সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন এ সময়ের অন্যতম সেরা পরিব্রাজক লিলিয়ান জেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে নিজ চোখে দেখা বিষয়গুলো নিয়ে, সেই দেশ সম্পর্কে নিজের ব্লগে গল্প লিখেন তিনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার খুব আবছা ধারণা ছিল বলে বেশ আগ্রহ নিয়েই আমাদের এখানে এসেছেন তিনি। তাকে নিয়ে ঢাকা শহর ও দেশের অন্যান্য বিখ্যাত জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছেন আমাদের eআরকির ভ্রমণ গ্রুপের কয়েকজন চৌকস সদস্য। অন্য আরেকটা দেশের নাগরিক যেন দেশ সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য কোনোরকম সাজানো গোছানো ঘটনা ঘটে এমন সব জায়গায় না নিয়ে গিয়ে, তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বিভিন্ন স্পটে।
লিলিয়ান এয়ারপোর্টে আসার পর এয়ারপোর্টের বহিঃনির্গম পথে ধুপের ধোঁয়া দেখে প্রথমেই বলে ওঠেন যে, বাংলাদেশের অতিথিপরায়ণতার লেভেলটাই যেন অন্য রকম। সারা বিশ্ব থেকে মানুষ প্লেনে করে এদেশে আসে, সাথে নিয়ে আসে বিভিন্ন জানা অজানা রোগের জীবাণু। সেই জীবাণুগুলো যেন দেশে ছড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য এখানের এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ একপ্রকার জীবাণুনাশক ধোঁয়া স্প্রে করছে। আর এই ধোঁয়াটাও অনেক বেশি অর্গানিক। দেশে ল্যান্ড করেই তার মনটা এত ভালো হয়ে গেছে যে তিনি এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হোটেলে না গিয়ে ঢাকার আনাচে-কানাচে ঘুরতে চান বলে জানান।
তাকে নিয়ে শাহবাগ ,সায়েন্সল্যাবে আসা হয় মানুষের গন জমায়েত দেখানোর জন্য। দুপুরের দিকে শাহবাগে এসে তিনি জব্বর একখান মজা পেয়ে যান। কোনো ছুটি নেই, কিছু নেই, তারপরও এখানের মানুষরা কতটা মিশুক আর সামাজিক হলে দুপুরে সবাই একসাথে হই হুল্লোর করতে পারে! সেটা ভাবতে ভাবতে দেখেন যে, শুধু একসাথে মানুষ জড় হয়েছে এমন না, সবাই মিলে একত্রে গান গাইছে, আড্ডা দিচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে উদযাপনের। বাংলাদেশের মানুষের সামাজিকতা, অতিথিসেবা সম্পর্কে তার হাল্কা ধারণা ছিল। শাহবাগে এসে তার ধারণা আসলে কতটা ক্ষুদ্রপরিসরে ছিল সেটা বুঝে, তার সাথে থাকা টিমকে নিজের দুঃখ প্রকাশ করেন।
eআরকি টিমের সাথে তিনি ঘুর ঘুর করে বেশ মজা পেয়ে যান। রাতে কোনো হোটেলে থাকবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। টিমের মেসেই থেকে যেতে চান তিনি। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইউনিভার্সিটির ডর্মে থাকার স্মৃতিটাকেও হাল্কা ঝালাই করে নিতে চান। মেসে এসে বুয়ার হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করার ভাষা যেমন হারিয়ে ফেলেছিলেন, তেমনি হারিয়ে ফেলেছিলেন রাতে ঠিক কবার টয়লেটে গিয়েছিলেন তার হিসাব।
এরপর তাকে নিয়ে ঘুরার জন্য বের হওয়ার দিনটা ছিল বৃষ্টি বিঘ্নিত। সকাল থেকে টাপুর-টুপুর বৃষ্টি পড়লেও আস্তে আস্তে বেগ বাড়ে বৃষ্টির। দেখতে দেখতে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ছোটোখাটো ভেনিস শহরে রুপ নেয়। ছোটো ছোটো নৌকার দেখা মেলা শুরু হয় নৌপথে। ঢাকায় এসে এমন একটা দৃশ্য দেখে যাবেন ভাবেননি। তিনি জানান, বেশ কিছু বছর আগে শেষ বার ভেনিসে যাওয়া হয়েছিল তার। নৌকায় আরামবাগ থেকে ধানমণ্ডি ঘোরার অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতে একটা ব্লগও লিখবেন তিনি। টাইটেল ঠিক করেছেন মাই জার্নি বাই বোট অন ঢাকা সিটি।
লিলিয়ান ঢাকার রাস্তাগুলোকে তুলনা করেছেন এথেন্স কিংবা রোমের সাথে। এখানে একটা লোকাল বাসে চড়েই সারা ঢাকার সবগুলো জায়গা সময় করে ঘুরে দেখা যায়। সাথে খাওয়া যায় এদেশের বিখ্যাত সব রোড সাইড খাবার। এছাড়া অন্য সব দেশগুলোতে সাইট সিইঙে বের হতে কয়েকশো পাউন্ড খরচ করা লাগলেও এখানে নাম মাত্র মূল্যে সব ঘুরে দেখা যাচ্ছে।
লিলিয়ান নতুন ঢাকা ঘুরে যেতে চান পুরাতন ঢাকার অলিতে-গলিতে। পুরান ঢাকার অলিগলির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলছিলেন, তার নিজেকে মেজ রানারের মতো লাগছে। একটা শহর কতটা আধুনিক মনস্ক হলে মেজ রানারের আদলে গোটা একটা শহর বানিয়ে ফেলতে পারে। একটা গলি ঠিক কোথায় শুরু হয়ে, কোথায় শেষ হচ্ছে তা যেমন বোঝার উপায় নেই, তেমনি সামনের মানুষটা একটু পর ডানে যাবে না বামে যাবে সেটাও বোঝা যায় না। যারা নিজেদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং প্র্যাকটিস ঝালাই করে নিতে চান, তাদের জন্য পুরাতন ঢাকায় হাঁটা হাইলি রেকমেন্ড করেছেন লিলিয়ান।
পুরান ঢাকার আরেকটা বিখ্যাত জায়গা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। সারাবিশ্বে তিনি স্বচ্ছ পানির নদী দেখলেও, এখানে এসে জীবনে প্রথম বারের মতো কালো পানির নদী দেখে বিস্মিত হয়েছেন। এমন নদীর অস্তিত্ব যে পৃথিবীতে আছে সেটা তার জানাই ছিল না। এমন এক আশ্চর্যকর নদী দেখানোর জন্য eআরকির দলকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
ফেরার পথে লিলিয়ান বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক উচ্চ একটা ধারণা যে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন সেটা বোঝানোর জন্য সুন্দর একটা কবিতাও লিখেছেন ইংরেজিতে। পাঠকদের জন্য অনুবাদ আকারে লেখা হচ্ছে এখানে;
আমি মনে হয় আজীবন ঢাকাতেই থাইকা যাইতাম
শুধু মাত্র যদি পৃথিবী ঘোরার নেশা ছুটাইতাম
আমি আসলে অনেক কিছু ছাইড়া আসা লোক
ঢাকাও ছাইড়া যাইতেছি, পেছনে ফালাইয়া বুড়িগঙ্গার লোভ
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন