২০২৪-এর জুলাই ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান সুনির্দিষ্ট কোনো নেতৃত্বহীন জন উত্থান। এর কারণ আস্থা রাখার মতো কোনো নেতার জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি। আর আস্থা রাখার মতো নেতাদের নেতৃত্বে ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০ সালে জনগণ জীবন দিয়ে দেখেছে; প্রতিটি পরিবর্তনের সুফল নেতার দলীয় লোকেরা ভোগ করে। জনগণের জীবনে সেসব পরিবর্তন অনুদিত হয় না।
২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীরা নির্দলীয় কণ্ঠস্বর হিসেবেই জন আস্থা জিতেছিল। রংপুরে আবু সাঈদের বুক চেতিয়ে দাঁড়ানো; আর তাতে ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনার পুলিশের গুলি; বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শহীদ নেতৃত্ব হাজির করে। একে একে শহীদ তরুণেরাই এ আন্দোলনের নেতা হতে শুরু করে। তাই ভীষণ বদ অভ্যাসে জুলাই অভ্যুত্থানের জীবিত নেতৃত্বের কৃতিত্ব দাবিদারের কোনো দাবিই টেকে না।
আমাদের মিডিয়াগুলো হাসিনার ইতিহাস রচনার রোগে আক্রান্ত। দেড় দশক ধরে মনগড়া ইতিহাস লিখে তাদের এমন অভ্যাস হয়েছে যে, এই অভ্যুত্থানের একজন মাস্টারমাইন্ড খুঁজে বের করে। এতে প্রভাবিত হয়ে ড. ইউনূস একজন বিস্ময়বালককে ব্রেন বিহাইন্ড দ্য মুভমেন্ট বলে পরিচয় করিয়ে দেন। অথচ তিনি খেয়াল করেননি, শহীদেরাই মাস্টারমাইন্ড, তারাই হার্ট অ্যান্ড সোল অফ দ্য মুভমেন্ট।
সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানের মৃতদেহের ডাকে পথে নেমেছেন; বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য হচ্ছে, তারা সাধারণ মানুষকে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছে। এর আগে দেড় দশক ধরে ডান-বাম-মধ্য কোনো রাজনৈতিক বলয়ের ডাকেই সাধারণ মানুষ পথে নামেনি। কারণ স্বাধীন দেশে এদের কেউই জন আস্থা জিততে পারেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনমানুষ ঢাকা দখল করলে; সেনা প্রধান ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনাকে সেফ এক্সিট দিয়ে; রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকে ডাকেন পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে। এই জায়গাটিতেও তিনি ট্র্যাডিশন অবলম্বন করেছেন, যে ট্র্যাডিশন ঐ মুহূর্তে অচল ছিল। হাসিনার পতনে যাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই; তাদের বয়স বেশি বলেই আর একটি পার্টি সাইনবোর্ড রয়েছে বলেই ডেকে বৈঠক করায়; বৈঠকে উপস্থিত জামায়াত নেতা আনন্দের আতিশয্যে অনভিপ্রেত দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বিতরণ শুরু করেন। বিএনপি নেতা যেহেতু মনে করেন, নব্বই-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ পালা করে বাংলাদেশ শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী পেয়েছে; তাই তারা নির্বাচন দিন, আমাদের ক্ষমতা আমাদের বুঝিয়ে দিন, তোতাপাখির মতো এ কথা বলতে শুরু করেন। সেনা প্রধানের খুব সম্ভব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের খুঁজে পেতে খানিকটা দেরি হয়েছিল; এই ফাঁকে অচলায়তন প্রজন্মের লোকেদের তালিকা তৈরি হয়; যারা দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না বলে সব যুগেই একটি নিরাপদ জীবন যাপন করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রছাত্রীদের দাবিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টার মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি একটি রক্ষণাত্মক ফুটবল টিম নিয়ে পতিত আওয়ামীলীগের প্রতিবিপ্লব, উত্থিত তৌহিদি জনতার বুনো উল্লাস সামলাতে থাকেন। সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে আন্তরিক ভূমিকা রাখে।
হাসিনা পালিয়ে গিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ায় বাংলাদেশে ছায়া উপনিবেশের ক্ষমতা হারিয়ে পাগলপারা হয়ে যায় মোদির প্রশাসন, গদি মিডিয়া কমনসেন্স বিসর্জন করে শতমুখে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকে। মিডিয়া কানেক্টিভিটির যুগ হওয়ায়, পশ্চিমা মিডিয়া ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের অন্তঃশক্তি টের পায়। ফলে বাংলাদেশ ইকোনোমিস্টের কান্ট্রি অফ দ্য ইয়ারের সম্মান লাভ করে।
আওয়ামীলীগের রাজনীতি হচ্ছে প্রতিপক্ষকে গান্ধা কইরা দেওয়ার কলাকৈবল্য। এত বছর যারা বিএনপি-জামায়াতকে গান্ধা কইরা দিতে ব্যস্ত ছিল; তারা এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রছাত্রীদের গান্ধা কইরা দিতে পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে বিভিন্ন দলের বুড়ো ভামেরাও যোগ দেয় সেই তারুণ্যের চরিত্র হননে ও তাদের অজনপ্রিয় করে তুলতে। মুশকিলের ব্যাপার হচ্ছে দেড় দশকে আওয়ামীলীগ যে ফ্যাসিজমের ভাষারীতি, হিংস্রতা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা রেখে গেছে; তাতে সবাই ফ্যাসিস্টের ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অসম সাহসিকতার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে কথা বলেন। সমাজের অল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবী যারা আওয়ামীলীগের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি; তারা সবাই ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে অবস্থান নেন। যেমন অবস্থান নেন অনাম্নী অভিভাবক, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, মানবতা বোধ সম্পন্ন প্রতিটি মানুষ। কিন্তু প্রথম আলো যেহেতু নিজেকে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, লাইফ স্টাইলের শিক্ষক ভেবে স্বপ্রণোদিত দায়িত্ব পালন করে, বৃটিশ আমলের কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর লোকেদের মতো; তারা জুলাইয়ের ঐক্য সুতোটি ছিঁড়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ ন্যারেটিভ তৈরি করে। বাঙ্গালির যে বিশেষণ প্রিয়তা, প্রথম, প্রধান, শ্রেষ্ঠ, সেরা; ঐ বদ অভ্যাসে প্রথম আলো লেখাতে শুরু করে জুলাইয়ের ইতিহাস, আর সেখানে প্রথম কে হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেছিল!
যে মানুষেরা হাসিনার ক্রসফায়ারে মরেছিল, তাদের সন্তান যে বলেছিল, আব্বু তুমি কি কান্না করতেছ! হাসিনার খুনে সৈনিকদের হাতে যারা গুম হয়েছিল, আয়নাঘরে বন্দী হয়েছিল, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের শেকলে জর্জরিত হয়েছিল, প্রাণ ভয়ে বেছে নিয়েছিল নির্বাসন দণ্ড, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল যারা; তারা প্রত্যেকে হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছিল। কেবল আওয়ামীলীগের খেয়ে চর্বি বাড়ানো বিদূষক, দেশ ডাকাতির বেনিফিশিয়ারি ছাড়া সবাই হাসিনার পতন চেয়েছিল।
জুলাইকে যারা অভ্যুত্থানের লক্ষ্মণরেখা এঁকে দিতে চায়; ব্যাকরণ বই খুলে মিলিয়ে দেখে বলে, না এটি কোনোভাবেই বিপ্লব নয়; তারা খুব সম্ভব প্রজন্মের চিন্তার প্যারাডাইম শিফট সম্পর্কে সচেতন নন। রাজনৈতিক সংগঠনের বড় নেতাদের মতো তাদের বৃটিশ হিন্দু জমিদার আর পাকিস্তানি মুসলিম জমিদারদের পোষাক পরা বৃদ্ধ চিন্তার তরুণ কর্মীরা; নতুন বাংলাদেশ উদয়ের তারুণ্যের বিপ্লবী মনোজগত সম্পর্কে এতটুকু অবগত নন। দৈব চয়নে ক্ষমতার কাঠামোর আশেপাশে এসে পড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের বাইরে যে বিপুল তারুণ্য তারা ওল্ড প্যারাডাইমের পলিটিকস, কথামালা, ন্যারেটিভের অচলায়নকে প্রত্যাখান করেছে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে। কাজেই যেসব ক্লিশে চিন্তা নিয়ে রাজনীতির পুরোনো খেলোয়াড় ও মিডিয়ার ন্যারেটিভ দাদুরা ডিভাইড অ্যান্ড রুলের বিষ ছড়াচ্ছেন; দিনশেষে তা বহু ব্যবহারে জীর্ণ কথা মালার জমা-খরচ; যাতে কোনো সঞ্চয় নেই; আছে প্রত্যাখানের গ্লানি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন