পর কিছু মুক্তিযোদ্ধাসন্তান রিট করল। আমার কী করার ছিল এখানে? আমি তো আদালতের বাইরে যেতে পারি না। আমি আদালতের ভিতরেই থাকি, খাই, ঘুমাই; শুধু দাপ্তরিক কিছু কাজে গণভবনে আসি। কিছু ছেলেমেয়ে শুনানির আগেই হট্টগোল করল। আমি ছাত্রলিগকে বললাম ব্যাপারটা দেখতে। দেখেছেও ওরা। হয়তো একটু বেশিই দেখে ফেলেছে। দেখার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যাদের, তারা দেখবে না? তাতেই বিদ্রোহ করে বসল। কেন এই বিদ্রোহ? কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ? বুঝি না আমি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি— ঐ রাজাকারের বাচ্চাদের মদদে ওরা আস্ফালন দেখাল। আমি বিজিবিকে বললাম যাও ওদেরকে নিরাপদে হলত্যাগে সহযোগিতা করো। কিছু লোক বলল বর্ডার গার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবে কেন। আমি বলি কেন ঢুকবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। এখানে সবাই পারে, ঢুকতে। বর্ডারে কাজ কী ওদের? বিএসএফকে ঠেকাতে পারে না, বিজিপিকে ঠেকাতে পারে না। বললাম যাও, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও। কিছু-একটা করে খাও। জনগণের ট্যাক্সের টাকা হালাল করে খাও। আমি জনগণের ট্যাক্সের টাকা শুধু-শুধু খরচ করতে পারি না। শেখ হাসিনা কারো টাকা নয়ছয় করে না। সোয়াটও পাঠালাম হল খালি করতে। সোয়াট দেশের দুর্ধর্ষতম বিশেষায়িত সামরিক টিম। ছাত্ররা কম দুর্ধর্ষ? সামান্য এপিসি, সাউন্ড গ্রেনেড আর শটগান দিয়ে হল খালি করা যায়? না। হল খালি করতে সোয়াটই লাগে। আমরা ছেলেবেলায় দোয়াত-কলম দিয়ে লিখেছি, বুড়োবেলায় দেশের ইতিহাস লিখতে চেয়েছি সোয়াট-কলম দিয়ে। কী সুন্দর সুসজ্জিত সোয়াট, দেখতেও তো ভালো লাগে। তাতে আমার নাকি অপরাধ হয়ে গেছে। বুঝলাম না আমার অপরাধটা কী!
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলাম। কিছু লোক খুব হইচই করল। আচ্ছা, এই ইন্টারনেট কে দিয়েছে? ঐ বারোটায় ঘুম থেকে উঠে দুইটায় সাজুগুজু শেষ করে তিনটায় অফিসে আসে যে, সে? না। সে না। আমি দিয়েছি। আমি যা দিয়েছি, তা আমি বন্ধ করতে পারব না? এ কোন দেশের আইন, বুঝি না আমি। আমি যেমন দিতেও পারি, নিতেও পারি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে গোলযোগ করল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ফ্ল্যাশমব করবে, রিলস বানাবে, মিম বানাবে। ওরা কেন আন্দোলনে নামবে? কেন? বুঝি না আমি। রাজনীতির কী বোঝে ওরা? আমি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, আধপেটা খেয়ে রাজনীতি করেছি। করে এ পর্যন্ত এসেছি। আমি তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের না। তা হলে, প্রাইভেটের ছেলেমেয়েদের কেন অধিকার থাকবে সরকার নিয়ে আজেবাজে কথা বলার? পুলিশ গুলি করেছে। করবে না কেন! আমার ওপর গুলিবর্ষণ হয়নি? আটাশবার চেষ্টা করা হয়েছে আমাকে মারার জন্য। তা হলে প্রাইভেটের ছেলেমেয়েদের ওপর গুলি হলে সমস্যা কী? বুঝি না আমি। বুঝলামই না আমার অপরাধটা কী!
জামায়াত-শিবিরের ডাকে লোকজন, প্রকৃতপক্ষে ল কিছু টোকাই, রাস্তায় নেমে এসেছে। হট্টগোল করেছে। আমি বলেছি হেলিকপ্টার থেকে শুট করো, মাটিতে নামার দরকার নাই শুধু-শুধু। টোকাইরা কি মানুষ না? মানুষ। ওরা কাছ থেকে হেলিকপ্টার দেখার সুযোগ পায় না। আমি করে দিয়েছি। সুযোগও করে দিয়েছি, গুলিও করে দিয়েছি। উন্নয়ন শুধু মাটিতে হবে, পানিতে হবে; আর আকাশে হবে না— এটা তো ঠিক না। আমি সুষম উন্নয়নে বিশ্বাসী। তা ছাড়া, হেলিকপ্টার থেকে শুট করলে দেখতে পায় সবাই, লুকোচুরি করতে হয় না। ছাত্র-আন্দোলন দমনে বিশ্বের ইতিহাসে আমিই প্রথম আকাশযান ব্যবহার করেছি। এটা তো বলে না কেউ, করে শুধু অপপ্রচার। আমি তো লুকোচুরি করে ক্ষমতায় আসি না। জনগণের ভোটে আসি। জনগণ ভোট না-দিলে আসি না। দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতায় আসব— এত তো নির্লজ্জ আমি না। স্নাইপার থেকে গুলি করার কথা বলা হয়েছে। এমনিতে গুলি করলে টার্গেট মিস হয়, একজনকে মারতে বুলেট লাগে তিন-চারটা। স্নাইপার থেকে গুলি করলে টার্গেটও মিস হয় না, এক বুলেটে একাধিকজনও মারা যায়। বুলেট বাঁচে তাতে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা বাঁচে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা আমি তো অপচয় করতে পারি না। এর পরও, সাধারণ মানুষের জন্য এতকিছু করার পরও, কিছু লোক পদত্যাগ চায়। আমি বুঝলামই না আমার অন্যায়টা কী। আমি জনগণের ট্যাক্সের টাকা অপচয় করে ভুরু প্লাক করাই না, এই আমার অন্যায়? ঠিক আছে, আচ্ছা। আমি ভালো না। ভালো লইয়া থাকে যেন সবাই। থাকব না আমি আর। যখন আমি থাকব না; কী করবি রে, বোকা; ও রে ওকা!
বেশকিছু প্রাণ ঝরে গেছে, সত্য। কেন ঝরল? এমনি-এমনি না। আমি শেখ হাসিনা, এমনি কিছু করি না আমি। দেশে রাজাকারের বাচ্চাদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। আমি দেশে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব এনেছি। পাক হানাদারদের মতো শেখ হানাদারবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে যুদ্ধের আবহ তৈরি করেছি। আমি চেয়েছি এর মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা বুঝুক যোদ্ধাদেরকে কত কষ্ট করতে হয়েছে। এতেই আমার অন্যায় হয়ে গেছে? আমি বুঝি না আমার অন্যায়টা কী। বলে দিক কেউ আমাকে। তা তো বলবে না। আমি তো শুনতেই চাই। আলোচনার দরজা আমি খোলা রেখেছি, ভেন্টিলেটরও খোলার ব্যবস্থা করব। বিগত পনেরো বছরে কাদের কোন দাবিটা আমি শুনিনি? আন্দোলন করতে-করতে টায়ার্ড হয়ে গেলেই তো আমি দাবি শুনি বা দশ-পনেরোটা লাশ পড়ে গেলে আমি মেনে নিই সব। এতটুকু অপেক্ষা সহ্য হয় না? কেন হয় না? বুঝি না আমি। সবকিছু আমার একহাতে সামলাতে হয়। আমি একা কী করব! যদি তোর ডাক শুনে কেউ না-আসে, তবে একলা চল, ও রে। আমি ডাক দিলে কাক আসে, নোয়াখালী থেকে।
সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নামালাম কেন আমি, প্রশ্ন উঠেছে। নামাব না কেন? আমেরিকা হামলা করতে পারে আমাদের উপর, বার্মা পারে, চীন পারে। এরা হামলা চালালে আমাদের সেনাবাহিনীর পারফরম্যান্স কেমন হবে? সরকারপ্রধান হিশেবে আমার এটা পরীক্ষা করে রাখা উচিত না? দেখা উচিত না ওদের বন্দুকের নিশানা কেমন? নিশানা পরীক্ষার জন্য আমি লোক পাব কই? সামান্য নিশানা পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীরা আত্মোৎসর্গ করতে পারবে না? কেন পারবে না? রাজাকারের নাতি-পুতি না-হলে এতে আপত্তি করার কথা না। তবুও করেছে, করুক। কিছুই যায়-আসে না এতে আমার। আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা, আমি নীলকণ্ঠ, আমি সর্বংসহা। এক রাতে আমি সবাইকে হারিয়েছি। স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি। স্বজন হারানো যে কত কষ্টের, কত যন্ত্রণার, কত দুঃখের; তা আমি ছাড়া আর কে ভালো বোঝে! হিচহিচহিচ। আর মেট্রোরেল হারানোর বেদনা তো আমি একাই বুঝি। বিটিভি পোড়ার বেদনা? তাও আমি একা। ওরা মেট্রোরেলের ক্ষতি করেছে ১০০ কোটি টাকার, আমার পিয়ন ভেগেছে ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে। আমার পিয়নের এক-চতুর্থাংশ টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি কী করে মেনে নিই আমি! ২০০৯ সালে 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্প, আমি করে দিয়েছি। আমি চেয়েছি 'একটি বাড়ি একটি শহিদ' প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে, সব পরিবারকে একটি করে শহিদ উপহার দিতে; যাতে স্বজন হারানোর বেদনা সবাই সুন্দরভাবে উপলব্ধি করতে পারে। স্বজন হারানোর বেদনা উপলব্ধির বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছি আমি। এই ছিল আমার অপরাধ? আমি বুঝলামই না আমার অপরাধটা কী।
হেলিকপ্টার থেকে ডাক এসেছে। যে-হেলিকপ্টার থেকে শুট করে মানুষের মুখে আমি একচিলতে হাসি ফোটাতে চেয়েছি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কায়েম করতে চেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছি; সেই হেলিকপ্টারে করেই আমি চলে যাচ্ছি। শহিদ হয়েছ যত, খুশি তত করেছ আমায়; হে গিনি পিগ, বিদায়। নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি, দেওয়ার কিছু নাই; ছিল শুধু ছাত্রলিগ, দিয়ে গেলাম তা-ই। আবার আসিব ফিরে গণভবনের নীড়ে, শেরেবাংলায়; হয়তো মানুষ নয়, হয়তো হেলিকপ্টারের বেশে। পালিয়ে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
আমি বুঝলামই না আমার অপরাধটা কী
হেলিকপ্টার চিরজীবী হোক
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন