চাচা, চারপাশে এত বুলডোজার কেন? ন্যায়বিচার কোথায়?

৪৪৫ পঠিত ... ১৭:৫০, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৫

7

২০১৭ সাল থেকে ভারতের উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লিসহ অনেক জায়গায় বুলডোজার ন্যায়বিচার বা বুলডোজার জাস্টিস নামে একটা বিষয় লক্ষ করা যায়। মূলত বিচার বিভাগকে পাস কাটিয়ে কোনো ধরনের আদালতের আদেশ ছাড়াই সরকার বা দলীয় নেতাকর্মীরা মিলে বুলডোজার দিয়ে টার্গেটেড ব্যক্তিদের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ গুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভারতের বিচার বিভাগ বারবার এই ধরনের কাজকে অন্যায় বলে কোরাস তুললেও খুব একটা লাভ হয়নি। স্বাভাবিক, রাজনীতিবিদদের তো আর ঠ্যাকা পড়ে নাই আদালতের কথা শুনবে! ফলে বুলডোজার জাস্টিস ভারতের নিয়মিত ঘটনা। বিশেষ করে নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে বুলডোজার জাস্টিসও বেড়ে যায়। এই জাস্টিসের শিকার মূলত ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিরোধীপক্ষরা। ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠিও এই বুলডোজার জাস্টিসের অন্যতম শিকার।

বিজেপির অনেক নির্বাচনী মিছিল, শো-ডাউনেও বুলডোজার রাখা হয় শক্তির প্রতিক হিসেবে। বুলডোজার নিয়ে গিয়ে মানুষের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার জন্য অনেক রাজনীতিবিদের নাম হয়ে গেছে বুলডোজার বাবা, বুলডোজার মামা।

সম্প্রতি বাংলাদেশেও এই বুলডোজার জাস্টিসের আগমন ঘটেছে। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার গুড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি একটা বুলডোজার মিছিল কর্মসূচির ঘোষণা আসে ফেসবুকে। হাসনাত আবদুল্লাহও স্ট্যাটাস দিয়ে জানান, ধানমন্ডি ৩২ ভাঙা হবে। ‘বিপ্লবীরা প্রস্তুত তো’ লিখে সাথে অনেকগুলো হাতুড়ি, শাবলের ইমোজি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন, উৎসব হোক।

সব মিলিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে ভাঙচুর শুরু হয়। মাঝরাতে বুলডোজার ও ক্রেন নিয়ে এগিয়ে আসেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন।

এরপরের ঘটনা সবার জানা। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার থেকে শুরু হওয়া এই মব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সারদেশে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শেখ পরিবারের নামে থাকা হলের নাম পরিবর্তন করা হয়। কোথাও কোথাও ভাঙচুর করা হয় জাসদের মতো বামপন্থিদলগুলোর অফিসও। বগুড়ায় জাসদের অফিস ভেঙে সেখানে মসজিদের নির্মাণের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই ভাঙচুরকে কেন্দ্র করে গাজীপুরে সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যায়। অনেকে আহত হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি এই মব শুরু হলেও বন্ধ হয়নি। এই লেখা যখন লিখতে বসি তখনও হয়তো কোথাও না কোথাও বুলডোজার ন্যায়বিচার চলমান।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের ঘটনার মিল আমি খুঁজতে যাচ্ছি না। তাও কিছু জিনিস তো মিলেই যায়। কিছু অমিলও অবশ্য আছে। মিম-অমিল খোঁজার আগে পাঠকদের জন্য একটা কুইজ, বাংলাদেশের ঘটনায় যদি আমরা বুলডোজার মামা ও বুলডোজার বাবা অ্যাওয়ার্ড দেই তাহলে কারা কারা পাবে এই অ্যাওয়ার্ড? কমেন্টবক্সে জানাতে ভুলবেন না।  

মিল যদি খুঁজি, দুই দেশের ঘটনাই রাজনৈতিক। বুলডোজার দুই দেশের ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অস্ত্র। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া বুলডোজার ন্যায়বিচার ভারতে এখনও চলমান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে ঢুকে পড়া এই বুলডোজারও সহজে বের হবে না বলেই মনে হচ্ছে। আরেকটা মিল হল, ভারতের বুলডোজার দিয়ে কারও বাড়িঘর গুড়িয়ে দেওয়ার পর সেখানে মন্দির স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে দেওয়া হয়েছে মসজিদ স্থাপনের ঘোষণা।

অমিলও আছে। ভারতের ঘটনায় বিচার বিভাগ নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। বুলডোজার জাস্টিসকে এক ধরনের রাজনৈতিক ও জাতিগত নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এই ভুল একদমই করেননি। ভুল যাতে না হয়ে যায়, তাই বিচার বিভাগ এই ঘটনায় আপাতত হিমু হয়ে বসে আছেন। কিছু বলছেন না।

বিচার বিভাগ কিছু না বললেও চুপ করে থাকেননি ইউসুফ সরকার। ছুটেছেন সময়ের আগে। ৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিয়ে শুরু হওয়া এই ভাঙচুর প্রতিহত করার লক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটা বিবৃতি দিয়েছেন তারা। তারা লিখেছেন—

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিবৃতি

ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫: অন্তর্বর্তী সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছে। সরকার এ ধরনের কর্মকাণ্ড শক্তভাবে প্রতিহত করবে।  

অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রস্তুত। কোনো ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।

 

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিদ্যুতগতিতে ব্যবস্থা নিতে আর কোনো সরকারকে দেখা যায়নি। প্রাউড অফ ইউ ইউসুফ সরকার।

এদিকে ভাঙচুর শুরু হওয়ার দুইদিন পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, উপদেষ্টা মাহফুজ আলমসহ আরও অনেকেই মানুষকে শান্ত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। বাংলায় একটা কথা আছে, শাসন করা তারই সাজে, আদর করে যে। আমরাও বলতে পারি, শান্ত হওয়ার আহবান করা তারই সাজে, অশান্ত হতে বলে যে।

প্রধান উপদেষ্টা ও তার উপদেষ্টাদের এই চেষ্টাকে আমরা সম্মান জানাই। দুইদিন পরেও হলেও তারা অন্তত চেষ্টা করেছেন মানুষকে শান্ত করার। তবে আরেকটু বিচক্ষণ হলে তারা জিনিসটা আগেও থামাতে পারতেন। হাসনাত আবদুল্লাহ ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পরে যখন ফেসবুকে পোস্ট দিলেন, ৩২ নাম্বারের মূল উৎপাটন করার। সেই পোস্টটা উনি দিতে পারতেন, মানুষকে শান্ত থাকার জন্য। প্রধান উপদেষ্টা শান্তির দূর, শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। উনি নিজেও ৫ তারিখেই বলতে পারতেন, হে দেশবাসী। আপনারা শান্ত হোন। প্রয়োজনে আমার নোবেল নিয়ে যান। আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও ৫ তারিখেই করতে পারতেন মানুষকে শান্ত থাকার আহবান।

এক পর্যায়ে ভাঙচুর শেষে দেশবাসীকে শান্ত রাখার জন্য হাজির হয়েছেন দার্শনিক ফরহাদ মজহার। তিনি এই ঘটনার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ি করেছেন। ভাঙচুর, হামলা ও বুলডোজার জাস্টিসকে বৈধতা দিতে হাজির করেছেন ‘ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ’ নামে গালভরা নতুন টার্ম। ব্যাপারখানা এমন, কারও কথায় আপনার ক্ষোভ তৈরি হলে আপনি গিয়ে তার বাড়িঘর ভাঙতে পারবেন, এটি ন্যায়সঙ্গত হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে বুলডোজার জাস্টিসের পর আমরা নিশ্চয়ই আরেকটা নতুন বিচারিক প্রক্রিয়া পাব। যার নাম হবে, ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ জাস্টিস। অর্থাৎ কারও উপর আপনার ক্ষোভ জন্মালে আপনি তাকে আঘাত করতে পারবেন, তার বাড়িঘর-সম্পদ ভাঙচুর ও লুট করতে পারবেন। আদালতের কোনো ধরনের আদেশের অপেক্ষা করতে হবে না।  

যাইহোক। লেখা শেষ করা যাক। শেষ করার আগে পাঠকদের জন্য একটা কুইজ।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কে ক্ষমতায়? ইউসুফ সরকার, বুলডোজার সরকার, মব সরকার, হাসনাত সরকার নাকি পিনাকিও সরকার?

 

৪৪৫ পঠিত ... ১৭:৫০, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top