পদ-পদবী কাঙ্গাল বাঙালি

১১৪ পঠিত ... ১৬:৪৪, অক্টোবর ২৩, ২০২৪

32 (16)

পৃথিবীর এভলভড বা মানসিকভাবে এগিয়ে থাকা সমাজের মানুষ অন্যতম বা অনেকের মধ্যে একজন হয়ে বাঁচতে পারে। কিন্তু বাঙালি সমাজের শেকড়ে শ্রেণী প্রথা থাকায় উচ্চ বর্ণ বা আশরাফ হবার আকাংক্ষা প্রবল। ডিএনএ-তে বিশেষ হবার স্বপ্ন; অন্যের চেয়ে উচ্চ হবার আকাংক্ষায় পুচ্ছটি উচ্চে তুলে নাচানোর সংস্কৃতি দৃশ্যমান।

বাংলাদেশে কত লোকই তো মন্ত্রী-সচিব-রাষ্ট্রদূত-মহাপরিচালক হয়েছেন; যে ক'দিন তারা ক্ষমতায় থেকেছেন; ঐ ক'দিন সহমত-শিবব্রত-রহমত-শরিয়ত তাদের আগে পিছে দৌড়েছে; ললিতা ও রাবেয়া ফুলমাল্য নিয়ে পেলব হাসি দিয়েছে।

কিন্তু যেদিনই তারা অবসরে গেছেন; হারিয়ে গেছেন; ছেলে-মেয়েকে বড় করে সেকেন্ড হোমে পাঠিয়ে দেবার পর; এম্পটি নেস্টে ‘শুন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’ গাইছেন, হুইল চেয়ারে বসে; কিংবা ওয়াকার নিয়ে নেচে নেচে হেঁটে। যাদের চলার শক্তি আছে তারা শতায়ু অঙ্গনে হাঁটতে গেলে লোকজন তাকে দেখিয়ে বলে, ঐ বেড়ালডা আগে বাঘ আছিলো।

এই যেখানে ক্ষমতার জীবন চক্র, সেখানে পদ-পদবী পাবার জন্য ইঁদুর দৌড়ে প্রাণপাত করে; জীবনটাই যাপন করা হয়ে ওঠে না। পশ্চিমের কল্যাণরাষ্ট্রগুলোতে এ কারণে কেবল মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন হয়; উচ্চ পদে নিয়োগ হলেও সুযোগ সুবিধা সীমিত হয়। এমেরিকা বা বৃটেনের কোন আর্মি জেনারেলের বাসায় গেলে দেখবেন, তার স্ত্রী বাগানে কাজ করছেন, আর জেনারেল নিজে বাজার করে ফিরলেন। সেই ঔপনিবেশিক আমলের মতো চাকর-বাকর-কাঁকর কিছুই নেই তাদের। ফলে কারো কোন শীর্ষ পদ চলে গেলেও যাপিত জীবনে তেমন কোন পার্থক্যই ঘটে না।

আর আমাদের দেশ পড়ে আছে এই লর্ড কর্নওয়ালিশের যুগে। সেই যে বাঙ্গালির মনে জমিদারী প্রথার ভুত ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো লোকটা; আজো সেই ভুত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় একদা দাস থেকে প্রভু হয়ে ওঠা নব্য জমিদারগুলোকে। আগে চলে দাসী বান্দি , পিছে সখিনা দৃশ্যকল্প রচিত হয় প্রতিটি পদপ্রাপ্ত লোকের বেগম সাহেবার চলাফেরায়। মন্ত্রী-সচিব-মহাপরিচালকের শ্যালক-শ্যালিকা সবাই সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট নিয়ে লোকজনকে ধমক দিয়ে বেড়ায়। বাঙ্গালির জীবনের সাফল্যের সূচক, কে কত জোরে ধমক দিতে পারে লোকজনকে। আর আছে গাম্ভীর্য। পদাধিকারী মানে গম্ভীর হয়ে চেহারাটা প্রণব মুখার্জির মতো করে রাখতে হয় এদের। অথচ একই পদে থেকে এপিজে আবুল কালাম আজাদ দিনমান হাসতেন। কিন্তু বাঙালি সমাজে হাসলেই প্রবলেম। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের চৌধুরী সাহেব কিংবা সান্যাল বাবু্র মতো গম্ভীর না থাকলে; অতীব জাজমেন্টাল চাকর সমাজ ভাববে, লোকটা লাইট; তার কোন পারসোনালিটি নাই।  

বাঙ্গালি ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের লেজ ধরেছিলো জমিদার হবার জন্য; সেই থেকে একে একে আইয়ুবের লেজ, বঙ্গবন্ধুর লেজ, জিয়ার লেজ, এরশাদের লেজ, খালেদার লেজ, হাসিনার লেজ হয়ে এখন ইউনুসের লেজ ধরেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারেকের লেজ ও পুতুলের লেজ ধরার জন্য। বাঙ্গালির এই অদৃশ্য সাবানে হাত কচলে পদ বাগানোর শিল্পকৌশলটিই বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রসরতা ও অকল্যাণের মূল কারণ। কে কবে এদের মাথায় উচ্চ বর্ণ হবার স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে; তাই সুযোগ পেলেই জিনস- টি শার্ট পরে কফি খেয়ে, ইউভাল হারারির বই হাতে ফেসবুকে এলিটিজম প্রদর্শন একটা নেশার মতো। দারিদ্র্য দূর করা যায়; কিন্তু মনের দারিদ্র্য দূর করা অসম্ভব। তাই এ সমাজের চিন্তা জগতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সাম্য সংস্কৃতি প্রায় অসম্ভব।

যেহেতু বাঙালি সমাজে মেধা ও যোগ্যতা নয়, তেলাঞ্জলির ভিত্তিতে পদায়ন হয়; তাই এখানে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না। সরকার প্রধানের লালসালুর মাজারে মাথা ঠুকে একটি পদ পেলে; সে পদ পাওয়ার ইউফোরিয়াতেই কেটে যায় পুরোটা সময়; প্রতিষ্ঠান গড়বেন কখন।

ঐতিহ্যসঞ্জাত ভাবে প্রশ্ন নয় প্রশংসা করে সাফল্যের ইঁদুর দৌড়ে মিডিওকাররা এগিয়ে থাকায়; বাঙালি সমাজে মেধা-যোগ্যতা ও দক্ষতার বিরুদ্ধে এপারথেইড চলতে থাকে। ঠিক ঠাক শিক্ষিত নির্লোভ মানসিকভাবে অভিজাত লোক এ সমাজে ম্যারাডোনার মতো। মিডিওকার বিদূষকেরা তাকে ঘিরে ধরে ল্যাং মেরে ফেলে দেবার জাতীয় উতসব করে। অশালীন মাতারাতজি বা ময়ূখরঞ্জন নানান অঙ্গভঙ্গি করে যোগ্য লোককে এতো বিরক্ত করে যে, বিরক্ত হয়ে সে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলে; গ্যালারিতে সাবহিউম্যান গ্যাং গুলো দাঁত বার করে হাসে।

খুব বেশি উত্তরণ এ সমাজে সহসা হবে না। বিংশ শতকের লোকজন এ সমাজের জন্য বোঝা; তাদের কাছে বেশি কিছু আশা করা ভুল। একমাত্র জেন-জি যদি পারে বিশ্বসভ্যতার আলোকসরণির পথ ধরে বিশ্বনাগরিকের মতো উদার ভাবনা ভাবতে; পদ-পদবীর ক্লিশে মোহের বাইরে গিয়ে সৃজনশীলতার প্রতি মোহ তৈরি করতে ; মেধা-দক্ষতা ও যোগ্যতাকে ঈর্ষা না করে উদযাপন করতে শেখে; তবে হয়তো নব্য জমিদারির পশ্চাদপদ ভুতটি সমাজ-মানস থেকে পালিয়ে সেখানে সুস্থতা ও সাম্যভাবনা ফিরে আসতে পারে। নির্মল জীবন উদযাপনের ভোর হয়তো ঠিক তখন আসবে।

১১৪ পঠিত ... ১৬:৪৪, অক্টোবর ২৩, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top