প্রত্যেক ইদেই মন্টুর অন্য রকম খুশি। ইদের দিন সকালে নামাজে যাওয়ার আগে মা তাকে বিশ টাকা দেয়। কড়কড়া নোট। মা যে বাড়িতে কাজ করে সেই বাড়ির মালকিন মাকে কয়েকটা কড়কড়া নোট দেয়। যেদিন দেয়, মন্টু দেখেই বোঝে, মায়ের নাকফুল সেদিন অনেক বেশি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
নামাজ শেষে ফিরতি পথে বাজান দেয় দশ টাকা। দিয়ে বলে, যা, খরচা করগা!
এমন ভাব যেন দশ টাকায় গোটা দুনিয়া খরিদ করা যাবে! অবশ্য মন্টুরও তাই মনে হয়। ৩০ টাকা থাকলে দুনিয়ায় আর লাগে কী! মন্টুর সাড়ে নয় বছরের বুক তখন হঠাৎই খলবল করে ওঠে। চুল উলটে নেয় পানি মেরে। পকেটে হাত দিয়ে তিন বছর আগের ছোট হয়ে আসা পাঞ্জাবিটা উড়িয়ে সে বের হয়।
তিরিশ টাকা তার, পুরা তিরিশ টাকা।
ঈদে মন্টুর বাঁধা হিসাব।
পাঁচ টাকার সন পাঁপড়ি। এমন টেস্ট, উফ!
দশ টাকার গোলা বরফ। রঙিন রঙিন বরফে জাদু জাদু সুয়াদ।
আর থাকে পনের টাকা, তাতে সে শাকিব খানের সিনেমা দেখে। ইয়ালি ভিসুমম। শাকিব খান যখন চুল ওল্টায়, চুল ওল্টায় তখন মন্টুও।
সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে মন্টু। ইদ শেষ হয় তার। সব ইদ একই রকম আনন্দের। সুখ সুখ ঘোরের। ঘুমের ভেতর শাকিব খানের সাথে মন্টু গানও গায় ঘাড় বাঁকা করে। আজও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম হবে না। মায়ের দেয়া কড়কড়া বিশ টাকা পকেটেই। নামাজ শেষে পাবে বাপেরটাও। জমসে সন পাঁপড়ি খাবে এ খুশিতে এখনই মুখে হাসি আসি আসি করছে তার। মিজান্যাকে ডেকে নিয়ে খাবে নাকি একলা খাবে এরকম সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে মন্টু দেখে একটা কড়কড়া নোট। রাস্তায়। পাঁচশ টাকার। পড়ে আছে। আজব!
মন্টু চট করে টাকাটা উঠিয়ে নেয়। বুকটা প্রথমে ধড়াস করে উঠলেও এখন শুধু ঢিবঢিব করছে। তার পকেটে পাঁচশ টাকা। পাঁচশ! সত্যিই কি পাঁচশ?
মন্টু মিজান্যাকে ডাকতে যায় না। চলে যায় ঝিলের একপাশে। লুকিয়ে টাকাটা বের করে। না, পাঁচশই!
পাঁচশ!!
বিশ্বাস হয় না মন্টুর। মন্টু ঝিলের পাশে কতকক্ষণ বসে থাকে। তারপর উঠে যায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে। অকারণে ঢুকিয়ে রাখে। টাকাটা তার হাত স্পর্শ করে থাকলে মন্টুর ভালো লাগে।
মিজান্যা ডাকে, মন্টু শোনে না। মন্টু চলে যায়।
মন্টু চলে যায়, কোথায় যায় জানে না।
মন্টুর সন পাপড়ি খাওয়া হয় না। মন্টু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে।
মন্টুর গোলা বরফ খাওয়া হয় না। মন্টু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে।
মন্টুর সিনেমা দেখা হয় না। মন্টু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে।
সারাটা ইদ মন্টু একলা একলা ঘোরে। মন্টু পকেট থেকে হাত বের করে না। মন্টুর কিছু করাই হয়ে ওঠে না ইদে।
সন্ধ্যায় চোরের মতো ঘরে ফেরে মন্টু। মায়ের দিকে তাকাতে পারে না, বাবার কাছেও ঘেঁষে না। চুপচাপ শুয়ে যায় মন্টু। স্বপ্ন দেখে হাজার হাজার কড়কড়া পাঁচশ টাকা সে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। সবগুলো নোট সে পকেটে ভরছে হাতড়ে পাতড়ে। নোট আর নোট। কড়কড়া নোট। কড়কড়া নোট।
একটা এমন ইদ মন্টুর পার হয়ে যায় ঘুম, ঘোর আর স্বপ্নের ভেতর। এমন ইদ, যে ঈদে মন্টু এই প্রথম, কোনো আনন্দ পায় না। মন্টু বুঝতে পারে না, নয় বছর বয়সেই মন্টু, তার শৈশব হারিয়ে ফেলেছে এই ঈদে।
আর একবার শৈশব হারিয়ে ফেললে, মানুষের আর কোনোদিনই, ইদ ফিরে আসে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন