এই যে বস্তাপচা একটা ধারণা যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলে সূর্যাস্ত আইন থাকতে হবে বা রাত দশটার পর হলে প্রবেশ বন্ধ; এগুলো খুবই অমানবিক। মানুষ তো মোরগ-মুরগী নয়, যে বেলা গেলো হাঁস-মুরগী ঘরে তোলো। আমার তো মনে হয় হাঁস-মুরগীকেও সূর্যাস্ত আইনে খোপে আবদ্ধ করার কারণেই তারা অভিমান করে ডিম দিচ্ছে কম। ফলে বিশ্বের সর্বোচ্চ দামে ডিম কিনতে হচ্ছে; আবার ডিপফ্রিজে রেখে তিনমাস পর ডিম খেতে হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর নিজস্ব দায়িত্ববোধের ওপর ভরসা রাখা না গেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া উচিত।
এই যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে; তাদের চিন্তাজগত সম্পর্কে কোন ধারণা না রেখে তাদের ঘাড়ের ওপর কড়া শাসন আরোপ করলে; অত্যন্ত ভুল হবে।
যে ছেলেমেয়েরা কৈশোরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে বাংলাদেশে অবাক সূর্যোদয় ঘটিয়েছে; তাদের বুঝতে পারেনি হীরক রাজার দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিরা।
সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বর্তমান ভিসি তাঁর আউটডেটেড চিন্তার স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু যেহেতু তিনি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পটু; তাই স্থানীয় উন্নয়ন লীগের নেতারা তাঁর ভক্ত। তাই তো জাফর ইকবাল স্যারকে ব্যবহার করে ছাত্রছাত্রীদের অতীতের আন্দোলন পণ্ড করে দিয়েছিলো সরকারি দলের নওফেল ও হাতেমেরা।
এই নওফেল ও হাতেমেরা নিজেরা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে; নিজেদের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে রেখে আসবে পশ্চিমের গোলাপ বাগানে; আর আমাদের দেশের বাচ্চাগুলোকে ভাবছে; তারা হীরার খনির ময়লা শ্রমিক। তাদেরকে বেঁধে দিতে হবে মধ্যযুগীয় চিন্তার শেকলে।
একবার এক কমুনিস্ট শ্রমিকের ছেলে এমেরিকায় স্কলারশিপ পেয়েছিলো। শুনে কমুনিস্ট নেতা রেগে কাঁই। ডেকে বলেন, তোর ছেলে কেন সাম্রাজ্যবাদী দেশে পড়তে যাচ্ছেরে ফজলু! ফজলু একটু সাহস করে বলে, আপনার ছেলেও তো এমেরিকায় পড়ে লিডার। তখন লিডার বলে, তুই আর আমি কী এক হলাম। এইরকম সামন্ত চিন্তা নিয়ে ঘুরে বাংলাদেশের রাজনীতিক, আমলা, ভিসি ও বিদূষক বিচিগুলো।
আজকের যুগের ছেলেমেয়ের জগত অত্যন্ত সুন্দর জগত। বিশেষ করে মেয়েরা পড়ালেখায় অত্যন্ত মনোযোগী। বাংলাদেশের এই ছেলেমেয়েগুলোর মাঝে লুকিয়ে আছে শেক্সপিয়ার, মিল্টন, আইনস্টাইন, মাদাম কুরি, ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভার সম্ভাবনা।
এরা রাজধানীর শারীরবৃত্তীয় চিন্তায় বুঁদ ভাই বেরাদার নয় যে তারা লুকিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে যাবে কিংবা পাপিয়ার আসর মাতাবে।
এরা ইন্টারনেট প্রযুক্তি হাতে পাওয়ায় পৃথিবীর জানালা তাদের সামনে খোলা। এরা সংকীর্ণ চিন্তার হাওরে পদ্ম নয়; এরা বিশ্বনাগরিক। এরা আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে ফোন হাতে নিয়ে সারাক্ষণ "আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ" করছে। কিন্তু এরা আসলে পৃথিবীকে দেখে দুচোখ ভরে।
শাহজালালের ছাত্রীদের যে দায়িত্ববোধ যে আলোকিত মন; তা সরকার দলীয় সংস্কৃতি আপ্পিদের নেই; সরকার ঘন ধর্ম আপ্পিদেরও নেই।
কাজেই নিজেদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, গাড়ি, বাড়ি, পদ-পদবী-পদক-পাপিয়ার খর্ব চিন্তা দিয়ে এই আগামীর নাগরিকদের বুঝতে যাওয়া অন্ধের হাতি দর্শন।
সোশ্যাল মিডিয়া আসার কারণে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়। যেমন কথা হয় আমার নিজের ছেলের সঙ্গে। এদের চিন্তাজগতের সৌন্দর্য্য আমাকে মুগ্ধ করে। এদের চোখে জীবনকে দেখতে শিখি আমরা। আমরা যারা এলিয়েনেশান বা বিচ্ছিন্নতাকে আধুনিকতা ভেবে মায়া-বর্জিত যন্ত্রজীবন বেছে নিয়েছিলাম; আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সাফল্যের পেছনে বুঁদ হয়ে দৌড়েছিলাম; ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে এলিটিজমকে এভারেস্ট ভেবেছিলাম; তাদের এইসব ভুল চিন্তা আনলার্ন করতে শেখায় এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলো।
অনেক সময় একটা লেখা লিখে ভাবি, এ লেখা কী নন্টে-ফন্টেরা বুঝবে! আমাকে অবাক করে দিয়ে তারা যখন বলে, এই লেখাটা ডেস্টোপিয়ান, এই লেখাটার এই জায়গাটা ম্যাজিক রিয়ালিজম, এই লেখাটা একটা দীর্ঘ কবিতার মতো! চিনচিনে সূক্ষ্ম রসগুলো; আমার তির্যক বাক্যের বিটুইন দ্য লাইনস পড়ে যখন বলে, উহ এই জায়গাটা চাবুক!
আমার মনে হয় একী আমার বাবার বন্ধু প্রজন্মের পুনর্জন্ম হলো; ওরা সেই শৈশবে দেখা মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা ইংরেজির অধ্যাপক নরনারায়ণ রায় কাকা কিংবা বাংলার অধ্যাপক অরবিন্দ কাকা অথবা বোটানির অধ্যাপক মালিক মুহাম্মদ সেদ্দাতের সেন্স অফ হিউমার ওদের মাঝে কী করে হলো। আমার ছেলেই যখন ক্যাজুয়ালি দর্শন আলাপ করে; ভ্রম হয় আব্বার সঙ্গে কথা বলছি নাকি ছেলের সঙ্গে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা যখন সমতন্ত্র শিরোনামে মিম প্রদর্শনী করে; যেখানে ওরা ভেঙ্গে দেয় ভি আই পি কালচার, সামন্ততন্ত্রের অচলায়তন; আমি বুঝতে পারি বাংলাদেশ জাগছে।
এই অচল নবরত্ন সভার মিডিওকার রঙ্গভবন থেকে দূরে, ফেসবুকের সহমত-রহমত, শিবব্রত-শরিয়তের বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন