ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জামালউদ্দীন সবসময় আওয়ামী লীগের অবচেতনের চিন্তাটাকে জনসমক্ষে এসে প্রকাশ করেন। গত নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানে এত ভোট টোট দিয়ে আর কী হবে; উন্নয়নের ঠোঁটের আলাপটাই আসল।
সম্প্রতি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির জাস্টিফিকেশন তিনি খুঁজেছেন ধর্মগ্রন্থে। পবিত্র কোরআনে নাকি বলা হয়েছে, যুদ্ধে বিজয়ী দল একটি দেশের ৮০ শতাংশ সম্পদের অধিকার সংরক্ষণ করে। বাকি ২০ শতাংশ থাকে দুস্থ ও এতিমের জন্য।
আওয়ামী লীগের অবচেতনের চিন্তাটা ঠিক এরকম। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ; অতএব মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ সম্পদের ওপর অধিকার তাদের। আওয়ামী লীগের গত পনেরো বছরের শাসনকালে এই নীতিই অনুসৃত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ; তাতে বিভিন্ন দল, ধর্ম, পেশার মানুষ অংশ নিয়েছেন, এই যুদ্ধে স্বজন হারিয়েছেন, শরণার্থী হয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়ে আবার শূন্য থেকে জীবন শুরু করেছেন; এই সত্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে কেবল আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের একটি দলীয় ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। কিন্তু এই ন্যারেটিভ যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের উপনিবেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়; সেটা একেবারেই খেয়াল করেন না তারা।
পাকিস্তান উপনিবেশের বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ যে গণতন্ত্র, সম্পদের সুষম বণ্টন, সবার জন্য সমান সুযোগ, সামাজিক সুবিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য লড়াই; সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবজ্ঞা করে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দলীয় দখলদারিত্বের লক্ষ্যে অপব্যবহার করে চলেছে।
পাকিস্তান উপনিবেশের বড় একটি সমস্যা ছিল এর সমুদয় সুযোগ সুবিধার পিণ্ডিকেন্দ্রিকতা। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ উপনিবেশের সমস্যা হলো সমুদয় সুযোগ সুবিধার ঢাকা কেন্দ্রিকতা। ফলে বাংলাদেশের প্রত্যন্তে যে প্রান্তিক মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন; তারা রয়ে গেছেন আলোর অলক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধের কাজলরেখা গল্পে ঢাকা শহরের কাঁকনদাসীরা মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার হয়ে; বাড়ি ও ব্যবসা দখল করেছে, নতুন বুর্জোয়া হয়েছে; মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়েছে সপরিবারে।
ফলে প্রত্যন্তের মুক্তিযোদ্ধাদের খবর কেউ নেননি। উপরন্তু ঢাকা শহরে বসে প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে অসংখ্য কাঁকন দাসী মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়েছে। সেই ফেইক সার্টিফিকেট কাজে লাগিয়ে সরকারি চাকরি করছে ও করেছে এরা। গভীর অভিমানে সৎ আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেননি।
এই যে মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধা কোটার কুম্ভীরাশ্রু নিয়ে আওয়ামী লীগ হাজির হয়; আপনি কি ভাবছেন; সত্যিই তাদের এত দরদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য?
ইতিহাসে চিরস্মরণীয় মুক্তিযোদ্ধারা কোনো পার্থিব চাওয়া থেকে যুদ্ধে যাননি। দেশ মাতৃকার জন্য অমিত সাহস নিয়ে যিনি যুদ্ধ করেন; তিনি কখনও অর্থমূল্যে এর রিটার্ন চান না।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর খোঁজ-খবর নিয়ে তাদের যোগ্য সম্মানী, চিকিৎসা সুবিধা, গণপরিবহনে ফ্রিতে ভ্রমণের সুযোগ; এরকম সম্মানজনক ব্যবস্থা করা; পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের সম্মানিত করা হয়।
যে ডিএনএ মুক্তিযুদ্ধ করেছে মেধা ও অসম-সাহসিকতায়, সে বিশেষ বিবেচনায় চাকরি নেবে কী! মুক্তিযোদ্ধা দাদার বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্নের বিপরীতে কী সে দাঁড়াবে! মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিকে জিজ্ঞেস করলেই এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন মুক্তিযোদ্ধা কোটা করেছিলেন, যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ পুনর্গঠনে কাজে লাগাতে। এটা চাকরি ছিল না, দেশের প্রয়োজনে দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল।
কিন্তু যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ; সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে কোটা প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগ সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের সামনে। আওয়ামী লীগের এই যে ভিলেজ পলিটিক্সের নেশা; এর বিরুদ্ধে ওকে; ওর বিরুদ্ধে তাকে লাগিয়ে দিয়ে; বসে বসে দেশডাকাতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার চালু রাখা। এসব ওপর চালাকি আমাদের আগামী প্রজন্মকে তিক্ত সব অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংকট সৃষ্টি করে দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সন্তানদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করে তারপর পুলিশ ও হেলমেট লীগ দিয়ে পেডোফিলিক নির্যাতন নিয়মিত ঘটনা যেন।
আওয়ামী লীগ আসলে চায়; মেধাবীরা দেশের বাইরে চলে যাক; তাহলে তাদের পাঠানো রেমিটেন্স লুন্ঠন করতে পারবে ক্ষমতা কাঠামোর তল্পিবাহকেরা। আর ছাত্রলীগের যারা একটু পড়তে লিখতে পারে, স্বাক্ষরটা করতে পারে, তাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে পুলিশ-প্রশাসন লীগের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে চায় ক্ষমতাসীন সরকার।
আওয়ামী লীগের সমস্যা হচ্ছে; এর স্বপ্নগুলো বৃটিশ কোলাবরেটর হিন্দু জমিদার আর পাকিস্তানের কোলাবরেটর মুসলিম জমিদারদের মতো জীবন ও শান সৌকত অর্জন। সেই যে লস্কর বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাঠি লজেন্স চুষতে দেখেছিল; সেই যে জমিদার বাবুকে চেয়ারে বসে ঠ্যাং দোলাতে দেখেছিল; জমিদার গিন্নীকে স্বর্ণালংকারে সুশোভিত দেখেছিল; তাই ঘুরে ফিরে এই দলটির চোখে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী লাভের লোভ চকচক করে। ওর মনের গভীরে কাস্ট সিস্টেমের উচ্চ বর্ণ হওয়ার ব্যাকডেটেড স্বপ্ন। চিন্তার জগতে সে এত পিছিয়ে যে তার সঙ্গে সভ্যতার সংলাপ যেন প্রায় অসম্ভব!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন