ফেসবুকে 'বনলতা সেন' কবিতাটি লিখে জীবনানন্দ দাশ যেভাবে গ্রেফতার হলেন

২৫১৫ পঠিত ... ১২:৩৭, মে ০৭, ২০২০

অলংকরণ: মুবতাসিম আলভী

জীবনানন্দ দাশের ফেসবুক ফ্যানপেজে সকালবেলা আপ হলো ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি।

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

আপ হতে না হতেই কয়েক হাজার লাইক আর কয়েক শ কমেন্ট পড়ে গেল। দুপুর গড়াতে গড়াতে শেয়ারে শেয়ারে ছড়িয়ে পড়ল সেটা। আর বিকেল গড়ানো সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারের আলুর দোকানের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হলেন জীবনানন্দ। পুলিশ আর জীবনানন্দের মধ্যে কথোপকথন হলো নিম্নরূপ—
: আপনি জীবনানন্দ?
: জি।
: আপনি ‘বনলতা সেন’ লিখছেন?
: জি?
: এখন এই রকম ভ্যাবলার মতো তাকায়া আছেন ক্যান? পদ্যে তো বিরাট বিরাট কথা লিখছেন! এক হাজার বছর ধইরা নাকি আপনি হাঁটতেছেন? আপনি কি হাঁটাবাবা? নাকি আপনার বাতের ব্যথা, না হাঁটলে ঘুমাইতে পারেন না?
: জি?
: আর ‘জি জি’ না কইরা থানায় চলেন! আপনারে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হইল!

.

থানায় বসে আছেন জীবনানন্দ। বড়কর্তা এসে বসলেন তাঁর সামনে। জীবনানন্দ করুণ মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আপনারা আমাকে ধরছেন কেন?’
: দেখেন, সকলেই কবি না, কেউ কেউ পুলিশও। কবির কাজ যেমন কবিতা লেখা, তেমনি পুলিশের কাজ ধরে নিয়ে আসা। আপনি কবিতা লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন নিয়ে। বনলতা তো আপনার ওপর ক্ষিপ্ত! আপনি তার মানসম্মান সব ক্ষুণ্ন করেছেন! কী যেন লিখছেন, অ্যাঁ? আমি এক ক্লান্ত প্রাণ আর চারদিকে নাকি আপনার খালি ফেনা ফেনা সমুদ্র আর তার মধ্যে নাকি বনলতা সেন আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছে, অ্যাঁ?
: আসলে স্যার, আমি...
: শোনেন, লেখার সময় তো আপনাদের মনে থাকে না কী লিখছেন, কতটুকু লিখছেন, অ্যাঁ...এই যে আপনি বনলতার নাম নিলেন, বললেন তার চুল নাকি কবেকার অন্ধকার আর শ্রাবন্তি না কী...আবার আপনি বললেন তারে অন্ধকারে দেখেছেন, অ্যাঁ...অন্ধকারে কেমনে দেখা যায়? আপনি শেয়াল না হায়েনা? আর সেই অন্ধকারের মধ্যেই নাকি বনলতা আপনার খোঁজখবর নিছে, জিজ্ঞেস করছে যে এত দিন কোথায় ছিলেন? তা সে আপনাকে জিজ্ঞেস করার কে? তার সঙ্গে আপনার কিসের রিলেশন?
: কার সঙ্গে?
: বনলতার সঙ্গে!
: তার সাথে আমার কোনো রিলেশন নাই, স্যার!
: বাহ্! যে মেয়েটার সাথে আপনার কোনো সম্পর্কই নাই, তাকে নিয়ে এ রকম টসটসা কবিতা লিখে ফেললেন, অ্যাঁ? তা-ও আবার বনলতার সাকিন উল্লেখ করে? নাটোর? নাটোরে আপনি কয় দিন থাকছেন?
: এক দিনও না, স্যার। আমি কোনো দিন নাটোর যা-ই নাই!
: যাবেন, এইবার যাবেন। আপনার কবিগিরি এইবার ছুটে যাবে!
: স্যার, স্যার, আমি কবি না, আমি আলু-পটোলের ব্যবসা করি।
: চোপ! পুলিশের সাথে মিথ্যার ছন্দ মিলাতে আসবেন না। পুলিশ ছন্দ পছন্দ করে না। একটা অচেনা অর্ধচেনা মেয়েকে নিয়ে আপনি যা লিখেছেন...কী যেন বলছেন আপনি যে থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসবার বনলতা সেন! ছি ছি ছি! এই কথা লেখার আগে একবারও ভাবলেন না, বনলতা সেনেরও একটা ফ্যামিলি আছে, অ্যাঁ? তার বাবা-মা-ভাই-বোন কী মনে করবে? আপনি মানুষ? দেশের সবার সামনে আপনি একটা মেয়ের এইভাবে বদনাম করতে পারলেন? বিবেক নাই আপনার? একবারও ভাবলেন না, বনলতা সেনের এখন বিয়ে হবে কীভাবে?
: আমি ভাবব ক্যান? আমি তো এই কবিতা লেখি নাই। আমি জীবনানন্দ দাশ না, হ্যারে আমি চিনিও না! আমি জীবনানন্দ প্রামাণিক। আলু-পটোলের ব্যবসা করি। স্যার, আমারে ছাইড়া দেন! ক্ষমা করেন!
: চাইলেই কি এখন আর ক্ষমা পাওয়া যাবে, কবি সাহেব? যতই ভুজুরভাজুর বোঝান না ক্যান, লাভ নাই! দেশে এখন নতুন আইন, নতুন ধারা, বুঝলেন না, অ্যাঁ? আপনাকে নাটোরে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে...ওখানেই সব ক্লিয়ার হবে!
: স্যার, ছাইড়া দ্যান, স্যার!
: ছাড়া না-ছাড়ার মালিক আমরা নাকি? নাটোরে যান, ওইখানে বনলতা সেনরে খুঁইজা বাইর করেন। তার কাছে আগে ক্ষমা চান, তারপর অন্য কথা! কিন্তু তার জীবন নিয়ে আপনি যে জীবনানন্দগিরি করছেন, তাতে মনে হয় না আপনার কপালে ক্ষমা আছে! যান...

জীবনানন্দ আরও কয়েকবার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু বড়কর্তা কিছুই মানলেন না। জীবনানন্দ প্রামাণিককে নিয়ে পুলিশের ভ্যান বেরিয়ে পড়ল নাটোরের উদ্দেশে, বনলতা সেনের খোঁজে।

[পূর্বে রস+আলোতে প্রকাশিত]

২৫১৫ পঠিত ... ১২:৩৭, মে ০৭, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top