আমার চোখে সিক্স, জেনজি'র চোখে নাইন

১২৬ পঠিত ... ১৭:৩১, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৫

18

যাদের জন্ম ১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে তাদের চোখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের একজন উজ্জ্বল নেতা যিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফুলের মালা নিয়ে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরেছিলেন। যার মুক্তির জন্য প্রবীণেরা রোজা রেখেছিলেন, প্রার্থনা করেছিলেন। একই নেতা স্বাধীন বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন। তার রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার ত্রুটিতে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থাপক হিসেবে তার ব্যর্থ হবার ঘটনার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হবার ঘটনা বেশি রেখাপাত করেছে ১৯৬০-৯০-এর মাঝে জন্ম নেওয়া প্রজন্মগুলোর মনোজগতে। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে মুজিবের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব আর সপরিবারের নিহত হবার ট্র্যাজেডিকে পুঁজি করে নেতৃত্বের যোগ্যতা না থাকার পরেও তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রাজনীতির প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেন।

ভারতের নেতা জওহরলাল নেহেরু যেমন তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি করেছিলেন; পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো যেমন তার মেয়ে বেনজির ভুট্টোকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধু তার মেয়ে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তা করেননি। তিনি তার দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামালকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিয়েছিলেন; যারা ১৫ আগস্ট নিহত হন।

ফলে রাজনৈতিক দীক্ষাহীন শেখ হাসিনা ভিলেজ পলিটিক্সের আদলে রাজনীতি করেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে নিজের ক্ষমতায় থাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। ১৫ আগস্টের স্বজন হারানোর বেদনা তার মধ্যে যে পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার সৃষ্টি করে; সেটাই তার প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির জ্বালানি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়াকে মইনুল হোসেন রোডের বসত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে তা গুঁড়িয়ে দেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম-ঠিকানা মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে এমনকি তার কবরটি ঢাকা থেকে বগুড়াতে স্থানান্তরের হুমকি দিতে থাকেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জামায়াতের নেতাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি দেবার পর; হাসিনার ক্যাডারেরা শাস্তিপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের কবর ভেঙে ফেলার কাজটিও করেছেন।

শেখ হাসিনার ক্যাডারেরা কি মানুষ হত্যা, কি ভাংচুর সর্বত্র জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়েছে। যাদের জন্ম ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের আশেপাশে, তারা ২০০৯ থেকে ২০২৪ শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের সরাসরি ভিকটিম। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে হাসিনার ক্যাডারেরা নতুন প্রজন্মকে হামলা করেছে; হত্যা করেছে। হিটলারের ফ্যাসিজমে নাতসিদের জামায় যেমন সোয়াসটিকা চিহ্নের পিন লাগানো থাকত; ঠিক তেমনি হাসিনার ফ্যাসিজমে আওয়ামী ক্যাডারদের জামায় বঙ্গবন্ধু ছবিসম্বলিত পিন লাগানো থাকত। সোয়াসটিকা নাতসিদের ভিকটিমদের মনে যে বিভীষিকা তৈরি করত একইরকম বিভীষিকা আওয়ামীলীগের ভিকটিমদের মনে তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের ফ্যাসিজমে বঙ্গবন্ধুকে ভীতির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এমনকি ২০০৯-২৪-এর হাইব্রিড আওয়ামী সাইবার বট ও ফ্যাসিজমের বেনিফিশিয়ারিরা  মুক্তিযুদ্ধের  চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর মালিকানা দাবি করে; এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শহীদ পরিবারের ছেলেদেরও ‘রাজাকার’ তকমা দিয়েছে। ভারতের প্রণব মুখার্জি ও নরেন্দ্র মোদির সমর্থনে হাসিনা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করায় আওয়ামীলীগের মধ্যে বিজেপি উদ্দীপনা এত বেড়ে যায় যে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মালিকানা দাবি করে; মুসলিম নাম দেখলেই তাকে পাকিস্তানপন্থীর তকমা দিতে থাকে। অখণ্ড ভারতের এই জোশে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ার সম্পাদকীয় নীতিতে চলতে থাকে বাংলদেশের বেশ কিছু টিভি চ্যানেল।

১৯৬০-৯০ প্রজন্মগুলো যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে পরম মমতায় লালন করেছে; তাদের নানা তকমায় ডিহিউম্যানাইজ করে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের দেশ ডাকাত ও খুনেরা যে কোনো অপরাধ করার আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেবার নিয়ম চালু করে। আওয়ামীলীগের প্রতিটি খুনি প্রতিটি দেশ-ডাকাতের ফেসবুক কাভারে ঝুলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ছবি।

বঙ্গবন্ধু আসলে একজন ট্র্যাজেডির নায়ক। ১৯৪৭ এর বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম থেকে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান বিরোধী স্বাধীকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ; প্রতিটি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন যিনি; তিনি রাজনীতিতে এমন উত্তরাধিকার রেখে গেলেন যে, তার দুই মেয়ে হাসিনা ও রেহানা ছাড়াও শেখ টাইটেলের আত্মীয়-স্বজনেরা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিজম, দেশলুণ্ঠন ও মানবতা বিরোধী অপরাধ করলেন। এরকম আত্মীয়-স্বজন না থাকলে বঙ্গবন্ধু  ১৯৭২-৭৫ শাসন পর্বে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় এত ব্যর্থ হতেন না বলে মনে হয়।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ১৯৬০-৯০ প্রজন্মগুলোর অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন; ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের আশেপাশে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের মূল্যায়ন ও অভিজ্ঞতা একেবারে পৃথক। কেননা ১৯৯০-২০০০ সালের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু পেয়েছে হাসিনার ফ্যাসিজমের আইকন হিসেবে। ফলে তাদের কাছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর স্বাধীনতার ঠিকানা না হয়ে পরাধীনতার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে; যেখানে ভারতের ভাগ্যবিধাতা এসে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে; বেআইনি নির্বাচনের স্বীকৃতি দিয়ে প্রলম্বিত করেছে আওয়ামী সুবেদারের মাধ্যমে ভারতীয় সালতানাত।

ফ্যাসিজমের আওয়ামীলীগ হিন্দুত্ববাদের আদলে একটি নতুন ধর্ম হিসেবে চর্চিত হয়েছে; যেখানে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি রামের মূর্তির মতো পূজিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পূজায় নিয়ম করে মানুষ বলি দেওয়া হয়েছে গুম ও ক্রসফায়ারে। ২০০৯-২৪-এর আওয়ামীলীগ এত আদিম সব ধর্মকৃত্যের প্রচলন করেছে; যা বাংলাদেশকে অন্ধকার যুগে নিয়ে গেছে। আর সেই অন্ধকার যাত্রাকে অন্ধভাবে সমর্থন করে গেছেন দলান্ধ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক জোট। যারা মানুষ বলি দেবার দৃশ্য দেখে হরষে হাততালি দিয়েছে; সবশেষে জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতা বলিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে। ৫ আগস্টের পর ছয়মাস পেরিয়ে গেছে; কোথাও বিন্দুমাত্র অনুতাপের চিহ্ন নেই। ভারতের সেবাদাস শেখ হাসিনা ভারতে বসে কাপালিকের ভঙ্গিতে আরও রক্ত তৃষ্ণার ঘোষণা দিচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়া অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে বাংলাদেশকে। আর ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডাগুলো ঘাড়ে করে দৌড়াচ্ছে ফ্যাসিজমের দোসরেরা।

আমার বয়স যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় সমান; আমি ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে বাংলাদেশের মুক্তিকে উদযাপন করেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলায় আমার সম্মতি নেই। কিন্তু নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন; কোথাও তো আমার রক্ত ঝরেনি; ছাত্রলীগ হেলমেট পরে হাতুড়ি হাতে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে আমাকে পেটায়নি, খুনে যুবলীগ জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে বুলেট দিয়ে আমার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়নি; আজও পঙ্গুত্ব নিয়ে অন্ধত্ব নিয়ে বেঁচে নই আমি। শেখ হাসিনা আমাকে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলেননি; কালচারাল সফট পাওয়ার আমাকে হিজবুত বলে তকমা দেয়নি। এইসব মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি যাদের জীবনে ঘটেছে সেই জেন জি'র জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু ফ্যাসিজমের দানবীয় আইকন। তাই তাদেরকে ন্যায় অন্যায়ের হিতোপদেশ দেওয়া আমাকে মানায় না। বিশেষ করে গত রাতে শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে ঢাকার উদ্দেশে ভাষণে যে ডিনাইয়াল আর ক্যানিবালিজম প্রদর্শন করলেন; তাতে জেন জি-কে হাসিনার ফ্যাসিজমের টুলগুলোর ব্যাপারে সদয় হতে বলাকে নিতান্ত বাস্তব বিবর্জিত খেলনা উপদেশ বলে মনে হচ্ছে।

১২৬ পঠিত ... ১৭:৩১, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top