লেখা: অনিক রায়
মাহফুজ আলমের আলাপ ভালো। সাহিত্য লিখার ব্যাপারে যে তার মুন্সীয়ানা আছে তার বহিঃপ্রকাশও সে তার শেষ স্ট্যাটাসে দিয়েছেন। কিন্তু কিছু খুচড়া আলাপ আমার মাথায় আসলো। জানি না, সে এই পোস্ট দেখবে কিনা।
তিনি বলছেন, ফ্যাসিবাদের পুনরুজ্জীবন ও জুলাই বিরোধী শক্তি সক্রিয় হচ্ছে। একদম সত্যি। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদ পুনরুজ্জীবন পাচ্ছে কীভাবে। কারা ৫ আগস্টের পর থেকে বার বার ঐক্য নষ্ট করার মুভ দিল। তা কি মাহফুজ আলম জানেন না। তিনি তো খুব ভালো করে জানেন আন্দোলনে কোন কোন শক্তি যুক্ত ছিল। তারা কীভাবে এই আন্দোলনকে শেপ দেওয়ার ক্ষেত্রে মুভ করেছে। তাহলে, তিনি তো জানেন ৫ আগস্টের পর এই আন্দোলনের শক্তিগুলো কী করেছে। কার কী ভূমিকা বর্তমান সময়ে। তাহলে তিনি তা স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না কেন? তিনি তো নিশ্চয়ই জানেন, কারা রিকনসিলন করতে প্রস্তুত ছিল। আর কারা আবারও কবর থেকে মৃত লাশ তুলে এনে পুরাতন ভাবাদর্শিক রাজনীতিকে হাওয়া দিয়েছে। তিনি তো জানেন শাপলা-শাহবাগ রাজনৈতিক রেটোরিক কারা লম্বা সময় ধরে ভাঙতে চেয়েছে। কিন্তু এই যে তার স্পষ্ট করে বলতে না পারা, এটা আমার কাছে দুর্বলতা। এখানেও এক প্রকার মাঝামাঝি থেকে দুইপক্ষকে একটু বকে দেওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান। এটাকে আমি তার ক্ষমতায় থাকার সীমাবদ্ধতা হিসেবেই মনে করি।
এবার আসুন অন্য আলাপে আসি। সরকারকে আসলেই শুরুতে টাফ সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করতে হয়েছে। একের পর এক আন্দোলন। কোনটা ন্যায্য দাবির আন্দোলন আর কোনটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে বুঝে ওঠা কঠিন ছিল। এই সরকার সার্ভাইব করতে পারবে কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিল। এই সংশয় দূর হয়েছে। এটাতেও সরকারের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। সকল রাজনৈতিক দলসহ সকল বর্গের মানুষ এই সরকারকে সেই সংশয় থেকে রক্ষা করে দিয়েছে। তাদের লেজিটিমিসি দিয়ে। এটা তো মাহফুজ আলমের স্বীকার করা উচিত।
এরপর আসেন অর্থনীতির কথায়। তিনি বলছেন, খাদের কিনার থেকে অর্থনীতি রক্ষা করার কথা। আমি যতটুকু বুঝি এটা খুবই গড়পড়তা আলাপ হয়ে গেছে। বর্তমানে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি চৌদ্দের উপরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বারোর কাছাকাছি। এই অবস্থায় সরকারের একটি মুভও মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর কাজে লাগেনি। মূল্যস্ফীতি শুধুই বাড়ছে। শুরু থেকেই সরকার বলেছে, সে আর টাকা ছাপাবে না। মূল্যস্ফীতির সময় আরও টাকা ছাপালে নরমালই টাকার তারল্য মান কমে যায়। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ে। সেখানে এই সরকার ২২ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ছাপিয়েছে। শেখ হাসিনাও এই কাজ করেছিলেন। ফলে, এটা সামনের দিনে আরও মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।
মূল্যস্ফীতির ছাপে এমনিতেই মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের অপশন নাই। নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসার খরচ তুলতে হাসফাস অবস্থা। সেখানে, সরকারের রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতা ডাকতে পরোক্ষ কর বাড়িয়ে দিল। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাই এমন এখানে কয়েকটি জিনিসের দাম বাড়া মানে সবকিছুরই দাম বেড়ে যাওয়া। চালের দাম বর্তমানে কত তা কি জানেন উপদেষ্টা। দেশের মানুষের আয় কত সেটার পরিসংখ্যান আছে আপনার কাছে। আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য আপনারা কি তৈরি করতে পেরেছেন। তা কিন্তু পারেন নাই। বা সেই রাস্তায় আপনাদের হাঁটতে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাহলে কি এই গণঅভ্যুত্থানের সরকার সেই পুরাতন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই থাকতে চায়। শেখ হাসিনার মডেলেই বিদেশী শর্তযুক্ত ঋণ নিয়ে থাকতে চায়। সরকার তো ধনীদের উপর আয়কর বাড়ালো না। কিন্তু গরিবের পকেট কাটার ব্যবস্থা করল। মানে, ধনী আরও ধনী হবে। গরিব আরও শুকিয়ে মরবে। এটা তো পুরাতন মডেল। নতুন বন্দোবস্তের নজির কই।
এরপর আসেন, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি বলতে তিনি নিশ্চয়ই ভারতকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু আসলে সরকার কি এমন করেছে? বুক চিতিয়ে লড়াই করার কথা বলেছেন। আপনি আমাদের মন্ত্রী, বুক চিতিয়ে লড়াই এসব যুদ্ধের ময়দানের সাহিত্যে শুনতে ভালো লাগে। রাজনীতিতে না। আপনাদের কাজ ছিল বুদ্ধি দিয়ে লড়াই করার। ভারত বিরোধীতার আলাপ দিচ্ছেন। ভারতের সাথে সকল অন্যায্য এবং অসম চুক্তি কেন সরকার ওপেন করছে না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একটা অসম ডিল এখনও কেন এই সরকার মাথা পেতে নিচ্ছে। ভারতের সাথে নদীর পানির হিস্যার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কি? ভারত বিরোধীতার রাজনৈতিক উন্মাদনা মানুষকে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে আমি ভারত কীভাবে ডিল করব তা নিয়ে কেন আলাপ নাই।
এবার আসেন, জুলাই শহিদ ও আহতদের নিয়ে সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে বলে আপনি জানিয়েছেন। তা ছয় মাস কেটে যাওয়ার পরও কেন এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শহিদদের লিস্ট করা সম্ভব হলো না। সরকারি হিসেবে শহীদ কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৮৫৮ জন। কেন আহতদের জন্য একটা টোটাল সিস্টেম এখন পর্যন্ত বানানো হলো না। কেন একজন আহত বা শহিদের পরিবারের দরজায় দরজায় ঘুরতে হচ্ছে সাহায্যের জন্য। আমিই এমন লোককে চিনি যার ভাই ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে শহীদ হয়েছে। কিন্তু সেইদিন হাসপাতালে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার কেউ ছিল না। তাই তারা নিজের মতো সেইদিন কবর দিয়ে দিয়েছেন নিজের ভাইকে। কিন্তু আন্দোলনের ছয় মাসেও কেন এখন পর্যন্ত এরকম যত মানুষ ডেথ সার্টিফিকেট পায় নাই তাদের জন্য একটি নীতিমালা সরকার তৈরি করতে পারল না।
এই সরকারের আমলে যতগুলো মাজারে হামলা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সে পরিমাণ হামলা কোনোদিন হয় নাই। সরকারের এখানে ভূমিকা কী। কয়জনকে গ্রেফতার করলেন আপনারা। শেখ হাসিনার আমলে মানুষ বিরক্ত ছিল সিন্ডিকেট নিয়ে। একটা সিন্ডিকেটের গায়ে হালকা আচড়ও কি দিতে পেরেছেন আপনারা। এসব ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের লোকজনের নাম মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু সরকার তাদের খুঁজে পায় না। যে টাকা পাচার হয়েছে তা ফিরিয়ে আনার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ কি সরকার নিয়েছে৷
স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির নামে একটি উগ্র জাতীয়বাদী গ্রুপ রাস্তায় এভাবে দিনে দুপুরে মানুষকে মারল। কিন্তু সেই হামলার দুইজন চুনোপুটি ধরে সরকার ক্ষান্ত হয়েছে। বাকিদের কোনো খবর নাই। সেই গ্রুপের নেতারা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরকম তো আমরা হাসিনা আমলেই দেখেছি। তাহলে আপনাদের সরকার ভিন্ন হলো আসলে কোথায়। আপনি তো দুইদিন আগেই ক্যাম্পাসে ছিলেন। তো ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থী, পথচারী, সাংবাদিকদের আপনাদের পুলিশ পেটাল। কি ব্যবস্থা নিয়েছেন আপনারা। এখন বইলেন না সরকার আপনাদের কিন্তু পুলিশ শেখ হাসিনার।
এই গণআন্দোলনে ১১৩ জন শ্রমিক মারা গিয়েছে। তো আপনাদের সরকারও শ্রমিক হত্যা করেছে। বেতন নাই শ্রমিকের, তো সে রাস্তায় নামবে না তো যাবে কই। শেখ হাসিনা গুলি চালাত, আপনার সরকারও চালিয়েছে। তো এই হত্যার কোনো বিচার আপনারা করেছেন। বিচার বাদ দেন, মুখে কোনোদিন অ্যাড্রেস করেছেন। কিছুই তো করেন নাই।
ফলে,মানুষের দিকে আঙুল দিয়ে জুলাই ঐক্য নষ্টের অভিযোগ তুইলেন না। নিজেদের দিকে তাকান। আপনাদের সরকার পরিচালনা করার পদ্ধতি আর শেখ হাসিনার পদ্ধতির মধ্যে মোটাদাগে কোনো পার্থক্য আছে কিনা সেটা মাপেন।
সাহিত্যে আপনার মুন্সীয়ানার কথা আগেই আমি স্বীকার করেছি। কিন্তু আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন রাজনীতি করার। সাহিত্য করতে চাইলে সেটা সরকার থেকে নেমে এসে করুন। সরকারে থেকে সাহিত্য করে কিছুদিনের জন্য মানুষের সামনে ভ্রম হাজির করা যাবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে না। কারণ এই সাহিত্যিক উন্মাদনা দিয়ে ভাত কাপড় নিশ্চিত হয় না৷
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন