মানিকচাঁদ নামে এক বণিক বাস করত দিল্লীতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যে প্রথমে এই বণিকের মুখ দর্শন করত, তার নাকি সারাদিন আর অন্ন জুটত না। কথাটা সম্রাটের কানে এল।
সম্রাট ভাবলেন, আজব কথা তো। বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন। তাই একদিন ধরে এনে প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হলো মানিকচাঁদকে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সম্রাট প্রথমেই মানিকচাঁদকে দেখলেন। তারপর তাকে মুক্ত করার আদেশ দিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন, দেখা যাক আজ কি হয়।
যথারীতি প্রাতঃকৃত্য শেষে সম্রাট খেতে যাবেন। এমন সময় বাঁদী এসে খবর দিল বেগমের ভয়ানক মাথা ধরেছে। সম্রাটকে এখুনি যেতে হবে। ছুটলেন সম্রাট। হাকিম তলব করা হলো। দাওয়াই দেয়া হলো। খানিক সেবার পর বেগম সুস্থ হয়ে উঠলেন।
ওদিকে সম্রাটের সকালের নাশতা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। ফলে আবার তা গরম করার ব্যবস্থা করতে হলো। কিন্তু খাওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার অনেক পরেও না খাওয়ার জন্য সম্রাটের পেটে ব্যাথা শুরু হলো। ব্যাথা তো ব্যাথা, সম্রাটের অবস্থা একেবারে কাহিল। আবার হাকিম সাহেব এলেন। সম্রাটকে পরীক্ষা করে বললেন, ‘আজ আর কিছু না খাওয়াই সম্রাটের জন্যে ভাল হবে।’
ব্যাথায় অস্থির সম্রাট বললেন, ‘সে কি হাকিম, সকালেও তো কিছু খাইনি।’
হাকিম বললেন, ‘তবুও আজ না খাওয়াই ভাল। কিন্তু সকালে খাননি কেন? তাহলে তো দাওয়াতই দিতে হয়।’ বলে সম্রাটকে দাওয়াই খাইয়ে দিলেন হাকিম। খানিক পরে কমে গেল ব্যাথা। ব্যাথা কমতেই সম্রাটের মনে পড়ল মানিকচাঁদের কথা। মেজাজ তাঁর গরম হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে ওই নচ্ছার বণিকের মুখ দেখেছিলেন বলেই সকালে তো খেতে পারেননি, উপরন্ত সারাদিনের খাওয়া বরবাদ হতে চলছে। এমন অলুক্ষণের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি মানিকচাঁদকে ধরে এনে ফাঁসিতে লটকে দেবার নির্দেশ দিলেন।
নির্দেশ মত পেয়াদা গিয়ে হাজির মানিকচাঁদের বাড়িতে। সম্রাটের নির্দেশ জানাতেই রীতিমত ভড়কে গেল সে। আর জানল-সকালে উঠে প্রথমেই তার মুখ দেখার কারণেই সম্রাট কিছু খেতে পারেননি। তাই তার এ শাস্তি। মানিকের শত কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও পেয়াদা তাকে ধরে নিয়ে চলল। পথে বীরবল এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। মানিক বীরবলের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাকে বাঁচান। আমার বউ ছেলেমেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
বীরবল বণিককে অভয় দিলেন, প্রহরীদের কাছ থেকে তাকে একটু আড়ালে নিয়ে, কিছু কথা বলে আবার প্রহরীদের কাছে ছেড়ে দিলেন। পেয়াদারা বণিককে ধরে সোজা ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে এল। জল্লাদ এসে উপস্থিত হলো। ফাঁসির পূর্বে মূহুর্তে মানিক চাঁদকে জিজ্ঞেস করা হলো যে মৃত্যুর আগে তার কোন বিশেষ ইচ্ছা আছে কি না। কোন ইচ্ছা পূরণ করা হবে।
মানিক বলল, ‘মহামান্য সম্রাট ভারতেশ্বর আকবর কে একবার দেখতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।’
পেয়েদা-আমত্যরা রাজি হলো না। জানাল সম্রাটের মেজাজ বিগড়ে আছে। একথা বললে তিনি হয়তো আরো রেগে যাবেন। কিন্তু মানিক চাঁদের ওই একই কথা। শেষে খবর দেয়া হল সম্রাটকে। এলেন তিনি। মানিককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? মৃত্যুর আগে আমার দেখার ইচ্ছা কেন?’
মানিক করজোড়ে বলল, ‘মহামান্য সম্রাট বাহাদুর, এটা কি সত্যি যে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমার মুখ দর্শনের কারণে সারাদিন কিছু খেতে পারেননি? আর তাই আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নির্দেশ দিয়েছেন?’
সম্রাট বললেন, ‘শুধু কি আমি-যারাই সকালে প্রথমে তোমার মুখ দর্শন করে তারাই সারাদিন উপোস করে মরে। তোমার মত এরকম অলক্ষুণে, অপয়া লোককে আমরা রাজ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না।’
মানিক চাঁদ বলল, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, আমি আজ প্রথমেই আপনার মুখ দর্শন করেছি। আর সেজন্যেই মরতে বসেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার মুখ দেখে যদি ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হয়, সেটা কেমন হচ্ছে?’
একথা শুনে সম্রাট একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তোমার কথাটা একদিক থেকে ভুল নয়। ঠিক আছে যাও, তোমার মৃত্যুদন্ড রদ করে দিলাম। কিন্তু তোমার ঘটে এই বুদ্ধি এল কি করে?’
মানিক বলল, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, বীরবল মহাশয়ের বুদ্ধি পেয়েছিলাম’
মুচকি হেসে চলে গেলেন সম্রাট।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন