ক্রিকেট প্রেম-অপ্রেমের সাকিব

১৯৭ পঠিত ... ১৭:০৩, নভেম্বর ০৭, ২০২৩

20 (1)

Whatever is begun in anger, ends in shame.

— Benjamin Franklin

আমাদের প্রতিটি আলোচনাই ক্রোধ দিয়ে শুরু হয়; শেষ হয় লজ্জায়। বিশ্বকাপের শ্রীলংকা বনাম বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচে শ্রীলংকার ব্যাটসম্যান এঞ্জেলো ম্যাথিউস দুই মিনিটের মধ্যে ক্রিজে এসে বল ফেস করতে ব্যর্থ হওয়ায়; বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আইসিসির একটি প্রায় অব্যবহৃত আইনের সুযোগ নিয়ে আম্পায়ারের কাছে আপিল করেন। আইন অনুযায়ী ম্যাথিউসকে আর ব্যাট করতে না দিয়ে আউট ডিক্লেয়ার করেন আম্পায়ার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে এই আইনে আপিল এই প্রথম। এইজন্য ক্রিকেট আইনের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখালেন সাকিব।

এই ঘটনাটি নিয়ে ক্রমাগত বিতর্ক হয়েছে। একপক্ষ মনে করে, যেহেতু আইনে আছে; ক্রিকেট খেলা যুদ্ধের মতো; ভালোবাসা ও যুদ্ধে সবই ফেয়ার। আমি এই প্রবাদে ভালোবাসা, যুদ্ধের সঙ্গে নির্বাচন শব্দটিও যোগ করতে ইচ্ছুক। কেবল সংবিধান সমুন্নত রাখলেই চলে; নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে এমন কোন কথা নেই। গণতন্ত্রের স্পিরিট বলে কোন কথা নাই। কাজেই শুধু ক্রিকেটের আইন সমুন্নত রাখলেই চলে; অংশগ্রহণমূলক ক্রিকেটের কোন প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশের আইন মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে আইন-কানুনের প্রতি অত্যন্ত সচেতনতা দেখান; সাকিবও তার অন্যথা করেননি। সংবিধান সমুন্নত রেখে বিনা ভোটের নির্বাচন অথবা আইন সমুন্নত রেখে বিনা ব্যাটিং-এ আউট!

ক্রিকেটের এই সাকিবীয় পৃথিবীতে মনে পড়ে ক্রিকেটার ধোনী একবার অক্রিকেটীয়ভাবে কেবল আইনে আউট হয়ে যাওয়া এক প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে আবার ব্যাটিং করার সুযোগ দিয়েছিলেন। সেই ধোনীর ঔদার্য্যের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই ভারতীয় ক্রিকেট আজ এতটা ধনী হতে পেরেছে।

রাজনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-অর্থনীতি-সমাজ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পারফরমেন্স যেমন; এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলের পারফরমেন্সও ঠিক সেরকম। এরকম দুর্বল পারফরমেন্সের কারণে শ্রীলংকার ক্রিকেট বোর্ডটিকে ভেঙ্গে দিয়ে বিশ্বকাপ'১৯৯৬ বিজয়ী টিমের অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে বোর্ডটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মনে আছে, শ্রীলংকার অর্থনীতি ডুবে গেলে, আমরা গাল ফুলিয়ে বলতাম, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলংকা হবে না।

বছর না যেতেই শ্রীলংকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, যোগ্য লোকদের পদায়নের চল আছে; তাই অর্থনৈতিক সংস্কার করে; ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করে আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকার অর্থনীতি। লিখে রাখুন, অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াবে শ্রীলংকার ক্রিকেট।

বাংলাদেশের শ্রীলংকা হবার সুযোগ নেই; কারণ আমাদের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তির পদায়নের সুযোগ নেই। অমুকের ছেলে, তমুকের মেয়ে দিয়ে চলে আমাদের ব্যবস্থাপনা। আর আছে টেকাটুকা নির্ভর স্থূল ভোগী সমাজ। এরা সারাজীবন ভুগিয়েছে; আমৃত্যু ভোগাবে। তবু শ্রীলংকার মতো যোগ্য অর্থনীতিক, যোগ্য খেলোয়াড়কে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হবে না। চেয়ারের প্রতি ফেভিকল মায়া আর সেই চেয়ারের জন্য অনুগত কুশান-সমাজ নিয়েই আমাদের গোপাল ভিলেজের ব্যবস্থাপনা।

ম্যাথিউসকে টাইম আউট করার বিতর্কে অসংখ্য মানুষ যোগ দিয়েছেন। একটি অংশ ক্রিকেট আইনের প্রতি অবিচল ভক্তির শব্দমালা বর্ষণ করেছেন; আরেকটি অংশ ক্রিকেটের স্পিরিটের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

চিন্তা করে দেখুন যে সমাজে আইনের শাসন নেই; সেইখানে ক্রিকেট আইন নিয়ে সচকিত এতোগুলো মানুষ। দেশের আইনের শাসন নিয়ে এর অর্ধেক মানুষ কথা বললেও শাসকেরা বাধ্য হতো আইনের শাসন প্রচলন করতে। ভেবে দেখুন, যে সমাজে ভিন্নমত পোষণ করলেই, আলফাডাঙ্গা কলেজ গ্রাজুয়েট কিংবা জার্মানিতে অধ্যয়নরত মাস্টার্সের ছাত্র ‘চ’ বর্গীয় গালি দেয়; সেখানে ক্রিকেটের সৌজন্য বোধের পক্ষে এতো মানুষ। এদের অর্ধেক মানুষ প্রতিবাদ করলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা খবরের লিংকের মন্তব্যঘর থেকে পালিয়ে যেতো চ-বর্গের লোকেরা।

আমাদের সমাজে আবেগ ও যুক্তি দুটোই মিসপ্লেসড। জায়গামতো মুখে কুলুপ এঁটে থেকে; কিংবা বে আইনি কাজ ও অশিষ্ট আচরণ দেখে পুলক নিয়ে নিয়ে; অজায়গায় এসে আইন ও শিষ্টাচারের পুষ্প বর্ষণের কারণে সমাজ অনড় পাথরের বুকে চেপে বসে থাকে অপরিবর্তনীয় নিয়তির মতো।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে ম্যাথিউসই প্রথম ব্যাটসম্যান নন; যিনি দুই মিনিটের মধ্যে ক্রিজে পৌঁছে বল ফেস করতে ব্যর্থ হলেন; যারা ক্রিকেট খেলাটা নিয়মিত দেখেন, একটু স্মৃতিকে নাড়া দিন; দেখবেন অনেকেই দেরি করেছেন, আম্পায়ারের বকাও খেয়েছেন; কিন্তু প্রতিপক্ষের অধিনায়ক এই আইন ধরে নাড়া দেয়নি। আমরা দিয়েছি।

আমাদের গ্রামদেশে একটা প্রবাদ আছে, একটু পড়লেখা শিখলেই পোলা গঞ্জে গিয়া যেই মামা বা চাচা তাকে পড়ালেখা শিখিয়েছে; তার নামে একটা মামলা দিয়ে আসে।

সাকিব এর আগের নির্বাচনেই আইন প্রণেতা হতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার মাথায় হাত রেখে খেলার মাঠে আরো কিছুকাল থাকতে বলেছেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে সাকিবের মত সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে আমরা আর কাউকে দেখিনি। কী শেয়ার বাজারে; কী স্বর্ণব্যবসায়ে সর্বত্র সফল তিনি। পৃথিবীতে কত ক্রিকেটারই তো খেলেন, কারো স্ত্রীকে কখনো সমালোচকদের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখিনি। বাংলাদেশের অলরাউন্ডার ক্রিকেটারকে বিয়ে করে সাকিবের স্ত্রী বাংলাদেশে থাকতে না চাওয়ায়; সাকিব বাধ্য হয়েছেন, মাঝে মাঝে খেলা থেকে ছুটি নিয়ে অনাবাসে স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে চলে যেতে। মানুষের মন তো স্বজনের সান্নিধ্যের জন্য হাহাকারটাই শাশ্বত।

পৃথিবীতে স্ত্রী ও সন্তান প্রায় সব মানুষেরই থাকে; এর মধ্যে বিশেষ কোন সৃজনশীলতা আছে বলে মনে হয়না। কিন্তু সাকিবের মতো এক্সট্রা-অর্ডিনারি একজন মানুষ; তার ক্রিকেটের সৃজনশীলতাকে গার্হস্থ্য টানাপোড়েনের চাপে ফেলা তার পার্টনারের যৌক্তিক কাজ হয়নি বলে অনুভূত হয়েছে। সাকিব নারী হলেও বক্তব্যটি একই। এমনকী পাওয়ার-কাপল; স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যেখানে সৃজনশীল কাজে যুক্ত; তারা একে অপরকে সহযোগিতা করলে মাদাম কুরি ও জুলিও কুরির মতো সাফল্য আসে।

মানসিক চাপ ও রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা সাকিবের মতো একজন অলরাউন্ডারের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ফিনিশিং-টাতে অনেক চোট পৌঁছে দিয়েছে। গতকাল ম্যাচ শেষে দলের একজন নবীন খেলোয়াড়ের সঙ্গেও কর্কশ আচরণের দেহভাষা প্রদর্শন করেছেন তিনি। এর আগে ডোমেস্টিক ক্রিকেটে একজন আম্পায়ারের ওপর চড়াও হতে ও লাথি দিয়ে উইকেট ভেঙ্গে দিতে দেখেছি তাকে।

আমাদের গ্রামাঞ্চলে যেহেতু 'বাপের ব্যাটা সাদ্দাম' বলে একটি বাহাদুরী প্রবাদ প্রচলিত; তাই অনেককে বলতে শুনি এই অ্যাটিচ্যুডটাই নাকি সাকিব। হতে পারে গোপাল ভিলেজের 'খেলা হবে' সমাজে কত তামাদি চিন্তাই তো প্রচলিত আছে গভীর বিশ্বাসে।

আমার তো বরং শচীনের ক্রিকেটের ঈশ্বর হয়ে ওঠার পেছনে তার বিনয় ও শিষ্টাচারকেই প্রধান মনে হয়েছে। রাহুল দ্রাবিড়ের স্থিতধী আচরণ তাকে সম্মানিত করেছে। ওয়াসিম আকরাম ও আতাহার আলীর টেম্পারমেন্ট তাদের আজো ক্রিকেটের সাথি করে রেখেছে। আমাদের তরুণ ক্রিকেটার মেহেদী হাসান মিরাজকেই দেখুন; কত সুন্দর মেজাজের ছেলে সে। যে কোন পরিস্থিতিতে মেজাজ না হারানোটাই মনুষ্যত্বের পরীক্ষা; ‘বাপের ব্যাটার’ এটিচুড তো শামীম ওসমান ও নিক্সন চৌধুরীরও আছে; তা কী কখনোই অনুসরণীয় হবার মতো কিছু!

তবে যে দর্শকরা সাকিবকে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে দুয়ো দিয়েছেন; তাদেরকে আমি ফাঁপা ও অকৃতজ্ঞ বলবো। যে সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক গৌরব এনে দিয়েছেন; শক্তিশালী দলের বিপক্ষে চৌকো আর ছক্কা হাঁকিয়ে কত রোমাঞ্চিত করেছেন আমাদের; সেই তিনি এরকম প্রতিক্রিয়া ডিজার্ভ করেন না। এই বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হওয়ায়; আমরা কী ভুলে যাবো সাকিবের সোনালী অতীত! ক্রিকেট প্রেম এতো ঠুনকো হলে কী করে চলে!

১৯৭ পঠিত ... ১৭:০৩, নভেম্বর ০৭, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top