খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোশাওয়ার রশোমন চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, একই ঘটনাকে ছয়জন ছয়ভাবে বর্ণনা করছে। প্রত্যেকের কাছে ওটাই সত্যি যেভাবে সে ঘটনাটিকে দেখেছে। এটি সভ্যতার জন্য শিক্ষা। একেকজন মানুষের এক একরকম দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে ব্যক্তিমানুষ তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখে। বিভিন্ন পার্সপেকটিভ থেকে দেখলে একই ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দেখায়। একারণেই ভিন্নমতে একমত হওয়া সভ্যতার সূচক। পরমতসহিষ্ণুতা শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে এ কারণেই।
এখন আমরা নতুন দিল্লিতে জি টোয়েন্টি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সেলফি তোলার ঘটনাটিকে বিভিন্ন জন কীভাবে দেখেছেন সেই গল্প বলবো।
এই সেলফি দেখে সহমত ভাই বলছেন, বাইডেন ছুটে এসে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলা থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অসীম। এতোদিন বিএনপি বাইডেনের কানভারী করে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে ভুল ধারণা দিয়েছিলো, বাইডেন সেই ভুল বুঝতে পেরেছেন। খেয়াল করে দেখুন, বাইডেন নিজেই আগ্রহ করে সেলফি তুলছেন। গত পনেরো বছরের উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার রাইজিং টাইগার। সুতরাং এমেরিকাকে এখন সমীহ করে চলতে হয় বাংলাদেশকে। দেখুন ছবিতে বাইডেন কীভাবে শক্ত করে মাননীয়ার হাত ধরে রেখেছেন। এটা এমেরিকা-বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক। উনি আস্থা রেখেছেন আওয়ামী লীগের ওপর। বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশে এই উন্নয়নের সরকার, বারবার দরকার। এই ছবি দেখে বিএনপির চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেছে, তারা হাপুস নয়নে কাঁদছে। তাদের হিংসাটা কী লক্ষ্য করেছেন, এই ছবি প্রকাশিত হবার পর থেকে। সহ্য করতে পারছে না। এতো দিন ধরে ষড়যন্ত্র করে যেইসব সাংশনের গল্প শুনিয়েছে, এই একছবিতে সব ষড়যন্ত্র উড়ে গেছে। বাইডেন বুঝে গেছেন, আওয়ামী লীগের হাতেই পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
একই সেলফি দেখে রহমত ভাই বলছেন, আমরা অতীতে দেখেছি এমেরিকার প্রেসিডেন্ট কত হেসে হেসে ছবি তুলেছিলো ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে। তারপর কী হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। বাইডেন তো দেখলাম যাকে পাচ্ছে তার সঙ্গে সেলফি তুলছে, বুড়ো বয়সে নতুন সেলফি তোলা শিখলে যা হয় আরকী! বোঝাতে চাচ্ছে আমার বয়স যাই হোক, আমি মনের দিক থেকে এখনো তরুণ। এই ছবি নিয়ে কী আদিখ্যেতা আওয়ামী লীগের! অথচ কয়েকদিন আগেই বললো, আটলান্টিকের ঐপারে ২০ ঘন্টা কষ্ট করে যাওয়ার কোন দরকার নাই! আমরা আফ্রিকায় যাবো। আজ আবার এমেরিকার জন্য দরদ উথলে পড়ছে, কতই রঙ্গ জানোরে আওয়ামী লীগ, কতই রঙ্গ জানো! এখন এক কাজ করো ছবিটার প্রিন্ট আউট নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে ঘোরো!
এই সেলফিটি দেখে শিবব্রত দাদা গালে সুপোরি পুরে বলছেন, এই ম্যাজিকের ম্যাজিশিয়ান আসলে নরেন্দ্র মোদী। উনি কেদারনাথের মন্দিরে ধ্যান করে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা লাভ করেছেন। বাইডেন মোদিজীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যাবে কী করে! ভারত এখন সুপারপাওয়ার, চন্দ্রজয় করেছে, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সনাতন ধর্মী, সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট সনাতনধর্মী, বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির সিইও ভারতীয়। এমেরিকাকে এখন ভারতের কথা অনুযায়ীই চলতে হবে! দেখলেন না, জি-টোয়েন্টিতে এসে বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে একটি মন্তব্যও করেননি। এতে হতাশ হয়েছে বেচারা কংগ্রেসের পাপ্পু! সেই মহাপরাক্রমশালী মোদীজী যখন বলেছেন, বাংলাদেশে আমার আওয়ামী লীগকে চাই, বাইডেনের কী সাহস আছে, সেই নির্দেশ উপেক্ষা করার। ঠিকই সুড় সুড় করে এসে সেলফি তুলেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে! যতদিন মোদীজীর হাত ধরে আছে আওয়ামী লীগ, ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ!
এই সেলফিটি নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার ছবি ও শিরোনাম ফটোশপ করে শরিয়ত ভাই এসে বলেন, নিজেরাই অনুরোধ উপরোধ করে যেঁচে গিয়ে ছবি তুলেছে বাইডেনের সঙ্গে। হেসে হেসে সেকী বাইডেনের বরফ গলানোর চেষ্টা। আরে এমেরিকার ইহুদি-নাসারাদের আমরা চিনি। ওরা হেসে কথা বলা মানেই কপালে খারাবি আছে। এমেরিকা যার বন্ধু তার আর শত্রু দরকার কী! এইজন্য আমরা কোন বিদেশী শক্তির মুখাপেক্ষী নই, আমরা আস্থা রাখি তৌহিদী জনতার ওপর। আওয়ামী লীগের এক মুখে কত রকম কথা। একবার ভারতের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী; আবার বললেন, ভারতে গিয়ে ভালো করে বলে এসেছি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে! এইরকম পরমুখাপেক্ষী নতজানু রাজনীতি আগে কখনো দেখিনাই, এইটা কী স্বাধীন দেশ, নাকি কারো করদ রাজ্য!
এই ছবিটি নিয়ে আক্ষেপ করে একজন সাধারণ প্রজা বলেন, এই ছবিতে কী আমাদের পেট ভরবে; জিনিসপত্রের দাম কমবে! তোমরা আছো ভাই তোমাদের ক্ষমতার চিন্তা নিয়ে, আর আমাদের চিন্তা রাতে কী খাবো, বাচ্চাটাকে কী খাবো! রাজারজড়ার ছবি দেখে কী আমাদের দিন যাবে ভাই! একবার মোদীর সঙ্গে ছবি, একবার বাইডেনের সঙ্গে ছবি, একবার ঋষি সুনাকের সঙ্গে ছবি। খালি খালি দোষ হলো বেচারা শাহেদের। তারও শখ ছিলো হোমড়া চোমড়া লোকের সঙ্গে ছবি তোলার, তারপর সেই ছবি দেখিয়ে প্রভাব প্রতিপত্তি খাটানোর। আসলে ঘুমিয়ে আছে শাহেদের পিতা-মাতা সব শাহেদের অন্তরে! দুইদিন আগে যে এমেরিকাকে গালি দিলো, আজ তাকে চুমা দিচ্ছে লীগের ভাইয়েরা, একই অঙ্গে এতো রুপ! যাই এই ছবি দেখিয়ে মুদি দোকান থেকে চাল-ডাল নিয়ে আসি; দেখি দেয় কীনা! ছবির কীরকম শক্তি!
একই ছবি দেখে আবহাওয়া পরিদপ্তর জানায়, আবহাওয়া পরিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী ফেসবুকের ছোট ছোট সহমত নৌযান ও শিবব্রত ট্রলারগুলোকে জানানো যাচ্ছে যে, এখন থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এমেরিকা ভীষণ ভালো। এমেরিকাকে গালাগালের লাল পতাকা সরিয়ে মাস্তুলে প্রশংসার সবুজ পতাকা দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়ার সংবাদটি শেষ হলো।
কয়েকঘন্টা পরেই আসে আরেকটি আবহাওয়া বুলেটিন,
আবহাওয়া পরিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে নতুন দিল্লিতে জো বাইডেন অত্যন্ত হাসিখুশি নির্মল বন্ধুভাবাপন্ন থাকলেও ভিয়েতনামে গিয়েই তা মোদির মানবাধিকার হনন বিষয়ে তীব্র হ্যারিকেন ঝড়ে রুপান্তর হয়। এরপর তা আঘাত হানে চেন্নাই ও মুম্বাই-এ। হ্যারিকেন ঝড়টি দিল্লির আকাশে কুন্ডলি পাকায়। সুযোগ বুঝে মোদির প্রতিপক্ষ কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া নামের জোট মোদিকে এক হাত নিতে শুরু করেছে।
বঙ্গোপসাগরের ছোট ছোট সহমত নৌযান ও শিবব্রত ট্রলারগুলোকে ‘এমেরিকা ভালো’ সবুজ পতাকা নামিয়ে ‘এমেরিকা খারাপ’ লাল পতাকা দেখিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আপাতত লালপতাকা পকেটে থাক। মোদির অপমান যেহেতু সহমত ও শিবব্রতেরও অপমান; তাই তাদের উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের মানসিক প্রস্তুতি রেখে সেলফি বন্দনা ধীরে ধীরে এমনভাবে গুটিয়ে নিতে হবে; যাতে বিসদৃশ না দেখায়।
আপাতত ম্যাখোঁ সবুজ পতাকা উড়িয়ে সারারাত জলের গান চালিয়ে যাওয়া ভালো হবে।
আবহাওয়া বিজ্ঞপ্তিটি শেষ হলো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন