ইতিহাসের পাতায় কৌতূহল জাগানো চিত্রকর মধ্যে সবার উপরে আছে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। সর্বকালের সেরা আর্টিস্টদের মধ্যে একজন হলেও কিন্তু জীবদ্দশায় তাকে প্রায় কেউই চিনতেন না। দারিদ্র্যের কষাঘাতে লড়তে হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত জীবনে।
চলুন জেনে আসি জীবদ্দশায় আন্ডাররেটেড এই চিত্রকরের জীবনের অজানা কিছু জিনিস..
১) তিনি ছাড়াও তার পরিবারে আরও তিনজন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ছিলেন। চিত্রকর ভ্যান গগের নাম রাখা হয়েছে তার বড় ভাইয়ের নামানুসারে যে প্রসবকালীন সময়ই মারা যায়। এদিকে এই বড় ভাইয়ের নাম রাখা হয়েছিলো তাদের দাদার একই নাম অনুসারে।
এদিকে চিত্রকর ভ্যানগগের ছোটো ভাই থিও ভ্যান গগ তার পুত্রের নামও রাখেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
২) জীবনের ২৭ বছর বয়সে এসে ছবি আঁকা শুরু করেন ভ্যান গগ। ছবি আঁকার জন্য কারো কাছে হাতেখড়ি নেননি তিনি। শুরুর দিককার ছবিগুলোতে এতটা রঙ ব্যবহার করতেন না ভ্যান গগ। সমাজের নিদারুণ বাস্তবতা ও কঠিন বিষয়বস্তু উপস্থাপনই ছিল তাঁর আঁকার মূল উদ্দেশ্য। দরিদ্রতা, গরীব জীবনযাপন ভ্যান গগের প্রথম দিককার ছবিগুলোতে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। মূলত নিজের জীবনই তিনি ফুটিয়ে তুলতেন রঙ তুলি দিয়ে। পরবর্তীতে তাঁর ছবিগুলোতে রঙের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। মূলত সেই ছবিগুলোর জন্যই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ভিনসেন্ট।
৩) ভ্যান গগ আরেক চিত্রশিল্পী পল গঁগার সাথে পরিচিত হন ১৮৮৭ সালে। তারা একই সাথে প্রায় সময়ই ছবি আঁকলেও তাদের আঁকার ধরণ ছিলো ভিন্ন।
৪) ভ্যান গগ তাঁর ৩৭ বছরের জীবনে চিঠি লিখেছেন প্রায় ৮০০টির মতো। ঐতিহাসিকবিদেরা সেইসব চিঠিকে ক্রোনোলোজিকাল অর্ডারে সাজিয়ে বের করেছেন ভ্যানগগ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য।
৮০০ চিঠির প্রায় ৬০০ টিই ছিলো চিত্রকর ভ্যানগগ এবং তাঁর বড় ভাই থিও'র মাঝে আদানপ্রদানকৃত!
৫) ভ্যানগগ চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি প্রথম জীবনে বহুপেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার চেষ্টা করেছেন। ভ্যানগগের জীবন আরম্ভ হয় এক ছবির দোকানে। চাকরি বেশীদিন টেকেনি, কারণ ক্রেতার সাথে দুর্ব্যবহার করতেন ভ্যানগগ। কিছুদিন স্কুলে মাস্টারি করলেন, বদমেজাজের জন্য সেই চাকরিও গেল। পাদ্রী হবার চেষ্টা করলেন, ভর্তিও হলেন থিওলজি স্কুলে, কিছুদিন ক্লাস করে ভালো লাগলো না; ছেড়ে দিলেন সেই স্কুল। এরপরে বেলজিয়ামে গেলেন খনি মজুর হয়ে কাজ করতে। এই সময় তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন।
৬) ভ্যানগগের টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির কারণে বাই পোলার পারসোনালিটি ডিজ অর্ডার ছিল। আনন্দ -বিষাদের চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে তার জীবন কেটেছে। বিভিন্ন প্রমাণ থেকে জানা যায় তিনি ডিল্যুশনালও ছিলেন।
৭) ভিনসেন্ট তার জীবনে এঁকেছেন প্রায় ২,১০০টি ছবি এঁকেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ৮৬০টি তৈলচিত্র। বেশিরভাগ ছবির কাজই সম্পন্ন করেছেন নিজের জীবনের শেষ দুই বছরে।
নিজের জীবনের অর্থনৈতিক সমস্যা ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার পরেও ভ্যান গগ শেষ দুই বছরে যত ছবি এঁকেছেন তা অনেক চিত্রকারের পক্ষে সারাজীবন ধরেও আঁকা সম্ভব ছিলো না।
৮) ভ্যান গগ কান কাটার ঘটনাকে ঘিরে অনেক তত্ত্ব রয়েছে। জনপ্রিয় তত্ত্বগুলির মধ্যে একটি হ'ল ভ্যান গগ সহকর্মী পল গোঁগার সাথে লড়াইয়ে নামার পরে তার বাম কানে একটি রেজার নিয়ে আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তারপরে তিনি আংশিকভাবে কাটা কানটি কাগজে জড়িয়ে তা পতিতালয়ে এক মহিলার হাতে পৌঁছে দেন যাকে তিনি এবং গোঁগা উভয়ই ব্যবহার করতেন।
৯) তর্ক সাপেক্ষে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিটি স্ট্যারি নাইট। তবে মজার ব্যাপার হলো এই ছবিটি ভিনসেন্ট এঁকেছেন একটি আশ্রমে বসে। ১৮৮৮ সালে নিজের কান কাটা নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের সেইন্ট রেমি-ডি প্রদেশের এই আশ্রমে আসেন তিনি। বলা হয়ে থাকে ছবিটি ছিল ভ্যান গগের বিছানার পাশের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া রাতের দৃশ্য।
১০) ভিনসেন্টের আঁকা সবচেয়ে দামী ছবিটি হচ্ছে ‘পোরট্রেইট অফ ডক্টর গ্যাচেট’। ১৮৯০ সালে আঁকা এই ছবিটি ঠিক একশ বছর পর ১৯৯০ সালে নিলামে ওঠানো হয়। সেই সময়ে ছবিটি বিক্রয় হয় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে, যেটি কি না পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবিগুলোর মধ্যেও একটি।
১১) জীবদ্দশায় মাত্র একটি ছবিই বিক্রয় করতে পেরেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। 'রেড ভাইনইয়ার্ড' নামের ছবিটিই ভিনসেন্টের নিজ হাতে বিক্রয় করে যাওয়া একমাত্র ছবি। আত্মহত্যা না করে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো নিজ চোখেই নিজের কীর্তির সম্মাননা দেখে যেতে পারতেন তিনি।
১২) ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই ভিনসেন্ট ভ্যান গগ নিজের বুকে নিজেই গুলি করে বসেন। বলা হয়, একটি গম ক্ষেতে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের বুকে গুলি চালান। গুলি করার আগ মুহূর্তে গমের ক্ষেতে বসেই ছবি আঁকছিলেন তিনি। গুলি করার পরেও তিনি পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজ বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখানে তাকে দুজন ডাক্তার দেখভাল শুরু করেন, কিন্তু দুদিন পর ২৯ জুলাই তিনি পরপারে পাড়ি জমান।
ছোটো ভাই থিও ভ্যান গগের ভাষ্যমতে, তাঁর জীবনের শেষ বাক্যটি ছিল ‘লা ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস’, যার ইংরেজিতে অনুবাদ ‘This sadness will last forever’!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন