ওরে সখি মোর প্রিয় ঘরে এল (ছাপ তিলক: ২য় পর্ব)

১৮৬ পঠিত ... ০৯:৫৯, এপ্রিল ০৮, ২০২৪

2 (13)

লখনৌতি বাজারে তখন ভোর হবার প্রাণপ্রাচুর্য। সওদা নিয়ে বসেছে দোকানিরা। রঙ্গিন বস্ত্রের দোকান জুড়ে রঙের বাড়ই। তার পাশেই মশলার দোকান; সেখানে জাফরান-দারুচিনি-এলাচি-লবঙ্গের সৌরভ মৌ মৌ করছে; বিক্রি হচ্ছে চাক ভেঙ্গে নিয়ে আসা খাঁটি মধু। এক হেকিম সাহেব চোখে সুরমা দিয়ে জলচৌকিতে বসে ঝিমাচ্ছে। আমির খসরু সামান্য কেশে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। হেকিম জেগে উঠে বলে, এতো প্রত্যুষে একমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী ছাড়া আর কেউ আসে না।

 খসরু তাকে আশ্বস্ত করে, এ রোগী অতটা মুমুর্ষূ নয়; তবে চিকিতসা না পেলে কী হয় তা কে জানে!

 হেকিম জিজ্ঞেস করে, সমস্যা কোথায় জনাব!

: সমস্যা তো হৃদয়ে; কাল সাঁঝ থেকে ব্যথা করছে।

:  এ যদি খানা-খাজানা কিংবা অধিক পানাহার থেকে হয়ে থাকে; তবে তার চিকিতসা আছে। কিন্তু এ যদি প্রেম-বিরহের কোন জটিলতা হয়; তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন জনাব।

: কুয়োতলার পথে অনেক জটিলতা

কেমন করে ভরে নেবো জলপাত্র

জল ভরতে গিয়ে; হৃদকম্পে থরো থরো

ভেঙ্গে ফেলেছি আমার জলপাত্র!

: জনাব কি কাব্য-টাব্য করেন; তা পরিচয় কী জানতে পারি!

: খসরু; এ নগরে নবাগত এক।

: সে তো ঠাহর করতে পারি। লখনৌতির লোকেরা জানে মধ্যহ্ন পর্যন্ত আমার বিশ্রাম ও পুস্তক পাঠের সময়; রোগী দেখি অপরাহ্নে আর সাঁঝে।

: দুঃখিত হেকিম সাহেব অসময়ে বিরক্ত করার জন্য।

হেকিম শুষ্ক ফল পরিবেশন করে; কী যেন একটা বোতল থেকে ঢেলে দেয় এক পাত্র শরবত। স্মিত হেসে বলে, আপাতত এইটুকু নিন। দেখুন কাজ হয় কিনা! নইলে আবার সাঁঝে দেখা যাবে।

খসরু তাকে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিতে গেলে হেকিম বলে, লখনৌতির মানুষ অতিথি সেবা করে এর বিনিময়ে মুদ্রা নেয়না জনাব। আর ঐ যে এক ছত্র পদ্য শোনালেন; সেই তো হেকিমের সম্মানী। যান এবার ঘুরে দেখুন এ সুরম্য নগরী।

হঠাতই যেন মনে হয় রাজপথ দিয়ে যাওয়া একটা জুরি গাড়িতে পরিচিত একটা চোখে চোখ পড়লো। খসরু হেকিমের কাছে বিদায় নিয়ে অনুসরণ করতে থাকে জুরিগাড়িটিকে। পেছনে ফিরে ঘোমটা খানিক তুলে স্মিত হাস্যে কিছুক্ষণ স্থির চিত্র হয়ে থাকে দিলবাহার। জুরি গাড়িটা দ্রুতই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।

নগরীর দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত একটি প্রশস্ত ও সটান পথ চলে গেছে। বাজারে দোকানগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। যেন কেউ ছবির মতো এঁকেছে এ নগরী। মূল শহর থেকে উত্তর দিকে ফুলওয়ারিতে শোভিত প্রত্ন প্রাসাদ। আর নগরীর দক্ষিণদিকে নতুন একটি প্রাসাদ; যার সামনে ফোয়ারা। নগরীর রাজপথটি দৈর্ঘ্যে প্রায় দুই ক্রোশ; প্রস্থে প্রায় এক ক্রোশ। লখনৌতির ফুলওয়ারী, কমলবাড়ি, পটলচন্ডি, বল্লালবাড়ি, সাগরদিঘি, রামকেলী এলাকা জুড়ে প্রাণদায়ী জনবসতি।  আর তার পাশ জুড়ে ঘন আম্রবাগান। সেখানে আম্র মুকুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে।

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে জুরিগাড়িটাকে কোথাও খুঁজে পায় না খসরু। তবে দু'চোখ ভরে সমৃদ্ধ নগরীর সম্পন্ন পুরবাসীকে দেখে। পণ্যের মনোরম প্রাচুর্য; সবাই বেশ শিষ্ট, কোমল, আতিথেয়তা প্রবণ।

ফুলওয়ারিতে পাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নগরীতে নতুন এই অতিথিকে জোর করে মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হয়। দু'আঙ্গুলের ছাপ দেয়া গোলাকৃতি এই মিষ্টান্ন খসরু আগে কখনো খায়নি। ঘন দুধ জাল দিতে দিতে প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছালে তখন থিরথিরে ক্ষীর থেকে তৈরি হয় এমন শুকনো মিষ্টি। পরিবেশন করা হয় ক্ষীরসা ও দই।

খসরু বেশ আনন্দিত হয়ে বলে, আগার ফিরদাউস বার-রো-ই জমিন আস্ত

হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত।

সবাই সমস্বরে বলে, সাধু সাধু।

একজন পরমানন্দে বলে ওঠে,

এই পৃথিবীতে যদি কোন স্বর্গ থাকে

তা এখানে, তা এখানে, তা এখানে।

খসরুর পরিচয় পেতেই ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে সে। এক ভাবুক ধরনের লোক জিজ্ঞেস করে, শুধু কী মিষ্টান্নের জন্যই লখনৌতিকে স্বর্গ বলছেন হে কবি!

খসরু বলে, সম্পন্ন কৃষক, কারিগর, কবি, গায়ক, পণ্ডিত, আলেম; এই যে হিন্দু-মুসলমানের মিলন তীর্থ; তারপর মিষ্টান্নে অমৃতের স্বাদ; মানুষের মুখে মিষ্টভাষা; ব্রজবুলির মতো ধনিমাধুর্য। এ তো স্বর্গই। আর আমি এক স্বর্গের পরীরও দেখা পেয়েছি ভাই।

এক যুবক কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, আপনি একেবারে ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন। চলুন আপনাকে পণ্ডিত বাড়িতে নিয়ে যাই। ওবাড়িতে একটু হেদায়েতি কড়াকড়ি আছে; আবার কবিতা-গানের বেদায়েতি কোমলতাও আছে।

: দূর তাই কী হয়! যেঁচে কি নিমন্ত্রণ নেয়া যায় কোথাও!

: পণ্ডিত সাহেব আমার চাচা। তিনি খুবই খুশি হবেন; আপনি সেখানে আতিথ্য নিলে।

ফুলওয়ারিতে প্রত্ন প্রাসাদের পেছনে দোতলা একটা বাড়ি। সাদা মিহরাবে তার নিপুণ কারুকাজ। দরাজ দরোজা-জানালা জুড়ে মসলিন পর্দার ওড়াওড়ি। বাগানে হাস্নাহেনার সুবাস। থোকা থোকা হলুদ গাঁদা ফুল ফুটে আছে। দেয়াল ঘেঁষে লাল জবা ফুলের সারি। দোতলার জানালা দিয়ে এক ঝলক তাকিয়ে দিলবাহার বুঝতে পারে কবি ঠিকই ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে গেছে।

পণ্ডিত সাহেব গৃহে নেই। খুব সম্ভব বুঘরা খানের দপ্তরে জরুরি কোন সভায় অংশ নিতে গেছেন। যুবক বৈঠকখানায় সাদরে বসায় খসরুকে।

দিল বাহার পেস্তার শরবত নিয়ে মসলিনের পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে। তার চাচাত ভাই এসে তাম্রপাত্রটি নিয়ে যায় দিলবাহারের হাত থেকে। পরিবেশন করে খসরুকে।

পর্দার আড়াল থেকে দিল বাহার বলে, খসরুজি আমিও আপনার গজল দু'একটা গাইতে পারি। রোজ সকালে গলা সাধি। ওস্তাদ আসে গানের তালিম দিতে। আমার খুব শখ, আপনি আমাকে এমন একটি গজল লিখে দেবেন; আমি যেন গাইতে পারি; আসমুদ্র হিমাচলের গানের পাখিকে স্মরণ করে।

433966089_10231449740603076_1223424189007044651_n

দিল বাহারের ছোট ভাই লেখার জন্য পালক; কালি নিয়ে উপস্থিত। জলচৌকিতে একখণ্ড মসলিনের ক্যানভাস বিছিয়ে দিলে খসরু বুঁদ হয়ে লিখতে শুরু করে, আর গুন গুন করে গাইতে থাকে খেয়াল অঙ্গের গীতিকবিতা।

ওরে সখি মোর প্রিয় ঘরে এলো

ফাগুন লেগেছে এই অঙ্গনে

মোর প্রিয়কে  প্রণতি বার বার

চরণ লাগাইয়ো ওগো মোর জানে।

আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম আশার লগনে

মেহেদি আর ফুলের সিঁথি সাজিয়ে

দেখে সুরত  আমার প্রিয়র

হেরে গেছি  মোর তনুমনে।

যার প্রিয়র সনে কাটে শ্রাবণ

সে প্রিয়ার রহে সোহাগন

যে শ্রাবণে প্রিয় ঘরে নাহি

আগুন লাগে ঐ শ্রাবণে।

ওরে সখি মোর প্রিয় ঘরে এলো।

(চলবে)

 

তৃতীয় পর্বের লিংক

প্রথম পর্বের লিংক

১৮৬ পঠিত ... ০৯:৫৯, এপ্রিল ০৮, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top