অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জরুরি সংস্কার কার্যক্রমের একটি প্রশাসনিক সংস্কার। এই সংস্কারের কথা উঠতেই প্রশাসনিক সার্ভিসের লোকেরা বিদ্রোহ করেছেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিপ্লবী ভাষণ দিচ্ছেন, আমরাই সবচেয়ে মেধাবী, আমরাই শ্রেষ্ঠ। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশ ও জনস্বার্থে বিপ্লবের উত্তুঙ্গ সময়ে প্রশাসনের কর্মচারিদের মাঝে এই বিপ্লব অনুপস্থিত ছিল। বরং তারা ফ্যাসিজমের খুনে বাহিনীর অংশ ছিল।
প্রশাসনিক সার্ভিসের লোকেরা দাবি করছেন, তারা মেধাবী ও শ্রেষ্ঠ। আপাতত ধরে নিচ্ছি তারা মেধাবী; এই মেধা ৫৩ বছরের বাংলাদেশের ঠিক কোন উপকারে এসেছে! বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা ক্ষমতায় এসেছেন; ক্ষমতা থেকে চলে গেছেন। কিন্তু প্রশাসনিক সার্ভিসের লোকেরা রয়ে গেছেন ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে। অন্যান্য দেশে নাগরিকেরা সরকারি দপ্তরে সেবা নিতে যান। তাদের গুরুত্ব দিয়ে সুন্দরভাবে সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি দপ্তর হচ্ছে বাঘের খাঁচার মতো। সেখানে বাঘ মহোদয় বসে থাকেন গম্ভীর হয়ে, স্যার ডাক শোনার আকুতি নিয়ে। এই বাঘের অধীনে থাকে শৃগাল ছোটো ছোটো কেরানিরা; তাদের ধমকে, বিরক্তি প্রকাশে, নাগরিক ক্রমে ক্রমে প্রজায় পরিণত হয়। ঘুষ বা স্পিড মানি না দিলে প্রজাকে টেবিলে টেবিলে পিং পং বলের মতো ঘোরায় শৃগালেরা। আপনার এই কাগজ নাই, ঐটা নিয়া আসেন চলতে থাকে। সরকারি অফিসে ধর্ণা দিতে দিতে প্রজা অভিশপ্ত এক অভিজ্ঞতার ফাঁদে পড়ে যায়। সেখানে বাঘ মহোদয়ের কক্ষে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। অথচ সাধারণের সেবক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে বড় লাটের ভঙ্গিতে গিয়ে গাড়িতে ওঠে। কোনো প্রজা কোনো অভিযোগ জানাতে চাইলে, এমনভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকায় যে সাক্ষাত বৃটিশ কুইনের নাতি সে। উল্লেখ্য বৃটিশ কুইনের নাতিরাও অত্যন্ত বিনয়ী ও কার্টিয়াস।
বিসিএস গাইড মুখস্থ করে অফিসার হয়েই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা স্যার হয়ে যায়। প্রজাদের কেউ স্যার না ডাকলেই তাকে চড়-থাপ্পড় কিংবা ধাক্কা দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এই বাংলাদেশে। বৃটিশ ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে সুপিরিয়র সার্ভিসের পরীক্ষার ফলাফলের পাশাপাশি; কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠা রয়েছে, মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড পূরণ হয়েছে; ক্ষমতা দেখানো উদগ্র বাসনা নেই এমন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হতো। সেখান থেকে ড আকবর আলী খান, মোফাজ্জল করিম, মারগুব মোর্শেদ, হাসনাত আব্দুল হাই, মঞ্জুর এ মওলা, সাদাত হোসাইনের মতো গুণী মানুষেরা বেরিয়ে এসেছিলেন। তারা এক একটি গ্রন্থাগারের মতো মানুষ। তাদের সঙ্গে দেখা হলে কিছু একটা নতুন বিষয় শেখার সুযোগ অবারিত ছিল।
তবু ঐ প্রজন্মের ব্যাপারে অভিযোগ ছিল যে, এরা অহংকারী। কিন্তু ফাঁপা অহংকার কত প্রকার ও কী কী, মানুষ কতটা কর্কশ হতে পারে; বাংলাদেশের মানুষ তা জানতে পেরেছে; বিসিএস গাইড বুক আর করুণ চেহারা সম্বলিতদের সিভিল প্রশাসনে নিয়োগ দেবার পর।
মোফাজ্জল করিমেরা যখন ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ও বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন; তখন তারা যে জনপদে গেছেন, সেখানকার শিক্ষকদের সম্মান জানিয়েছেন, সংস্কৃতিকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার চেষ্টা করেছেন; আর দিনরাত নাগরিকের অভিযোগের কথা শুনেছেন, রাষ্ট্রের সীমিত সামর্থ্যের মাঝে তাদের সমস্যার সমাধান দিতে চেষ্টা করেছেন। এরকম মানুষেরা সপরিবারে প্রতিটি জনপদে বসবাস করেছেন। তাদের ছেলে-মেয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে সরকারি স্কুলে পড়েছেন। ফলে কম্যুনিটির প্রতি সমানুভূতি জন্মেছে।
কিন্তু বিসিএস-এর নিও এলিট কর্মকর্তাদের প্রত্যেককেই প্রায় পোস্টিং-এর জায়গায় ও ঢাকা শহরে দুটো হাউজহোল্ড মেইনটেইন করতে হয়। ঢাকা শহরে বিসিএস জামাই ফিশিং করার জন্য অনেক মতস্য শিকারী আছে। তাদের ঢাকা শহরের সীমিত জলে সীমাবদ্ধ সবুজে বড় হওয়া মেয়েগুলো ইউএনও ও ডিসি ভাবি হিসেবে গরম মেজাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কৈশরকাল থেকে। তারা সবাই ডেনমার্কের রাণীর নাতনি তো, তাই কোপেনহেগেন বা ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতে পারে না। আর বাচ্চাকে সরকারি স্কুলে পড়ালে তাদের আত্মশ্লাঘায় লাগে; তাই তাদের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে গড়ে তুলতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে হয়। এদের অন্য বোনগুলো জামাই ফিশিং করে এমেরিকা ও ক্যানাডায় চলে গেছে। তাই সামান্য বেতনের সরকারি হাবির কাছে সেকেন্ড হোমের আবদার জুড়ে দেয়।
বাংলাদেশের দুর্নীতি বিপ্লবের সূতিকাগার প্রশাসনিক সার্ভিস। এখান থেকে সেকেন্ড হোমের জন্ম হয়। আর নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা; যারা পাবলিক বাসে ভিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে টিউশনি করতে যেত; তারা অফিসার হলেই বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশে সবচেয়ে দামি গাড়িটা প্রয়োজন হয়। অথচ যে বৃটিশ কলোনিয়াল সিভিল সার্ভিসের রেফারেন্স দিয়ে এরা সুপিরিয়র সার্ভিসের সুপিরিয়রিটি প্রকাশ করে; সেই বৃটেনে কর্মকর্তাদের খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত গাড়ি দেওয়া হয়। সরকারের গাড়ির পুল থেকে রিকুইজিশন দিয়ে কেবল সরকারি কাজের প্রয়োজনে গাড়ি নেন সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা।
আসলে বাংলাদেশে যে সিভিল সার্ভিস প্রচলিত রয়েছে, তা বৃটিশেরা উপনিবেশের জন্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বৃটেনের নিজস্ব সিভিল সার্ভিস খুবই যুগ উপযোগী। সেখানে গাড়ি, বাংলো, খানসামা, আর্দালিসহ এইসব রাজকীয় সুযোগ সুবিধার প্রশ্নই ওঠে না। বৃটিশ সিভিল সার্ভিসের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শনি-রবিবারে বাজারে যান, বাজার করে ফিরলে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে রান্না করেন। ডিসি ভাবি নিজেই বাগানের মালির কাজ করেন। কলোনিয়াল মাস্টার হিসেবে বৃটিশ ও ইউরোপীয় কালচারের হাজারটা সমালোচনা আপনি করতে পারবেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক মনন ও জীবন চর্যা শেখার ক্ষেত্রে এংলো স্যাক্সন কালচারের ইতিবাচক দিক আজকের দিনে আপনি ঠিকই খুঁজে পাবেন।
বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ছিলেন, প্রশাসনিক ক্যাডারের এক লোক, যিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের ইতিহাস-এ এম এ সচিব পাবেন, কৃষি সচিব হিসেবে পাবেন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষা সচিব হিসেবে পাবেন বায়ো কেমিস্ট্রির ছাত্র। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে পাবেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। এইরকম স্পেশালাইজড কাজ জেনেরাইলেজশনের স্যারদের দিয়ে চলছে ৫৩ বছর। এর মধ্যে দেশের কোনো লাভালাভ নেই; আছে ক্যানাডার ও মালয়েশিয়ার বেগম পাড়ায় সচিব মহোদয়ের সেকেন্ড হোম, বিশ্রামে হত কতিপয় আমলার স্ত্রী, আর স্পোর্টস কার হাঁকিয়ে বেড়ানো কতিপয় সচিব পুত্র ও কন্যা।
ঐ যে বাংলাদেশের অগমে দুর্গমে প্রাইমারি স্কুলের ড্রপ আউট ও মাদ্রাসায় পড়া যে অধিকার বঞ্চিত কিশোরেরা; তারা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে রক্ত ও ঘামে রেমিট্যান্স পাঠায় দেশে। আর সেই রেমিট্যান্স পাচার করে সেকেন্ড হোমে নিয়ে যাবার দায়িত্ব রাজনীতিক ও আমলাদের। বাংলাদেশ যাকে একটা পাসপোর্ট ছাড়া আর কিছুই দেয় না; সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরায়। আর বাংলাদেশ যাদের ‘স্যার’ ডেকে হৃষ্ট পুষ্ট করে তারা দেশডাকাতি করে একসময় দেশ থেকে সেকেন্ড হোমে চলে যায়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যে মেধাবী, সৎ ও শিষ্টাচারসম্পন্ন কর্মকর্তারা রয়েছেন; তারা চেয়ার পেয়ে উদ্ধত হয়ে পড়া নোম্যাড ও মোঙ্গলদের হানায়; অনেক কষ্টে টিকে থাকেন। নোম্যাডের ঘুষের টাকার শানসৌকত, জেল্লা আর চর্বির বাড়ই দেখে; সমাজের গর্দভ প্রকৃতির লোকেরা সৎ কর্মকর্তাদের বোকা লোক বলে বিশেষায়িত করে।
যে সিভিল সার্ভিসে সারাদিন শিঙাড়া, কমলা খেয়ে গুলতাপ্পি মেরে সময় কাটে, সেকশন অফিসার ফাইল নিয়ে এলে, সব কিছু ঠিক আছে তো মকসেদ, দেইখ আবার বলে সই করে দিয়েই আবার সারাদিন পোস্টিং প্রমোশন, তেলাঞ্জলি, প্রকল্পের কমিশন, ঘুষাঞ্জলির গপ্পো, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে দেবার ঘুঁচপুঁচ; সেই সিভিল সার্ভিস থাকলেই কি আর না থাকলেই কী!
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের যে গতি, সেবার যে মান; তার সঙ্গে প্রতিতুলনা করলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রেইস দিয়েও পাশ মার্কস জোটাতে পারবে না। মন্ত্রণালয়গুলোকে এরা রীতিমতো যন্ত্রণালয়ে পরিণত করে। সিভিল সার্ভিস জনসেবার কাজ। অথচ পিএসসি বেছে বেছে পুরো ইউনিভার্সিটি লাইফ মুখ গুঁজে বিসিএস গাইড মুখস্থ করা এন্টি সোশ্যাল ছেলেমেয়েগুলোকে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে। পৃথিবীর আর কোনো দেশের সিভিল সার্ভিস সম্পর্কে খোঁজ খবর না রাখা নিজে নিজে শ্রেষ্ঠ হয়ে বসে থাকা ম্যাগালোম্যানিয়ার রোগীদের দিয়ে জনপীড়ন ও নির্যাতন চালায় রাষ্ট্রযন্ত্র। এই সিভিল সার্ভিস হচ্ছে অত্যন্ত অনাকর্ষনীয় প্রেমিক বা প্রেমিকার মতো, যার সঙ্গে ব্রেকআপ, টক্সিক রিলেশন থেকে মুক্তির আনন্দ নিয়ে আসে।
ইনফেরিয়রের সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে অ্যাডমিন ক্যাডারের যে ব্রাহ্মণ্যবাদ, এ হচ্ছে লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সন্তান বংকিম চন্দ্রে ভ্রান্ত আর্য কল্পনার ফাঁপা অহংকার।
উপসচিব নিয়োগের আগে; পিএসসি'র উচিত সিভিল সার্ভিস নবায়ন পরীক্ষা নেওয়া (লিখিত, মৌখিক ও মনস্তাত্বিক)। সেই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে উপসচিব পদে পদায়ন হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা যৌক্তিক।
২৪ বছর বয়সে বিসিএস-এ করা ফলাফলের ভিত্তিতে অ্যাডমিন ক্যাডারকে ক্ষমতা অপব্যবহারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবার যে ট্র্যাডিশন, সেটাই বাংলাদেশের ব্যাড গভর্ণেন্সের প্রধান কারণ। এই ক্ষমতার চিরস্থায়ী প্রথা বিলোপ না করলে গুড গভর্নেন্স ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
সাবেক ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনার স্বৈরমূর্তি গড়তে এই অ্যাডমিন ক্যাডারের ভূমিকাই প্রধান। এরা তিনটি বেআইনি ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেছে। শেখ হাসিনার জননির্যাতনের ডান হাত এই অ্যাডমিন ক্যাডার, আর বাম হাত পুলিশ ক্যাডার। অন্য কোন দেশে হলে তদন্ত করে অপরাধী কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হতো।
১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টে দেশের মানুষ স্পষ্টভাবে দেখেছে, এই প্রশাসন ও পুলিশ গণশত্রু। নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে এতটুকু অপরাধবোধ কাজ করেনি এদের মাঝে। অথচ সেনাবাহিনী ঝুঁকি নিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষের বিপদে যাকে পাশে পাওয়া যায় না, তাকে কেন জনস্বার্থে বেতন দিয়ে পুষবে তারা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন