বাংলার লখনৌতি থেকে ঘোড়ায় চড়ে লক্ষ্ণৌর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে খসরু। পথে যেতে যেতে পথচারীদের গল্পের শব্দ শুনে মনে হয়; আসলে ধ্বনি বদলাতে থাকে প্রায় ১৫ ক্রোশ পরে পরেই। আর নদী-পাহাড় ধ্বনি দূরত্ব বাড়াতে থাকে। ভাষা আসলে ধ্বনি সমাহার। সে কারণে যে কোন ভাষায় কেউ প্রাণ দিয়ে গাইলে; সুর মুর্ছনার মাঝে বসে শ্রোতা ধীরে ধীরে গানের অর্থ বুঝতে পারে। তাইতো খসরু চেষ্টা করে তার গীতিকবিতায় বিভিন্ন ভাষার সেতুবন্ধ রচনা করতে। পূর্বী বা মাগধী শব্দের সগে ফারসি শব্দ মিশিয়ে ভাষা সম্প্রীতি রচনা করে। পথে পথে মানুষের জীবন চর্যা দেখে বোঝার উপায় নেই কে হিন্দু কিংবা কে মুসলমান। অযথাই মানুষ; ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে ছোট ছোট উপদল তৈরি করে স্বার্থের লড়াই করে; উচ্ছেদের খেলা খেলে।
পাটনার কাছে দেখা হয় একদল তীর্থ যাত্রীর সঙ্গে; যারা সোমনাথ মন্দিরে নিজেকে পরমাত্মার কাছে সমপর্ণ করতে যাচ্ছে। দুর্মর আকাংক্ষা তাদের এই কঠিন যাত্রায় শামিল করেছে। খসরু বিশ্রামরত একদল তীর্থযাত্রীকে বলে,
নামি দানাম ছি মঞ্জিল বুঁদ সব জায় কি মন বাদুম
বাসারু রাগস-ই বিসমিল বুদ সাব জ্যায় কি মন বাদুম
পরী পাই কার নিগার-ই-সারঁ কাদ্দে লালা রুখসারে
আমার চারপাশে ছিলো প্রেমে অর্ধমৃত প্রেমের স্বীকার
ছটফট করছে বেদনায় নীল
সেখানে ঝাউবৃক্ষের মতো বিরহিনী প্রেমিকা ছিলো
যার রক্তিম পুষ্প মুখমণ্ডল এক।
তীর্থযাত্রীরা সমস্বরে বলে, আহা, সাধু সাধু; এ যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের কবিতা। পরম প্রিয় কৃষ্ণ যেন সেই সুনীল প্রেমিক; আর আমরা রাধা যেন সেই রক্তিম পুষ্পমুখমণ্ডলের প্রেমিকা।
তীর্থ যাত্রীদের আত্মা যেন সোমনাথ মন্দিরে পরমাত্মার দেখা পায়; আনন্দময় হয় প্রেমযাত্রা' সেই প্রার্থনা করে খসরু এগিয়ে যায়।
এরপর লক্ষ্ণৌর কাছাকাছি হতেই দেখে একদল হজ্জ্বযাত্রী; মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। পরমাত্মা খোদার কাছে নিজেদের আত্মা সমর্পণ করতে তারা এই কঠিন যাত্রায় রয়েছে।
সাপারা আফাত-ই দিল বুঁদ সব জ্যায় কি মন বুঁদুম
খুদা খুদ মীর-ই মজলিস বুঁদ অন্দর লামকান খুসরও
মুহাম্মাদ শাম-ই মেহফিল বুঁদ সব জ্যায় কি মন বুঁদুম
কী নির্দয় সেই প্রেমিকদের হৃদয় নিয়ে খেলা
খোদা নিজেই তো সেই বেহেশতি জলসার প্রভু
ওহ খসরু! কোথায় যেন সেই মুহাম্মদের মুখ, আলোক বিচ্ছুরণের সে আঁধার।
হজ্জ্বযাত্রীরা সমস্বরে বলে ওঠে, মারহাবা মারহাবা, এ যে আমাদেরই প্রেমকাহিনী; খোদার প্রেমে মাতোয়ারা আমরা সবাই; ও মুহাম্মদ আমাদের প্রাণের নবী; পথ দেখিও সেই বন্ধুর পথে।
খসরু প্রার্থনা করেন, হজ্জ্বযাত্রীরা যেন তাদের প্রেমের মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারে। পরমাত্মার কাছে আত্মা সমর্পণের এই কঠিন যাত্রা যেন আনন্দময় হয়।
লক্ষ্ণৌতে একটি সরাইখানাতে আশ্রয় নেয় খসরু। বাংলার লখনৌতি শহরের মতো কাব্যময় শহর এই লক্ষ্ণৌ। এখানে মানুষের মুখের ভাষা খুব মিষ্টি। সরাইখানাতে খাদ্য পরিবেশন করা হয়; রুমালি রুটির সঙ্গে গোশত সবজি; মুগ ডালের সৌরভ ক্ষুধার্ত খসরুর প্রাণ আকুল করে। পরিবেশিত হয়েছে শুভ্র লাচ্ছি; মিষ্টান্নে আছে গাজরের হালুয়া।
খাবার পরেই ঘুম নেমে আসে চোখে। লখনৌতির দিলবাহারের সেই বাগান ঘেরা গৃহের বৈঠক খানার ছাদের কড়ি কাঠের মতো সরাইখানার ছাদের কড়ি কাঠ। সাদা চুনকাম করা ছাদের মাঝে মাঝে বাদামি রঙ এর কড়িকাঠগুলো। মনে হয় যেন মসলিনের পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে দিল বাহার। ঘুমটা অকস্মাত ভেঙ্গে যায়। রাস্তায় জুরিগাড়ির শব্দ। হেঁটে যাওয়া পথচারির গল্পের শব্দে এটা বোঝা মুশকিল; এটা লখনৌতি নাকি লক্ষ্ণৌ।
জানালার কাছে দাঁড়াতেই কোকিলের কুহুতান কানে আসে। সামনে একটা সাদা দেড়খানা দোতলা বাড়ির অর্ধেক ছাদে বেগুনি রঙের ঘাগরা চোলি পরে সকালে শুকাতে দেয়া আচারের বয়েম সংগ্রহ করছে এক নারী। দৃষ্টিবিভ্রমে মনে হয় যেন; দিল বাহার।
খসরুর চোখে চোখ পড়তেই দৌড়ে সে অনিন্দ্য সুন্দরী দ্রুত আচারের বয়েমগুলো নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে যায়। খসরুর ইচ্ছা করে জানতে, সত্যি সত্যি সামনের ছাদে সে দিল বাহারকে দেখেছে সে; নাকি মন বিভ্রমের আলেয়া সে। এমন কী হয় কখনো; মানুষ সর্বান্তকরণে যাকে দেখতে চায়; খোদা তাকে সামনে পাঠায় মায়াহরিণীর মতো।
খসরু বিড় বিড় করে বলতে থাকে,
খবরম রাসিদ ইমসাব কি নিগার খুয়াহি আমাদ
সার-ই মন ফিদা-ই রাহ-ই সওয়ার খুয়াহি আমাদ
হাম-ই আহওয়ান-ই সেহরা সার-ই খুদ নিহাদা বার কাফ
বা-উমিদ আঁকি রোজি বাশিকার খুয়াহি আমাদ
কাশিশি কি ইশক দারাদ নাগুযারাদাত বাদিনসা
বা-জানাযাহ গার নায়াই বা-মাযার খুয়াহি আমাদ
বালাবাম রাশিদ জনম ফাবিয়া কি জিন্দাহ মানাম
পাস আযান কি মন না-মানাম বাচা কার খুয়াহি আমাদ।
আজ রাতে খবর পেয়েছি হে প্রেয়সী, তুমি আসবে-
আমার মস্তক উতসর্গ করা পথ ধরে তুমি আসবে ।
মসৃণ শিং-অলা মরু-হরিণেরা তাদের মাথাগুলো হাতে ধরেছে
তোমার আশায়, শিকার করতে একদিন তুমি আসবে .
প্রেমের আকর্ষণ হতচকিত করবে না তোমাকে
আমার শেষকৃত্যে নিশ্চিত তুমি আসবে
আমার সমাধিতে নিশ্চিত তুমি আসবে
আমার প্রাণ জিভে এসে গেছে
এসো যাতে আমি বেঁচে যাই-
আমি মরে গেলে-আর কিসের জন্য তুমি আসবে?
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন