সুলতান বুঘরা খান পদ্মাবতী নদীতে বড় বজরায় শের শায়েরি সংগীতের আয়োজন করেছে। লখনৌতির কবি-গায়ক-পণ্ডিত-সালতানাতের শিল্প রসিকেরা আমন্ত্রিত। বজরায় দাঁড়িয়ে খসরু দেখে গেরুয়া বসনে পুরোহিত উঠছে নৌকায়, তার পিছে পিছে শেরওয়ানি টুপি পরা মৌলবি। আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে আছে কপালে পূর্ণিমার চাঁদের মতো বিন্দিয়া পরা সালংকরা হিন্দু রমণী; কপালে সূর্যের মতো টিকলি পরা সালংকরা মুসলমান নারী। ব্রাহ্মণ ও আশরাফ জমিদারেরা পাশাপাশি বসে খোশগল্পে মত্ত।
খসরু বুঘরা খানকে বলে, সুলতান, আপনার সালতানাতে সম্প্রীতির বসন্ত বাতাস আমাকে বিমুগ্ধ করেছে। সর্বত্র মানবসত্ত্বার জয়গান। ধর্মে কিংবা গোত্রে বিভাজিত নয় বাংলার সমাজ।
বুঘরা প্রমত্তা পদ্মার বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে বলে, শাসকের কোনো ধর্ম থাকতে নেই। শাসক কোন ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। শাসকের দায়িত্ব জনপদে শান্তি-সম্প্রীতি আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আমার শাসন নীতিতে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় কৃষক ও কারিগর কল্যাণ। শ্রমের কোনো ধর্ম থাকে না। যে কৃষক ফসল ফলায়, যে কুমার মৃতপাত্র গড়ে, যে তাঁতী বস্ত্র বয়ন করে, যে জেলে মৎস্য শিকার করে, যে স্বর্ণকার অলংকার বানায়, যে শ্রমিক দালান ও পথ ঘাট গড়ে; যে মাঝি বজরা চালায়; তাদের সবার ধর্ম আসলে শ্রম। তারাই জনপদের জীবনযাত্রা সচল রাখে। আর আমরা কেবল ব্যবস্থাপনাটুকু করি। আমাদের প্রায় প্রত্যেকের পূর্ব পুরুষের মোঙ্গলদের হামলায় মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হবার বেদনা আছে মনে; আমরা তাই প্রতিটি মানুষের মাতৃভূমিতে বসবাস নিরাপদ আর শান্তিপূর্ণ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করি। নেহাত কেউ নৌপথে হামলা না চালালে; আমি কারও ওপর শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিই না। কবি আপনি কথা বলে দেখুন পুরবাসীর সঙ্গে; কেমন আছে তারা; সে আমার জানা প্রয়োজন।
: সে আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। কথা বলেছি জীবনের নানা হাঁটা পথের মানুষের সঙ্গে। কারও তেমন কোন অনুযোগ অসন্তোষ চোখে পড়েনি।
: বাংলার মানুষ কারো বশ্যতা স্বীকার করে না। বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান প্রতিটি শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছে এখানে। কেউ কৌলিন্য আর আভিজাত্য দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ছোটো করার চেষ্টা করলে; জনগণকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সংকীর্ণ খেলায় মেতে উঠলে; বিদ্রোহ হবেই। সরল মানুষের মনে আঘাত দিলে তারা জটিল হয়ে ওঠে। এইজন্য সালতানাতের দপ্তরগুলোতে পুরবাসীদের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ রাখা হয়েছে। তাদের অভিযোগ শোনার পেছনে নিয়োজিত রয়েছেন বিচারক বৃন্দ। আমি মাঝে মাঝে চেষ্টা করি পুরবাসীর অভিযোগ শুনতে। যাতে তাদের কখনো মনে না হয়; খোদার সঙ্গে শিরক করে আমি তাদের খোদা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
: সুলতান আপনি তো কবিতার মানুষ; যে কাব্যসুধা পান করে; তার তো রক্ত পিপাসা থাকে না।
বজরায় পণ্ডিত সাহেবের পিছে পিছে দিল বাহারকে নৌকায় উঠতে দেখে খসরুর মন চঞ্চল হয়। বুঘরা স্মিত হাস্যে আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, লখনৌতি থেকে বিরহ নিয়ে কেউ দিল্লিতে ফিরে যাক; এ আমি চাইনা। আমার চাওয়া হচ্ছে; বাংলার সুখস্মৃতি-প্রেমময় ছবি আঁকা থাকুক খসরুর মনে।
বজরা চলতে শুরু করে; বিশাল জলরাশি এসে ঢেউয়ের দুলুনিতে দোলা দেয় সুলতানের বিশাল নৌ বহরে। সবাইকে পেস্তার শরবত পরিবেশন করা হয়। সুস্বাদু আম পরিবেশন করা হয় বিশাল তাম্রপাত্রে।
নারী-পুরুষের মাঝে একটা মসলিনের পর্দা দিয়ে বসার একটু আলাদা জায়গা করা হয়েছে। তবে হাওয়ায় হাওয়ায় পর্দা উড়ে খসরু ঠিকই খুঁজে নেয় দিলবাহারের চাঁদপানা মুখমণ্ডল। আজ সে বাসন্তী রঙ ঘাঘরা চোলি পরেছে। কপালে কমলা পাথর বসানো টিকলি। আম খেয়ে ঠোঁটও তার কি কিছুটা কমলা হয়নি!
বজরা আড়াআড়িভাবে গিয়ে বরেন্দ্র এলাকার কোল ঘেঁষে চলতে থাকে। লাল রঙের ছোট ছোট টিলা; আর ঘন আম্রকাননের শ্যামল আলোছায়ায় কোকিলের গানে; হলুদ ক্ষেতের ঘ্রাণ এসে মোহময় করে এই সুরম্য দুপুর।
ঐ তো দূরে দালান আর সবুজ বৃক্ষ সুশোভিত রাজকীয় নগরী মহাকাল গড় । একজন ব্রাহ্মণ জমিদার বলে, কবি ঐ আমাদের শহর; হিন্দু রাজন্য আর মুসলমান শাহীরা মিলেমিশে বসবাস করে এ অঞ্চলে। সেখানে শিক্ষা-সংস্কৃতি-সংগীত-চিত্রকলা-ভাস্কর্যের গভীর চর্চা আছে। রাজসিক এই শহরের মানুষ বড্ড রসিক। ব্রজবুলি, ফারসি আর স্থানীয় ভাষার মিশ্রণে এমন স্বরধনি এখানে যে; আমরা একে ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মের মিলনমেলা বলি। ব্রাহ্মণ ও আশরাফ জমিদারের বন্ধুত্বে গড়া এই জনপদ। এখানে কৃষিজমি এতো উর্বর যে; রেশমি বস্ত্রবয়ন এতো সুদৃশ্য যে মানুষ এখানে খেয়ে পরে গান গেয়ে পরম সুখে আছে। এই এলাকার ছোট ছোট গ্রামগুলোর মাঝখানে হাট বসে। তার দুইপাশে মন্দির ও মসজিদ। মন্দিরের ঘন্টা; পূজা-সঙ্গীত; মন্দিরের আজান-তিলওয়াতের সুর; মানুষের মনে ভালোবাসার বারতা পৌঁছে দেয়।
পণ্ডিত সাহেব এসে বুঘরা খানের কানে ফিসফিস করে বলে, কই খসরু তার কবিতা পড়ছেন না যে!
খসরু শুনতে পেয়ে বলে, আজ আমি প্রাণভরে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনা শুনতে চাই। বাউল গান চলছে; কীর্তন চলছে; বজরার মাঝিরা গান গাইছে, কাব্যপাঠ চলছে; বেশ লাগছে তো।
খসরুর আগ্রহ দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করে সবাই। এমন সময় হেকিম সাহেব কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, আপনার হৃদয়ের ব্যথাটা কী কমেছে!
: কী করে কমবে বলুন; মুসলমান হেকিম কিংবা হিন্দু বৈদ্য সারাতে পারবে না আমার এ ব্যামো। আমার চাই প্রেয়সীর কণ্ঠে প্রেমগীতি।
পদ্মা থেকে ইলিশ তুলে পাশের বজরায় ভাজা হচ্ছে; সেই সুঘ্রাণ বাতাস মাতাচ্ছে; মুরগির সালুন ঘন মশলায় রান্না হচ্ছে বড় ডেকচিতে; খাঁটি সর্ষে তেলে ভাজা হচ্ছে ফালি ফালি করলা আর আলু, পটলের দোলমা, গনগনে আগুনের ওপর ঝুলিয়ে ঝলসানো হচ্ছে আস্ত কচি ছাগল, মিহি চালের পোলাও থেকে গরম মশলার সৌরভ আসছে, তাওয়ায় তৈরি হচ্ছে গরম গরম লুচি। মিষ্টান্নে রয়েছে পায়েশ, পিঠা, রসগোল্লা, পানতোয়া, জিলাপি, ক্ষিরসা, দৈ।
ভোজন পর্বে খাদ্য রসিকেরা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। মহানন্দা পাড়ের এক ব্রাহ্মণ জমিদারের সঙ্গে বড়াল পাড়ের এক আশরাফ জমিদারের ভোজন প্রতিযোগিতা চলছে। কে কত খণ্ড ইলিশ ভাজা খেতে পারে; কে সাবাড় করতে পারে কয়টি লুচি, কে কয়টি রসগোল্লা খেতে পারে! পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে অন্য অতিথিরা। বিচারক ব্যর্থ হয় বিজয়ী নির্ধারণে। অগত্যা বুঘরা খান উভয়ের গলায় মণি-মুক্তার হার পরিয়ে দেয়।
সবাই একটু থিতু হলে হেকিম সাহেব সুলতানকে জিজ্ঞেস করে, আজ লখনৌতির কিন্নরকণ্ঠী দিল বাহারের গজল শোনার একটি অনুরোধ রাখা যায় কীনা!
বুঘরা খান সহাস্যে বলে, পণ্ডিত মহোদয় যদি তাঁর আদরের কন্যাকে অনুরোধ রাখেন; তবে সেটাই ভালো দেখায়।
পণ্ডিত মহোদয় বলে, এইখানে ভারতের গানের তোতা বলে খ্যাত খসরুজি উপস্থিত; দিলবাহারের মতো শখের শিল্পীর গান কি ভালো লাগবে অভ্যাগত অতিথিদের!
খসরু বলে, শিল্পী তো শখেরই হয়; যে সংগীতকে অন্তর থেকে পছন্দ করে; সে-ই সবচেয়ে ভালো গায়।
দিলবাহার মসলিন পর্দার ওপার থেকে অনেকক্ষণ না না করে। আজ আম খেয়ে গলা বসে গেছে; এমন একটা অজুহাত তৈরি করে।
হেকিম সাহেব বলে, আমি ছোট্ট একটি পাত্রে মধু মেশানো শরবত পাঠাচ্ছি; সেটা কণ্ঠের জন্য ভালো।
পদ্মা নদীর ধারের শ্যামল দিগন্তরেখা থেকে কোকিলের কুহুতান ভেসে আসে; নদীর স্রোতের আনন্দ প্রশ্বাস টের পাওয়া যায়। বজরার ওপরে ঘূর্ণি দিয়ে মাস্তুলে বসে দুইটি শালিক পাখি। সবার চাপাচাপিতে দিল বাহার রাজি হয়। সে বলে, প্রিয় অতিথিবৃন্দ কবি খসরুর সম্মানে আমি তার লেখা একটি গজল পেশ করছি। আপনারা আমার গায়কীর ভুল-ত্রুটি নিজগুনে ক্ষমা করবেন আশা করছি।
ও ও ও ও ও ও আ আ আ আ আ আ
নিম্বুয়া তলে ডোলা রাখ দে মুসাফির
আয়ি শ্রাবণ কি বাহাররে
আপনি মহলমে মে ঝুলা ঝুলাত থি
সাইয়া কি আয়ে কাহাররে
এরি সখি ঝুলা ঝুলনে না পায়ি
লে চলে ডোলিয়া কাহারে
আপনি মহলমে মে গুড়িয়া খেলাত থি
সাইয়া কি আয়ে কাহাররে
এরি সখি গুড়িয়া খেলহো না পায়ি
লে চালে ডোলিয়া কাহাররে
নিম্বুয়া তলে ডোলা রাখ দে মুসাফির
আয়ি শ্রাবণ কি বাহাররে।।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন