যারা শিষ্টাচার জানা মানুষ, তারা কখনও অন্যের ধর্ম নিয়ে অসৌজন্যমূলক কথা বলে না। বরং চেষ্টা করে নিজের ধর্মের কুসংস্কার দূর করে একে সমসাময়িক করে তুলতে। আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি ছেলে-মেয়েদের এই শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে পারে; তাহলে ধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপন অনায়াস হবে।
ফেসবুক আসার আগে পর্যন্ত গুটিকতক পত্রিকা ও রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচার হতো। ফলে ধর্মীয় সম্প্রীতির একটি আবহ অক্ষুণ্ণ ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে যাওয়ার পর, নতুন শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমানের অন্য কোনো ব্যক্তিগত সুকৃতি না থাকায় ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের বৈঠকখানা হয়ে দাঁড়ায় ফেসবুক।
ফলে দেখা যায় যাদের বাবা-প্রাণ সহজ সরল ধর্মপ্রাণ অথচ সম্প্রীতির মানুষ ছিলেন; তাদের ছেলে-মেয়ে একটু শিক্ষিত হয়ে বিরাট পালোয়ান হিন্দু ও মুসলমান হয়ে ওঠেছে।
নতুন শিক্ষিত হিন্দুর তখন কাজ হয়ে দাঁড়ায় ইসলাম ধর্মের ত্রুটি বিচ্যুতি প্রচার; নতুন শিক্ষিত মুসলমানের কাজ হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু ধর্মের ত্রুটি বিচ্যুতি তালাশ। এইভাবে ফেসবুকে একটি জয় শ্রীরাম জনতা বনাম তৌহিদী জনতা হট্টগোল উপস্থিত হয়।
আমাদের সমাজে পুরুষের আবার নারীচিন্তা না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। ফলে হিন্দু পুরুষেরা মুসলমান নারীর হিজাব আর মুসলমান পুরুষ হিন্দু নারীর শাখা সিঁদুর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পোশাক ও রুপসজ্জা মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছার স্বাধীনতা; সভ্যতার এই নিয়ম তুচ্ছ করে হিন্দু-মুসলমান পুরুষ নারীর পোশাক ও রুপসজ্জা পুলিশ হয়ে ওঠে।
এরই মধ্যে কিছু হিন্দু-মুসলমান ছেলে জিনস টি-শার্ট পরে কফি খাওয়া শুরু করে। দুই চারটা ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি দিয়ে ফেসবুকে নিওঅ্যালিট হিসেবে সাঁতার দিয়ে ওঠে। দর্শন শাস্ত্রে সংশয়বাদ প্রাচীন একটি ঘরানা; যেখানে ধর্ম ও স্রষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চল রয়েছে। কিন্তু সেই আলোচনাটা হয় অত্যন্ত পরিশীলিত ভঙ্গিতে। আমাদের সমাজে পরিশীলিত বাক্যালাপের চল তো প্রায় উঠেই গেছে; সুতরাং জিনস-টি-শার্ট পরা নব্য অ্যালিট হিন্দু ও মুসলমান এসে পয় ধর্মকে গালি দিয়ে আর জয় শ্রীরাম জনতা ও তৌহিদি জনতাকে খিস্তি করে তাদের কথিত আধুনিকতা জাহির করতে। ফলাফল ত্রিশূল ও চাপাতি হামলা। সামাজিক শান্তি বিনষ্ট করে সারাক্ষণ কলতলার ভাষায় ধর্মকে গালি দিতে দিতে ফেসবুকের পরিবেশ তিক্ত করে তোলে জিনস ও টি-শার্ট। ইংরেজি বই দুচারখানা পড়লেও রেগে গেলে সেই কলতলার গালি বেরিয়ে এসে এক্সরে রিপোর্ট দিয়ে চলে যায়।
যেহেতু সালমান রুশদি অসম্ভব প্রতিভাবান একজন লেখক তার লিখন শৈলির পরিবর্তে ইসলাম ধর্মকে টিপ্পনী কেটে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন; ফলে বিখ্যাত হবার জন্য ইসলামকে দুটি গালি দেওয়া হয়ে দাঁড়ায় লেখক হতে ইচ্ছুক জিনস-টি-শার্ট তরুণদের ফ্যাশান। এইদলে ইসলাম ধর্ম ছেড়ে আসা তরুণদের সঙ্গে যোগ দেয় হিন্দু ধর্ম ছেড়ে আসার ভান করা তরুণেরা। ভান করা এজন্যই বলছি যে, তাদের অ্যাথিজম চর্চায় হিন্দু ধর্ম কখনও আক্রমণের বিষয় নয়; সব আক্রমণ ইসলাম ধর্মের প্রতি।
এই ঘটনাটি ইতিহাসে আগেও ঘটেছে; কলকাতায় ব্রাহ্ম জীবন চর্যার ফ্যাশান গ্রহণ করেছিলেন যারা; তাদের জীবন চর্যায় আকৃষ্ট হয়ে ঢাকায় একটি সংস্কৃতি পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। ব্রাহ্ম চর্চার ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা প্রায় সবাই কট্টর হিন্দু হয়ে পড়েন বয়স বাড়তেই। কিন্তু ঢাকার নও ব্রাহ্ম আর নিজ ধর্ম চর্চার আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় না। তখন তারা পুজো করাকে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদান বলে মনে করে; কিন্তু ইফতারকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ ভাবতে পারে না। সংস্কৃতি খালারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন ধর্ম নিরপেক্ষ সুফিকে রীতিমতো হিন্দু জ্ঞান করে চর্চা করতে থাকে। ঊনবিংশ শতকের জোড়াসাঁকোর পরিবারের নারী-পুরুষের মতো সাজ পোশাক পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঙ্গলঘট জ্বালায়। অথচ কলকাতা সেই কবে চলে গেছে মডার্ন আউটফিটে। সেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা আক্ষরিক অর্থেই চর্চিত। রবীন্দ্রনাথের সমান্তরালে মির্জা গালিব পঠিত।
ঢাকার সংস্কৃতি মামা-খালাদের গোঁড়া হিন্দুর মতো আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, ড. সলিমুল্লাহ খান চক্ষুশূল হয়ে যান সংস্কৃতি মামা-খালার। প্রথম প্রজন্মের হিন্দু ও মুসলমান লিবেরেলেরা তখন প্রতিদিন সকালে উঠে ফেসবুকে ছফা-মজহার-খানকে গালি দিয়ে দিনের কার্যক্রম শুরু করে।
আমার লেখালেখিতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইসলামি কট্টরপন্থার সমালোচনা ও ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করার আগ্রহ জায়গা পেয়েছে। কারণ আমি সেই সোনালী সূত্র মেনে চলি; অন্য ধর্মের সমালোচনা অসৌজন্যমূলক। কিন্তু ফেসবুকে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশে প্রগতিশীল সেজে বসে থাকা গোঁড়া হিন্দুরা সারাদিন ইসলাম ধর্মকে গালাগাল করছে; মুসলমানদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। বাংলাদেশ ছোটো দেশ; এখানে আমরা চিনি কে কোন কাননের ফুল। যখন দেখলাম প্রথম প্রজন্মে একটু শিক্ষিত হয়ে রীতিমতো কর্নওয়ালিশের হিন্দু জমিদারের ভঙ্গিতে এরা ‘কালচার’ ও 'আধুনিকতা’ শিক্ষা দিতে এসেছে; তখন ধরে ধরে এদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে শুরু করলাম। এদের অনেকে ইনিয়ে বিনিয়ে হিন্দু মৌলবাদি নরেন্দ্র মোদীর প্রতি সমর্থন জানাত; আর বাংলাদেশে হাসিনা বাদে সবাই ইসলামি মৌলবাদি এরকম ন্যারেটিভ তৈরি করত। ঠিক যে ন্যারেটিভ ভারতের মিডিয়ায় ১৫ জুলাই থেকে আজ অবধি শোনা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগতভাবে উদার হিন্দুরা ঐ গোঁড়া হিন্দুদের আচার-আচরণকে চ্যালেঞ্জ করলে তার মন্তব্যঘরে রীতিমতো বিজেপির অফিস বসে যায়। সেখানে গোঁড়া হিন্দুরা তাদেরকে মুসলমানদের দালাল তকমা দিয়ে ধর্মচ্যুত করার হুমকি দেয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ উদার হিন্দু সংখ্যায় বেশি হয়েও গোঁড়া হিন্দুদের অপমানের ভয়ে চুপ করে থাকেন। জয় শ্রীরাম কবে থেকে বাঙালি হিন্দুর স্লোগান হলো, এই প্রশ্ন করেই সমাজচ্যুত হয়েছেন অনেক উদার হিন্দু।
আমাদের মুসলিম সমাজেও অনুরুপ সমস্যা রয়েছে। তৌহিদী জনতার মাজার ভাঙ্গার প্রতিবাদ করে ও চিন্ময়ের মুক্তি চেয়ে ফরহাদ মজহার যেমন গোঁড়া মুসলমানদের গালাগালি ও হুমকির মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দাবি তুললে; প্রতিমা ভাঙ্গে এমন গোঁড়া মুসলমানদের বিচার দাবি করলেই; তৌহিদী জনতা এসে নাশতেক কিংবা ভারতের দালাল বলে গালি দেয়।
ধর্মীয় গোঁড়ামি আসলে ট্রাইবাল মাইন্ডসেট। শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা লোকের হুজ্জোতির উপলক্ষ। পাঁচ পয়সার দাম নেই যেসব লোকের এরা, কেউ খিলাফতের হুজুগ তুলে একটু গুরুত্ব পেতে চেষ্টা করে; অখণ্ড ভারতের হুজুগ তুলে একটু প্রাধান্য পেতে চেষ্টা করে। আমি ঠিক এদেরও দোষ দেই না। আমাদের সমাজ-পরিবার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেসব শিশুকে কোনো মনোযোগ দেয় না; এদের মধ্যে মনোযোগ পাবার আকাঙ্খা কাজ করে। গভীর অভিমান নিয়ে এরা বড় হয়। সেই অভিমান বড় হলে জয় শ্রীরাম জনতা ও তৌহিদী জনতার গোস্বা আকারে প্রকাশিত হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন