গরিব শব্দটিকে আমি যত না আর্থিক দারিদ্র্য, তার চেয়ে বেশি মনের দারিদ্র্য হিসেবে দেখি। কারণ নব্বুই সাল পর্যন্ত এতটা মনের দারিদ্র্য আমাদের সমাজে ক্রিয়াশীল ছিল না। যখন জাতি হিসেবে আমাদের টাকা পয়সা কম ছিল।
হঠাৎই বাই ওঠে, টেকা দ্যান দুবাই যামু। বাংলাদেশে সুশাসন নেই; ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভঙ্গুর। তাই অদক্ষ শ্রমিকেরা দাস হয়ে আরব দেশে যায়। আরব দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্ত মহলে তাদের প্রবেশাধিকার নাই। বাইরে থেকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যতটুকু ধারণা করতে পারে; তা নিয়ে রীতিমতো কিং ফয়সল সেজে দেশে ফিরে। যেহেতু হাতে কাঁচা পয়সা; তাই আঙুল নাচিয়ে ইসলাম শেখায় গ্রামের মানুষকে। অথচ সেই কবে আরব বণিক আর তুরস্ক-ইরান-ইরাকের আলোকিত আউলিয়া দার্শনিকের হাত ধরে সাম্যের ইসলাম জনপ্রিয় হয়েছিল; হিন্দু ধর্মের কাস্ট সিস্টেম পর্যুদস্ত জনপদে। যে ইসলাম এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আউলিয়াদের মাজারে অন্যধর্মের মানুষেরাও শ্রদ্ধা জানাতে যেত। তুরস্কের জালালউদ্দিন রুমি থেকে আমির খসরু হয়ে আলাওল-দৌলত কাজীর সাহিত্য কর্মে মুসলিম অ্যানলাইটেনমেন্টের বিশাল জগতে সংযুক্ত হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আরবের টেকাটুকাবাহিত ইসলাম কিং ফয়সলের আয়রন কার্টেনের বিশুষ্ক ও আত্মম্ভরী ইসলামের ঝান্ডা উড়তে শুরু করে বাংলাদেশে। কিং ফয়সলের উত্তর পুরুষ মুহম্মদ বিন সালমান সেই নিষ্ঠুর ইসলামকে আবার এর ভালোবাসা ও কোমলতার ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টারত। কিন্তু বাংলাদেশে কিং ফয়সলের ডামি সেজে ফেরা লোকেদের ছেলে-মেয়েরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ধণুক ভাঙ্গা পণে নেমে পড়ে সহি ইসলাম প্রতিষ্ঠায়। ফেসবুকে তারা গড়ে তোলে হাহা আদিবাসী গ্রুপ।
মানুষের পোশাক আশাক ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও দৈহিক গড়নের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। মুহম্মদ বিন সালমানের দীর্ঘ দেহ, গৌর মুখমণ্ডলে দাড়ি; তার স্ত্রীর আরবীয় মুখাবয়বে যে পোশাক অনিন্দ্য সৌন্দর্য নিয়ে আসে; তা তো দক্ষিণ এশীয় দৈহিক গড়ন, বাদামী মুখমণ্ডলে মানানসই নয়। দক্ষিণ এশিয়ারও অঞ্চলভেদে রয়েছে নিজস্ব পোশাক; যাতে এ এলাকার নারী ও পুরুষকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। কিন্তু ডামি কিং ফয়সলের পুত্র-কন্যাদের তা বোঝাবে কে! তাকে যেনতেন প্রকারেণ মুহম্মদ বিন সালমান আর তার বোন ও স্ত্রীর মতো সাজতে হবে; সেটা দক্ষিণ এশীয় চেহারা ও দৈহিক গড়নে যতই হাস্যকর দেখাক। তার ধারণা এর মাঝ দিয়ে ইসলামি সংস্কৃতির সিলসিলা তৈরি করছে; ইনসাফ কায়েম করছে। কল্পনায় সে কখনও দিল্লি সালতানাত ও মুঘল বাদশাহ, তাকে কাত হয়ে বসে কাওয়ালি শুনতে হবে। হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি মামাদের যন্ত্রণা না জুড়াতেই ইসলামি সংস্কৃতি মামার যন্ত্রণা নিয়ে সে উপস্থিত।
নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে এমন এক হিন্দু ধর্মের চর্চা ছিল; যেখানে বিভিন্ন হিন্দু সাধকের আশ্রমে মুসলমানেরা পর্যন্ত শ্রদ্ধা জানাতে যেত। কিন্তু ভারতের গরিব হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে; তার অভিঘাতে কঠোর হিন্দুত্ববাদ মনোজগতে ঢুকতে চেষ্টা করে। অত্যন্ত বিনয়ী হিন্দু দোকানি, কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলের ছেলে-মেয়েরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজপুত হিন্দুর মতো সেজেগুজে রামকে নিয়ে আসে দেবতা হিসেবে। অষ্টাদশ শতকের জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো পোশাক আশাক পরে; কল্পনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হিন্দু জমিদারদের লেটেস্ট এডিশন হয়ে ঘুরতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হলেও তাকে হিন্দুদের পুজোর ঘরে নিয়ে যায়। নব্য শিক্ষিত ডামি ঠাকুরেরা বাংলাদেশে কালচারের পেডাগগ হয়ে ঘুরতে শুরু করে। আর ভারতের আকাশে মোদির উদয় হলে; বাংলাদেশে লেন্দুপ দর্জিদের বাকশাল টু পয়েন্ট ও হলে; তখন নিও কালচারাল হিন্দু সমাজ ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদিবাসী গ্রুপ তৈরি করে; একে ওকে ছাগু ডেকে সুপিরিওরিটি জানান দিতে থাকে। এইভাবে একসময় তারা ভুলেই যায় তাদের প্রপিতামহ নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরত; দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো স্টিমারের মালিক ছিল না। বাংলাদেশের গ্রামের হিন্দু জমিদারের নাতি-নাতনি কলকাতার সেকেন্ড হোমে ইংরেজি শিখে, রাজপুত কল্পনায় দ্য লস্ট হাভেলিজ অফ বাংলাদেশ লিখে ফেললে; আভিজাত্যের কষ্টকল্পনায় জয় শ্রীরাম স্লোগান ওঠে। কার্যত হিন্দুত্ববাদী হলেও ঢাকায় তারা প্রগতিশীলতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে পড়ে।
একটু কষ্ট করে পড়ালেখা করে পাকিস্তান আমলেই যারা সরকারি ও সওদাগরি চাকরিতে কেরানি হয়ে পড়েছিল; তাদের ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি একটু ইংলিশ ভিংলিশ শিখে, আই লাভ নিউইয়র্ক লেখাটি শার্ট পরে ঘুরে; কয়টা ইংলিশ মুভি দেখে ও গান শুনে; ঢাকা শহরে গরিবের ম্যানহাট্টান গড়ে তোলে। দাদা কড়া মুসলমান হওয়ায় বিরক্ত হয়ে রিচার্ড ডকিন্স হয়ে পড়ে তারা। ঈশ্বর আছে কি নাই তা ক্যালকুলাস দিয়ে প্রমাণ করে দেয়। অল্প কয়টা ইংরেজি বই পড়ে তা বদ হজম হওয়ায় মুসলমানদের নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে। কোত্থেকে যে ধারণা পেয়েছে, ইসলামোফোবিয়া লিবেরেলিজমের পূর্ব শর্ত। কেউ নিজের দাদাকে নিয়ে হাসলে তাতে আমাদের কী! পৃথিবীর আর কোনো শহরে ঢাকার মতো এলিট হবার দুর্মর স্বপ্ন নাই। বাংলাকে ইংরেজির মতো বলে, বলসে খাইসে; ভাল্লাগতেসে না বোড় লাগতেসে বলে; কফি ওয়ার্ল্ডে বসে এমেরিকানোতে চুমুক দিয়ে আনাহিতা ও সঈফ এমন ভাব ধরে এজ ইফ তারা কারিনা ও সাইফ আলী খান। আনাহিতা ও সঈফ ড্রাইভার, মালি, দারোয়ান, গৃহকর্মীর সঙ্গে যেরকম রেসিস্ট আচরণ করে; এত রেসিস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নয়।
এর ফলে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে আমরা যে সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি, জুলাই বিপ্লবে যে ঐক্যবদ্ধ বৈষম্যমুক্ত সমাজের আশা করেছিলাম, নানা ধর্ম গোত্রের মানুষের যে সভ্য সহাবস্থান কল্পনা করি; তা সুদূর পরাহত হয়ে রয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বশিক্ষিত প্রান্তিক মানুষ আমাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সবসময় সচেষ্ট। কিন্তু এই যে নতুন শিক্ষিত ডামি কিং ফয়সল, ঠাকুর আর ডকিন্স; ঢাকা শহরে বসে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সজাত যে সুপিরিয়রিটির বয়ানে বিদ্বেষ ও বিভাজনের ছক কষে; সেই আর্য কল্পনার ম্যাগালোম্যানিয়া থেকে মুক্তি পাব কী করে আমরা। টাকা পয়সা হলে পকেটের দারিদ্র্য নিরসন হয়; কিন্তু মনের দারিদ্র্য দূর হবে কী করে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন