ঘটনাটা আমরা আর কখনোই কাউকে বলি নি।
আমরা মানে আমি আর মাহফুজ।
বছর দেড়েক আগের হবে বোধহয়। তখন দেশজোড়া খ্যাতি পাওয়া ফান ম্যাগাজিনটা বন্ধ হয়নি। তবে, মাঝে মাঝে, প্রায়ই শুনি যে বন্ধ হয়ে যাবে! আমরা যারা তাতে লিখি তারা সে কথায় বিপুল হতাশ হয়ে আরো বেশি করে লেখা পাঠাতে থাকি।
ম্যাগাজিন বন্ধ হয় না। চলতে থাকে। মানুষ আর কিছু না পড়লেও, সেই দিন, সেই ম্যাগাজিন পড়ে বলে আমরা যারা লিখি, তারা গর্ব করি।
ম্যাগাজিনটা কখনো কখনো বিষয়ভিত্তিক হতো।
মানে এই আজকে হরতাল নিয়ে তো সামনের সপ্তাহে আবার ক্রিকেট নিয়ে। তো একবার ঠিক হলো ম্যাগাজিনটা হবে ভূত নিয়ে।
আমরা বলতাম-- ইস্যু!
মাহফুজ ফোন করে বলল, ভাই, ইস্যু তো ভূত!
ভূতে আমার বিশ্বাস নাই সত্য, কিন্তু ভূতদের নিয়ে ফান করার ইচ্ছাও আমার নাই! যা বিশ্বাস করি না, তা এই দুনিয়ায় থাকবে না এমন কোনো গাছপাথর তো নাই!
আমি বললাম, আমি তো ব্যস্ত আছি একটা কাজ নিয়া... এই সংখ্যায় লেখা নাই দিই মাহফুজ!
মাহফুজ ফোনের ভেতরেই গড়্গড়িয়ে উঠল৷ বলল, কী বলেন! গত সংখ্যাতেও আপনি লেখা দেন নাই! এইটা নিয়ে কতগুলা মেইল আসছে জানেন? সবাই আপনার লেখার খোঁজ করছিল! ২৩টা মেইলের মধ্যে ১৭টায় মেয়েভক্তের। পাঠকের কথা ছেড়ে দেন, অন্তত পাঠিকার কথা ভেবে লেখেন ভাই!
তা মাহফুজ এইসব করত আর কি। মানে লেখকদের চাঙ্গা রাখতে এইসব বানিয়ে বানিয়ে বলত। একবার ওদের পত্রিকার অনুষ্ঠানে যায় নি, সে বলে ১১ জন অটোগ্রাফ নিতে আসছিল আপনার... সবাই ফিরে গেছে। তিনজন শুধু পেয়েছে!
'আমি তো নাই। তিন জন ক্যামনে পাইল?'
'মিঠু আপনার প্রক্সি দিছে ভাই! ছবিও তুলছে। তিনজনই পাঠিকা। মিঠু ওদের ফোন নাম্বারও দিয়েছে!'
পরের অনুষ্ঠানে আমি ভালো একটা পাঞ্জাবি পরে অনুষ্ঠানে গেলাম। পকেটে দুইটা কলম রাখলাম। একটার কালি ফুরিয়ে গেলে আরেকটা দিয়ে যেন অটোগ্রাফ চালিয়ে যেতে পারি-- অটোগ্রাফ মাস্ট গো অন!
কিন্তু কোথায় কী! সবাই মিঠুর সাথে ছবি তুলল আর আদনান মুকিতের অটোগ্রাফ নিলো। আমার নাম কেউ মুখেই আনল না। ওরা বলল, আমি নাকি ফান ম্যাগাজিনের ভাসুর! ফলে কেউ নাম নিচ্ছে না!
ফলে মাহফুজের এই তুঘলকি কথা আমি ঠিক বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি বিশ্বাস না করলেই যে দুনিয়াতে তা নাই, তাও তো না! যদি সত্যি পাঠক (বিশেষত পাঠিকা) আমার খোঁজ করে...
অতএব, গভীর রাতে ভূতদের নিয়ে মজা করতে বসলাম আমি। সামনে ল্যাপটপ, চোখে ঘুম, এবং মাথা যা-তা রকমের ফাঁকা। ফাঁকা মানে ফাঁকাই!
ওদিকে যা হয়, যেদিন মাহফুজ লেখা চায়, তার পরের দিনই থাকে পেস্টিং! মানেটা হলো একটু যে সময় নিয়ে ভাববেন সে উপায় তো নাই একেবারে! যা ঘটানোর এ রাতেই ঘটাতে হবে... অদ্যই শেষ রজনী!
ভোরের দিকে একটা লেখা শুরু করলাম--শ চারেক শব্দ লেখার পর জব্দ হয়ে তব্দা মেরে বসে থাকলাম। এগোচ্ছে না-- চারশ শব্দ সিলেক্ট অলে ধরে দিলাম ডিলেট করে। বুঝে গেছি হবে না...
মাহফুজকে টেক্সট করলাম, পারছি না কিছু... বাদ দেন!
সকালে অফিসের ফাঁকেই মাহফুজের টেক্সট আসলো--অসুবিধা নাই। অন্য সবার লেখা পেয়ে গেছি...হয়ে যাবে!
নিশ্চিন্ত হলাম ঠিকই, কিন্তু মনটা একটু খারাপও হলো। পরপর দুই সংখ্যায় লেখা যাচ্ছে না। যদি সত্যিই পাঠক (পড়ুন পাঠিকা) খোঁজে আমাকে! কিন্তু এখন তো কিছু করারও নেই। পাতার পেস্টিং হচ্ছে!
সোমবার সকালে ঘুম ভাঙল রাসেল ভাইয়ের ইনবক্সে। লেখা--ভাইজান খুব ভালো লেখা হয়েছে। হাসতে হাসতে শেষ!
আমার ঘুম চটকে গেল! এখন পরিচিত পাঠকরা পর্যন্ত রসিকতা করে আমার সাথে। আমি ঘুম ঘুম চোখে লিখলাম--কী লেখা?
উত্তর আসলো--আপনার গল্পটা ভাই... ভূতের রাজ্যে আমরা অদ্ভুত!
আমি উঠে বসলাম। বাসায় পত্রিকা আসা বন্ধ। বাইরে গিয়ে পত্রিকা কিনে দেখলাম ফান ম্যাগের কভারে এই গল্প। আমার নামসহ জ্বলজ্বল করছে...
কার না কার গল্প আমার নামে ছাপা হয়েছে। এইটাই তাহলে সেই বিখ্যাত ছাপাখানার ভূত!
মাহফুজকে ফোন দিলাম--ওইটা কার গল্প?
'কোনটা?'
'যেটা ছাপা হয়েছে... '
'ছাপা তো সবই হয়েছে।'
'আরে আমার নামে যেটা ছাপা হয়েছে।'
'আপনার নামে আবার কী ছাপা হয়েছে?'
'ঘুম থেকে ওঠেন। চোখে পানি দিয়ে দেখেন!'
মাহফুজ ফোন কেটে দিলো। আমি এই ফাঁকে পুরো গল্পটা পড়ে নিলাম। ছোট গল্প। চারশ শব্দের। কিন্তু গল্পটা বেশ৷ ভূতরাজ্য খুবই অদ্ভুত একটা জায়গা। এখানে কারো কোনো নিরাপত্তা নাই। যে কেউ যে কোনো কিছু করতে পারে। যেহেতু তারা ভূত তাই খাবারে ভেজাল আছে কিনা তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই। আবার তাদের কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা নাই। কারণ ভূতদের স্বাস্থ্যের অবনতি আর কী হবে! রইছেই তো শুধু কখানা হাড়!
এইসব বিতং করে লেখা। এত বিতং শুধু মুকিতই লিখতে পারে!
মাহফুজ ফোন দিলো। আমি ধরেই বললাম, মুকিতের লেখা না?
'না ভাই।'
'মিঠু তাইলে আজকাল এইগুলা লিখছে?'
'মিঠুর লেখা তো ভিতরে আছে ভাই।'
'আকিব তাহলে? বেশ ম্যাচুরিটি চলে আসল ছেলেটার মধ্যে দেখতে দেখতে!'
'আকিবের তো এক্সাম... কোনো লেখা সে দেয় নি!'
'তাহলে কে?'
'আমিও তো ভাই বুঝছি না। এরকম কোনো লেখাই তো পেস্টিঙে ছিল না!'
'বলেন কী?'
আমরা চুপচাপ ফোন রেখে দিলাম। বিষয়টা চেপে যাওয়াই ঠিক কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সন্ধ্যার দিকে মাহফুজের আবার ফোন। বলল, 'ভাই, একটু আসতে পারবেন অফিসে?'
টিপটিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। অফিসের সামনে যেতেই উদবিগ্ন মাহফুজ নেমে এল। মুখে চোখে হতবিহবল অবস্থা। চট করে এদিক ওদিক দেখে পকেট থেকে ফস করে একটা বাক্স বের করল। উত্তেজনায় আমারও কেমন যেন লাগছে। বললাম, 'কী... কী এইটা?'
'পার্সেল আসছে একটু আগে... দে..দেখেন!'
আমি ছোট বাক্সটা খুললাম। ভেতরে দুটো ট্রেনের টিকেট। এসি। টিকেটে লেখা-- বাংলাদেশ ভূতওয়ে। একটা টিকেটের গায়ে মাহফুজের নাম লেখা আরেকটায় আমার...
মাহফুজ কেঁপে যাওয়া কণ্ঠে বলল, আজ সাড়ে এগারটায় ট্রেন... যাযাবেন?
বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে আসল। আমি আর মাহফুজ ল্যাম্পোস্টের আলোয় পরস্পরের দিকে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন