নব্বইয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে অল্পবয়সে আমার একটা ক্ষতি হয়েছিল। আমি ফুটবলের না, ম্যারাডোনার প্রেমে পড়েছিলাম। তাতে যেটা হলো ম্যারাডোনা পর্যায় ছাড়া আর কোনো খেলোয়াড় আমার পছন্দ হলো না।
কিন্তু ম্যারাডোনা পছন্দ করলে অবধারিতভাবে আর্জেন্টিনা সমর্থন করতে হয়। আর্জেন্টিনা সমর্থন করতে গিয়ে আমার ভীষণ রকম উপহার হলো। বিশেষত আর্জেন্টিনা শেখাল ধৈর্য্য। প্রাপ্য জিনিসও বছরের পর বছর না পেয়েও চুপচাপ নিজের কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা আমি মূলত আর্জেন্টিনার সমর্থক হিসেবেই অর্জন করেছি।
আর্জেন্টিনা শিখিয়েছে কীভাবে অল্পতে তুষ্ট থাকতে হয়। শিরোপা নেই তো কী হয়েছে… একটা নজরকাড়া গোল, দুইটা ড্রিবলিং, তিনটা মন মাতানো সুন্দর পাশ... চার বছরে আর কী চায়?
জীবনকেও আমি এখন এভাবে দেখতে পারি। বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, কাড়ি কাড়ি টাকাও নেই। কিন্তু একটা ছোট বারান্দা, দুইটা গাছ আর তিনটা বই নিয়ে আমার জগতটায় আমি যে কম আনন্দ করতে পারি, তা না!
আর্জেন্টিনা শিখিয়েছে সাফল্য না এলেও নিজেকে কীভাবে জাগিয়ে রাখতে হয়। লক্ষ্যের প্রতি রেস্টলেস্ট থাকতে হয়। গন্তব্যে না পৌঁছেও শুধু যাত্রাটিও যে আনন্দের হতে পারে, তা হালের মেসিদের দেখে মনে হয়। প্রায় তিন যুগ নিজেদের জ্বালিয়ে, অন্যের দেয়া লাল-হলুদ কথার লঙ্কা গিলে শিল্পের প্রতি সহজ সজাগ থাকার মন্ত্র ফুটবলে শুধু আর্জেন্টিনাই তো দেখিয়ে চলেছে। আমি শুধু স্টাইলটা জীবনে কপি পেস্ট করে ফেলেছি।
কারো মতো কখনো কাজে দেয় না; এই বিষয়টাও জানলাম আর্জেন্টিনার কাছ থেকেই। ম্যারাডোনা যাওয়ার পর প্রত্যেক বছরই আর্জেন্টিনায় নাকি ছোট ছোট ম্যারাডোনা এল। কিন্তু ছোট ম্যারাডোনা, প্রায় ম্যারাডোনা দিয়ে কিছু আসলে হয় না। হয় ম্যারাডোনা, না হয় ম্যারাডোনা না... এর মাঝামাঝি বলে কিছু নেই; ছিল না কখনো। ব্যক্তি জীবনেও দেখলাম বড়র মতো বলে আসলে কিছু হয় না। হয় বড়, না হয় ছোট। হয় প্রতিভা, না হয় বোগাস। কারো মতো কিছু নেই। অন্যের আশা, স্বপ্ন; অন্য কাউকে বহন করতে দেয়ার পাগলামী করতে নেই।
সব শেষে দেখলাম, আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে আসলে আর্জেন্টিনা। ঠিক আর্জেন্টনা না, পরিস্কার করে বললে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। যুগের পর যুগ ব্যর্থ হওয়া একটি দলকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া, তাদের জন্য মুখে চোখে পতাকা আঁকা, আকাশে রঙ মেশানো; এমন উন্মাদনা তীব্র ভালো না বাসলে করা সম্ভব না। আমি আমার প্রিয় মানুষগুলোকে এমনই নিরঙ্কুশ ভালো বাসতে চাই। আমার বুকে জমুক আর্জেন্টিনা সমর্থকদের গোলাপ।
ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে। খেলা আমার দেখা হবে না। মাতামাতি করারও সময় খুব পাব না। যোগ্যতম দল বিশ্বকাপ পাক, তা যদি আর্জেন্টিনা না হয়.. কিছু যায় আসে না।
আসলে আর্জেন্টিনা তো আমাদের অন্য কিছু পেয়ে বসে আছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন