আমাদের বাড়ির সামনে দেয়ালের বাম কোন বরাবর রাস্তার পাশে একটা রেইনট্রি ছিলো। এরকম রেইনট্রি; কৃষ্ণচূড়া ও শিমুল গাছ ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে। ছোটবেলায় ঝড় বৃষ্টির দিনে রেইনট্রিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একদিন রাস্তা উন্নয়নের নামে এই গাছ ও অন্য গাছগুলো কেটে ফেলা হলো।
তৈরী হলো ডিভাইডার। ফুটপাথ। দু’পাশে জায়গা ছেড়ে গাছ লাগানো যেত হয়তো। রাস্তাটা তাতে সামান্য সরু হতো।
নির্বোধ আমাদের বুঝ দেয়া হলো ডিভাইডারের মাঝে একধরনের দেবদারু জাতীয় বৃক্ষ লাগিয়ে। যার বেশিরভাগ মরে গেলো বছর না ঘুরতেই। কিছু বাঁকা হয়ে পড়ে গেলো রাস্তায়। ঝড় বৃষ্টি হলেই শুয়ে পড়লো আপোসে।
এরপর শুরু হলো ভাঁওতাবাজি। এই রাস্তায় প্রতিবছর একবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাতায়াত করতেন কোভিডের সাল এর আগ পর্যন্ত।
এলাকার এমপি নার্সারি থেকে টবের গাঁদাফুল সহ ঝোপ ঝোপ গাছ এনে লাগিয়ে দিতেন আগের রাতে। মনে হতো আহা! যেনো সিঙ্গাপুর। একসপ্তাহ যেতে না যেতে ফুল ও ফুলগাছ মরে শুকিয়ে যেতো। আইল্যান্ড হয়ে যেতো মরূভূমি। সিটি কর্পোরেশনের ক্লিনাররা সেগুলো উপড়ে ফেলে রাস্তাকে ময়লামুক্ত করতো। এই ভন্ডামী কোভিডে এই যাতায়াত না থাকায় বন্ধ হয়েছে আপাতত।
তারপরেও কিছু গাছ টিকেছিলো।
এবার ডিভাইডারে এস এস গ্রিল লাগাতে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন পুরো রাস্তাটিকে বৃক্ষশূন্য অসবুজ তাপযন্ত্রে পরিণত করেছে।
এলাকার কিছু বাড়ির মালিক ছাদে গাছ তুলেছেন। ছাদবাগান নামের কুৎসিত কাজটি তারা বাধ্য হয়ে করেছেন বটে কিন্তু একটা আমগাছ কি সত্তুর আশি ফিট লম্বা হয়? এই বাড়ীগুলোতে আম নিম আতা পেয়ারা গাছ সব মাটি থেকে সত্তর আশি ফিট উপরে। গাছের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলে বুঝবেন এটা আসলে গাছের ওপর নির্যাতন। তাকে তার স্বাভাবিক উচ্চতায় জন্মাতে না দিয়ে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়া। আর গাছে পানি দেয়ার ফলে ওয়াসার পানির শ্রাদ্ধ চলছেই।
আমার পিতাও শাইখ সিরাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই ছাদবাগান করেছেন। আশে পাশে অনেকেই করেছেন।
গাছ কেটে; গাছকে ছাদে তুলে বৃক্ষবিধ্বংসী সিটি কর্পোরেশন উন্নয়নের নামে শহরকে ওভেনে পরিণত করেছে। তারপর একজন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছে।
এই নিয়োগ লোকাল অথরিটি দেয়। বিদেশিরা তাকে গাইড করে ও বেতন দেয়। এটা ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে আছে। এই সংবাদ জেনে লোকজন ট্রল করতে শুরু করেছে।
এইসব ট্রলের কিছু কিছু বেশ আপত্তিকরও ছিলো।
সাথে সাথে কিছু সহমত ভাই নেমে পড়েছেন। একদল হিট অফিসার কত যোগ্য সেটা বোঝাচ্ছেন। আরেকদল বলছেন হিট অফিসার মেয়ে বলে…
তাপে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক বা মগজ। এদের মগজ এতোই ফ্রাই হয়েছে যে বুঝতেই পারছেন না; লোকে তাদের ক্ষোভ ঝাড়ছে অন্য কারণে।
জনগণের বিপুল(!) ভোটে বিজয়ী মেয়র সিটি কর্পোরেশনে একটি ফরেন ফান্ডেড লাভজনক পদ সৃজন করে সেখানে কন্যাকে নিয়োগ দিয়েছেন বা নিয়োগে আপত্তি করেন নাই। যেভাবেই হোক, এটা শুদ্ধাচার এর পরিপন্থি; কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।
এই পদ কোন ফাউন্ডেশন সৃজন করে নাই। তাদের টাকায় বা অনুরোধে কর্পোরেশন সৃজন করেছে ও এতে মেয়রের কন্যার নাম প্রস্তাব করেছে।
মানুষ এটা ভালোভাবে নেয় নাই।
আর বৃহত্তর ক্ষোভের জায়গা খুবই পরিষ্কার। এই শহরের সব গাছ কেটে নতুন করে গাছ লাগানোর জন্য এসব পদ সৃজনকে মানুষ নির্লজ্জ দ্বিচারী আচরণ মনে করেছে। সহজ ভাষায় ভণ্ডামি।
গাছ কেটে শহর উত্তপ্ত করে এসব পদ সৃজন এখন কেন? কথা তো ছিলো একটা গাছ কাটলে দুটো গাছ লাগানো হবে।
এই ক্ষোভকে আমলে না নিয়ে সহমতেল ভাইরা তেলের শিশি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দু’লাখ গাছ লাগাবেন বলেছেন উত্তরের মেয়র। এর আগে আনিসুল হক বলেছিলেন তিন লাখ।
একটা চ্যালেঞ্জ দেই। দু’লাখ গাছ লাগিয়ে জিআইএস ম্যাপিং করে প্রত্যেকটা গাছের ইউনিক নাম্বার দিয়ে দেন। ছবি তোলেন। ছয়মাস পর পর ছবি তুলে দুবছর গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
আমার শৈশবের সেই রেইনট্রিটার কথা মনে পড়ে। রেইনট্রিটার গায়ে একটা লাল টিন পেরেক দিয়ে আটকে লেখা ছিলো বাসস্টপ। আমি নিশ্চিত দু’লাখ গাছ এর খবর কেউ নেবে না।
হিসাব করবে টাকার অংক। গাছ লাগাতে ও বাঁচাতে বরাদ্দ হবে।
রেইনট্রিটার ভাষা থাকলে এখন সেটাও ট্রল করতো। অভিশাপ দিতো সিটি কর্পোরেশনের করাতধারীদের।
গাছ লাগাতে নাহয় চিফ হিট অফিসার দরকার। গাছ কাটা বন্ধ করতে কোন অফিসার লাগবে? আপনাদের এই হৃদয়হীন লজ্জাহীন তামাশা থেকে আমাদের মুক্তি দিন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন