বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর কেটে গেছে ৬ মাস। শেষ ছয় মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শেখ হাসিনা পালায় না বলতে বলতে পালিয়ে গেছে, হেলমেট শিয়ালের দল গর্তে ঢুকেছে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ভ্যাটের পরিমাণ বেড়েছেসহ আরও অনেককিছু। আমরাও ফেরত এসেছি আমাদের স্বাভাবিক জীবনে। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি একদল মানুষ। নিহত এবং আহতদের পরিবার। আর কোনোদিনই তারা ছয় মাসে আগের সোনালী দুপুরে ফেরত যেতে পারবে না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের কোনো বিস্তৃত তালিকা নেই৷ ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট কতজন প্রাণ হারিয়েছেন এ নিয়ে কোনো তালিকাই অর্জন করতে পারেনি শতভাগ আস্থা। দিন যত গড়াচ্ছে, সঠিক বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহের দানা বাসা বাঁধছে পরিবারগুলোর মনে।
গত ১৫ জানুয়ারি দ্য টেক গ্লোবাল ইন্সটিটিউট, ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রোজেক্ট এবং আউটসাইডার মুভি কোম্পানি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ সেখানে উঠে আসে কেবল ১৯ জুলাইতেই নিহত হয়েছে ১৪৮ জন মানুষ! সেই সাথে তারা প্রকাশ করেছে ৫ আগস্টের দুটো অনুসন্ধানী ফুটেজও।
প্রতিবেদন: ব্লাডশেড ইন বাংলাদেশ
এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র একটি দিন—১৯ জুলাইয়ের প্রতিবিম্ব এনেছে। রক্তে ভেজা পা আর পরিবারের করুণ আর্তি, সন্তানকে খুঁজতে মর্গে যাওয়ার দৃশ্যগুলোর কথা ভাবলে এখনও চোখে পানি আসে। সরকার পতন এবং অভ্যুত্থানের সময়টাতে আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে মাঠে নেমেছিলাম। অনেক পরিবার এবং প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার আমাদের কাছে আছে।
যৌথ এই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতদের সবাই বিক্ষোভের অংশও ছিলেন না। কিছু মানুষ ছিলেন কেবল চলমান ঘটনা দেখছিলেন, কেউ কাজ করতেন আশেপাশেই, আবার কেউ হয়তো রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বিক্ষোভের দিনগুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা ৮০০-১৫০০ এর মতো। এ সংখ্যা ছয় মাস পেরোলেও নির্দিষ্ট করে এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিবেদনটি নিশ্চিত করে ১৯ জুলাই মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৮, যা শুরুতে বলা মৃতের সংখ্যার ৩ গুণ! ১৪৮টি হত্যার ভেতর ৪০ জনের বয়সই ছিল ১৮ বছরের কম। একটি রাষ্ট্র কতটা নির্দয় হলে শিশুদের উপর গুলি চালাতেও তাদের বুক কাঁপে না? ভেবেছেন কি? তবে আরও বিস্ময়কর হলো, সেদিন ৫৪ জনকে গুলি করা হয়েছিল মাথা এবং গলায়। নিশ্চয়ই তারা মৃত্যু নিশ্চিত করতেই সেদিন নেমেছিল।
যাত্রাবাড়িতে কী হয়েছিল?
এই ঘটনাটি সংগঠিত হয় ঢাকা শহরের দক্ষিণ পূর্বে। দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এ ঘটনার সময়কাল—স্বৈরশাসকের শেষ দিন, ৫ আগস্ট, ২০২৪। দেশের ভেতরের এবং বাইরের মাল্টিডিসিপ্লিনারি দলের অনুসন্ধানের ফল এই ডকুমেন্টারি। এ ঘটনার ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষা করে টেক গ্লোবাল ইন্সটিটিউট, তবে এরকম ঘটনা একই সময় ঘটছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এই ঘটনা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া অসংখ্য প্রাণহানির একটি উদাহরণ মাত্র, যা একই ধরনের ফরেনসিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দুপুর ১টা ৫৬ মিনিট থেকে বিকাল ৩টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার বাইরে আসলে কতজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছিলেন, তাদের পরিচয় কী আমরা এখনও জানি না। এই গুলিবর্ষণের জন্য কোন পুলিশ কর্মকর্তারা দায়ী এবং কার নির্দেশে পুলিশ এভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিল—এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।
এই অনুসন্ধানে বিক্ষোভকারীদের হত্যা সংক্রান্ত ১৯টি মূল ভিডিও পাওয়া গেছে যেগুলো প্রত্যক্ষদর্শী দ্বারা ধারণকৃত। এ ছাড়াও রয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য ভিডিও ফুটেজ।
হত্যার সাক্ষী কোনাবাড়ি
এই ঘটনার সংঘটন স্থল গাজীপুরের কোনাবাড়ি, শরীফ জেনারেল হাসপাতালের বাইরে।
ভিডিওটি শুরু হয় কোনাবাড়ি থানার বাইরে বিক্ষোভের দৃশ্য দিয়ে। বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে উল্লাসে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। তারা একটি পুলিশ গাড়ি উল্টে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পরপরই থানার ভেতর থেকে পুলিশ বের হয়ে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বিক্ষোভকারীরা তখন পালিয়ে যায়।
২০ মিনিট পর ফুটেজে দেখা যায় পুলিশ এক যুবককে ধরে ফেলেছে। তার নাম আমরা পরবর্তীতে জানতে পারি। ২০ বছর বয়সী এই ছেলেটির নাম হৃদয়, পড়ালেখার অর্থ যোগান দেবার জন্য চালাতেন অটোরিকশা। সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের একটি দলের মধ্যে কয়েকজন হেলমেট পরা পুলিশ হৃদয়কে মারধর করে এবং খুব কাছ থেকে তার পিঠে গুলি করে। পুলিশ চলে যায়, কিন্তু ফুটেজে দেখা যায় হৃদয়ের শরীরে তখনও প্রাণটি রয়ে গেছে। ধীরে নড়ছেন হৃদয়। কী করুণ এই দৃশ্য!
৩০ সেকেন্ড পর পুলিশ ফিরে আসে। হৃদয়ের দেহটি হাসপাতালের পাশ দিয়ে টেনে নিয়ে যায় কোনাবাড়ি থানার দিকে। টানার পথে মাটি ভিজে যায় রক্তে। এরপর থেকে মোহাম্মদ হৃদয়কে আর দেখা যায়নি। তার পরিবার তার মরদেহ ফেরত চেয়ে আবেদন করেছে, কিন্তু পুলিশের ভাষ্যমতে তারা কিছুই জানেন না। ফলে মোহাম্মদ হৃদয়ের নাম অন্তর্ভুক্তও হয়নি শহীদের তালিকায়। শহীদ হয়েও যিনি শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাননি তিনি হলেন মোহাম্মদ হৃদয়। তবে মাটি যদি কথা বলতে পারত, কোনাবাড়ির থানার মাটিরা নিশ্চয়ই কথা বলে উঠত, হৃদয়ের স্বপক্ষের শক্তি হতো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন