লেখা: সোহরাওয়ার্দী নূর
এটা আমিও ভাবতাম যে সরকারি চাকরির জন্য এত হুতাশ কেন, অল্প কয়টা সরকারি চাকরি মাত্র।
কিন্তু নিজে চাকরি খোঁজায় বুঝতে পারছি যে, দেশে একটা জব পাইতে অনেক প্রিভিলেজ, ইনফরমেশন আর অ্যাক্সেস লাগে।
আমি নিজেও কম প্রিভিলেজড না। ঢাকায় আমাদের নিজের থাকার জায়গা, গাড়ি আর ড্রাইভার। আমার বাবা মা ঢাবির, তারাও কর্পোরেটে আর সরকারি চাকরিতে গিয়েছে। সেই প্রিভিলেজের জন্য আমার থাকার জায়গা, যাতায়াত আর খাওয়া নিয়ে ভাবতে হয় নাই। সেই প্রিভিলেজের উপর দাঁড়িয়ে আমি ইন্টারে বোর্ডে কমার্সে ফার্স্ট হইছি, আইবিএতে ফার্স্ট হইছি, আর তারপরেও জব ইন্টারভিউ পাইতে আমার ঘাম ছুটে গিয়েছে। কম করে হলেও ১২/১৩টা জবে আবেদন করার পর আর কোনো রিপ্লাই পাই নাই। একটা মাল্টিন্যাশনাল শুনলাম লিংকড-ইনের পোস্ট তখন দেয় যখন তার অলরেডি সিলেকশন শেষ।
আমার প্রথম ইন্টারভিউ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রথম ইন্টারভিউতে একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা। আইবিএর এক সিনিয়র আপু আর দুইজন ম্যানেজার ১০+ বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে, তারা বুঝিয়ে যাচ্ছে কীভাবে আমি তাদের মতো করে তাদের কাজ বুঝি না। আর তারা নিজেরা কত স্মার্ট। মানে একদম নতুন গ্রাজুয়েটকে ভালোমতো ধুয়ে নিজেরা স্মার্ট হইলেন। পরে যদিও আবার ডাক পেয়েছিলাম। আইবিএর এক ম্যাম আর এক ভালো সিনিয়র ভাই আবার ডেকেছিলেন। তারপর জব অফারও পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই অ্যান্ট্রি লেভেলের লর্ডদের দেখে আর যাই নাই। আইবিএর মেলিতা ম্যাম আমাকে পরে বিকাশেও রেফার করছিলেন, সেখানেও ইন্টারভিউতে দুইজন লর্ড ছিলেন। তারা এক একজনকে এক একভাবে মাপলেন আর তারপর পাই নাই সেটা। আবার পরে দয়া দেখিয়ে আরেকজন বস কল করলেন আর তারপর অন্য একটা পোস্ট অফার করলেন। তারপর অফার করলেন নরমাল MTO এর থেকে কম টাকা, আর এটা সেটা কারণ দেখাইলেন। তারপর যেটায় জয়েন করলাম, PwC এর জন্য আইবিএর সিনিয়রদের থেকে অনেক হেল্প পেয়েছি। কিন্তু ইন্টারভিউ নিয়েছে সব বিদেশি, আর আমার বস অনেক খাটাইলেও, সে লর্ড ভাব নেয় নাই।
কিন্ত জব করতে গিয়ে ক্লায়েন্ট দেখলাম দেশের বড় বড় কোম্পানির মালিক আর হাই লেভেলের অফিসিয়াল।
তখন বুঝলাম কতটা আর কত লেভেলের কানেকশন আর প্রিভিলেজ থাকা সম্ভব। আমি আমার এই ৯০% এর উপরের সুবিধা, ঢিলা স্যুট, আইবিএর রেকর্ড রেজাল্ট আর নতুন শিখা ইংরেজি দিয়ে কোনো রকম ঢুকতে পেরেছি। নাহলে আমার জন্যও গুলশান অনেক দূর ছিল। আর এই দরজা আমার জন্য বন্ধ ছিল। প্রিভিলেজ ছিল, আল্লাহ দিয়েছে। আমি এই দরজা একা খুলতে পারতাম না।
আমি যেই কয়দিন গাড়ি না নিয়ে বাসে গিয়েছি, আমার আরেকসেট কাপড় ব্যাগে নেওয়া লেগেছে। কারণ, ফরমাল পড়ে অফিসে থাকা লাগলেও ফরমাল পড়ে উঠার মতো লোকাল বাস দেশে নাই।
আর দেশের ৯০% স্টুডেন্ট যারা মফস্বল আর গ্রাম থেকে এসে ঢাকায় একটা থাকার জায়গা খুঁজে পায় না, খালি বইয়ের উপর ভর করে বাসে ঝুলে ঢাকায় এসেছে, তার জন্য গুলশানের কাচের দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব।
তার জন্য বিদেশে পড়তে যাওয়াটাও মিরাকল। ফুল স্কলারশিপ পাইলেও টাকা দিয়ে GRE TOEFL দিয়ে প্লেনের টিকিট পর্যন্ত কয়েক লাখ টাকা লাগবে যেটা তার নাই। তারপর আছে একটা ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম যেখানে মিলিয়ন ডলার পাচার সম্ভব। কিন্তু ৩৫০ ডলার দিয়ে সেভিংস ফি দিতে অনেক আইন। এসব ম্যানেজ করে এয়ারপোর্ট যাওয়া বলতে গেলে আমেরিকার থেকে বেশি দূর ।
তাই সেই ৯০% স্টুডেন্টের জন্য একটা ক্যাডার নন ক্যাডার সরকারি জবই সব। যেইখানে তার একটা স্যুট পরে স্মার্টনেস দেখানো লাগবে না। তার স্যুটই নাই। তার জন্য কল করারও কোনো লর্ড নাই।
তাই বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী যদি মার খেয়ে রাস্তা আটকায়, আর অধিকার আনতে মরেও যায়, এটা তার এমনিতেই বাঁচা মরার লড়াই-ই ছিল। খালি কয়দিন আগে আর পরে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন