আ টেল অ্যাবাউট টেল

৩১৫ পঠিত ... ১৭:১৮, আগস্ট ২৫, ২০২২

Lej

১.

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমার একটা লেজ গজিয়েছে।

সুন্দর। কোমল। পায়রার পালকের মতো সাদা। বেশি বড় না অবশ্য; ছাগলের লেজের থেকে একটু বেশি, কিন্তু কাঠবেড়ালির থেকে বেশ খানিকটা ছোট।

লেজটা ধরে কতক্ষণ বসে থাকলাম। রবীন্দ্রনাথ ওভাবে পড়িনি, কিন্তু লাইনটা বেশ জানি… আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম!

সত্যিই আমি লেজটা তাহলে পেলাম।

পাওয়ার জন্য কত কীই না করেছিলাম।

শুরুর দিকে চায়না থেকে কিছু ট্যাবলেট এসেছিল। গোপনে। তিন হাজার পঞ্চাশ টাকা করে পাতা। একেক পাতায় ছয়টা ট্যাবলেট থাকে। তিন মাসে খেতে হবে… ১৫ দিন পরপর।

নিয়ম করে খেলাম। দুই মাস পর শুরু হলো পিঠব্যথা। এমন ব্যথা যে শরীর নড়াতে পারি না। ঘাড় ঘোরাতে পারি না। মিলি পিঠে গরম তেল মালিশ করে দিলো। দিতে দিতে বলল, সাইড ইফেক্ট থাকতেই পারে কিছু… ভালো কিছুর জন্য একটু ব্যথা সহ্য করা কঠিন কিছু না!

আমি দিন আটেক ব্যথা সহ্য করলাম। ভাবলাম লেজ বের হবে… কিন্তু হলো না!

কিছুই বের হলো না।

চাইনিজ জিনিসের ওপর ভরসা রাখা মুশকিল… মিলি বলল।

এরপর একটা মলমের সন্ধান পাওয়া গেল। কোনো এক গুরু নাকি ইন্ডিয়াতে এটা পেয়েছেন। বিশেষত স্বপ্নেই পান তারা। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেছে অন্য রকম। তিনি ট্রাক চালাচ্ছিলেন… বর্ষাকাল ছিল। একটা বজ্র তাঁর ট্রাকের ওপর পড়লে তিনি জ্ঞান হারান। এই সংজ্ঞাহীনতার ভেতর তিনি সন্ধান পান মলমটার—কাছিমের ডিম আর কুমিরের কী কী সব দিয়ে বানানো মলম। বোতলের ঢাকনা খুলতেই ভক করে একটা গন্ধ নাক তো নাক মস্তিষ্ক পর্যন্ত অবশ করে দেয়। সেই মলম কোমর থেকে নিচে একেবারে পায়ের পাতা পর্যন্ত মাখিয়ে রোদে বসে থাকতে হবে।

শুক্রবার আমার ছুটির দিন। শরীরে মলম মাখিয়ে ব্যালকনিতে বসে থাকি। পরনে কাপড় থাকে খুবই স্বল্প। পরপর তিন সপ্তাহ এমন ঘটানোর পর বাসায় এল রুবিনা ভাবি।

রুবিনা ভাবি থাকে সামনের ফ্ল্যাটে। মিলির সাথে প্রতিবেশিসুলভ সখ্যতা আছে। এসেই মিলির সাথে ফিসফাস করে চলে গেল। মিলি আমাকে এসে বলল, তোমার এভাবে বসে থাকায় নাকি ভাবির হাসবেন্ড খুব মাইন্ড করতেছেন! ভাবিকে নাকি চড়ও মেরেছে!

আমি বললাম, চড় মারছে ক্যান?

মিলি বলল, ভাবছে তুমি বোধহয় তোমার জাং তার বউরে দেখানোর জন্য বইসা থাকো বারান্দায়!

খুবই মুশকিল!

এই দুনিয়ায় মানুষের সাথে চলাফেরা করার চাইতে আর বিপদের কিছু নাই। আমি ব্যালকনিতে এবার পিঠ দেখিয়ে বসে থাকে। শুক্রবার ঘুরে-ফিরে আসতে থাকে; কিন্তু লেজ আর আসে না।

মিতালি মুখার্জি। খুবই নাম করা ডাক্তার। বিশেষত প্রত্যঙ্গ পুনঃস্থাপনে তার জুড়ি নাই কোনো। দুই মাস আগে থেকে তার এপয়েন্ট নিতে হয়। শুধু দেশে না… কলকাতা আর কলম্বোতে গিয়েও অপারেশন করে আসেন। যা থাকে কপালে বলে এপয়েন্ট নিলাম তার।

দুই মাস পর শুয়ে গেলাম ডাক্তারের পরীক্ষা-বিছানায়। ভালো করে নেড়ে-চেড়ে দেখলেন আমাকে। তারপর ডেস্কের সামনে বসালেন। বললেন, খুব একটা সহজ হবে না। আপনার টিস্যুই ইস্যু। তবু, আমরা একটা রিস্ক নিতে পারি… কিন্তু প্রচুর খরচ হবে...ডিল করতে পারবেন তো?

‘কত হবে?’

‘প্রায় সত্তর লাখের মতো।'

‘সত্তর?’

‘একটা লেজ কত গুরুত্বপূর্ণ তা তো আপনি জানেনই।'

‘সে জন্যই তো… কিন্তু না, সত্তর লাখ কি সাত লাখই আমি দিতে পারব না। আসলে লেজটা নেই বলেই তো কিছু হয় নি আমার। একটা কেমন নামের মিডলক্লাস আর কাজের লোয়ার মিডলক্লাস হয়ে থেকে গেছি!’

মিতালি মুখার্জি কম্পিউটারে কিছু লিখলেন। তারপর বললেন, সামনের ডেস্ক থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেবেন!

‘কী দিলেন প্রেসক্রিপশনে?’

‘ঘুমের অষুধ। লেজ না হলে আজকাল ফ্রাস্ট্রেশন হয় খুব। আর সেটা হলে ঘুম আসে না একেবারেই। তাই অষুধগুলো খাবেন নিয়ম করে। বেঁচে থাকতে হলে আর যাই হোক...আপনাকে ঘুমাতে তো হবে!’

এরপর থেকে ঘুমের অষুধ খেয়েও আমার আর ঘুম হতো না! ফলে আমি মেডিটেশনের সাহায্য নিতে বাধ্য হলাম। একজন আমাকে অনলাইনে মেডিটেশন শেখাতে শুরু করলেন। প্রথমে একটা কমলাকে কল্পনা করতে হতো… ধীরে ধীরে খোসা ছাড়াতে হতো কমলার… তারপর ছাড়াতে হতো কোয়া… সব শেষে কোয়ার শিরা-উপশিরা… অনেক অনেক অনেক দিন পর নাকি চোখ বন্ধ করলেই কমলা ছাড়াতে বসলেই তার গন্ধ পাওয়া যায়। আমি কোনো গন্ধ পেলাম না! কমলার কোয়া ছাড়াতে ছাড়াতে আমার শুধু লেজের কথাই মনে আসতে থাকল।

মেডিটেশন, যাকে বলে, চাঙে উঠল!

মিলি বলল, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!

তারপর একদিন আমাকে রেখে তার ভাইয়ের এপার্টমেন্টে চলে গেল। সেই যাওয়া আর আজ... মাঝখানে লম্বা সময়। এখন, এই যে, আমার একটা নাতিদীর্ঘ লেজ। মিলি কী বলবে?

ফোন দিলাম। বললাম, শোনো মিলি, আমার না একটা লেজ বেরিয়েছে! কোমল-নরম আর সুন্দর...তুলতুলে!

ওপাশ থেকে মিলি চিৎকার দিয়ে উঠল—ও আল্লাহ! সত্যিই? ক্যামনে কী হলো?

‘ঠিক জানি না। চীনের অষুধের জন্য হতে পারে, আবার ধরো ওই যে ইন্ডিয়ার গুরু...কিংবা মেডিটেশন…

‘যাই হোক...লেজ আসছে এইটাই বড় কথা! শোনো, আমি আসতেছি। একবার হাত দিয়ে ধরে দেখার লোভ সামলাইতে পারছি না…!'

‘আসো আসো। ব্যাগট্যাগ সবই নিয়া আসো। এখন তো লেজ হইছে আমার। এখন আমারে দিয়া কিছু না কিছু হইবেই!’

২.

যার সামনে বসে আছি, উনিই আমাদের হর্তাকর্তা!

প্রচণ্ড ক্ষমতা। ধরাকে সরা জ্ঞান করার যে প্রবাদ বাংলা বইয়ে পাওয়া যায় সেটা ওনার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। গত তিন মাসে ১৩ জনের চাকরি খেয়েছেন। ১১ জনকে বদলি করে দিয়েছে। ৯ জনকে দিয়েছে ডাবল প্রোমোশন। আমি তেলতেলে গলায় বলি, স্যার, ভালো আছেন?

‘হুম। আপনার পকেট থেকে রুমাল বেরিয়ে আছে বোধহয়!’

‘রুমাল না স্যার। ওটা লেজ।'

‘সর্বনাশ! গজিয়েছে তাহলে আপনার?’

‘জ্বি স্যার। আপনার দোয়া।'

‘তাহলে তো খুবই ভালো।'

‘জ্বি স্যার।'

‘আপনাকে তো এবার আর আটকে রাখা ঠিক হবে না। আমি এইচ আরকে বলে দিচ্ছি… আজকালের ভেতরই আপনার ব্যবস্থা করে ফেলবে ওরা।'

‘থ্যাঙ্কিউ স্যার।'

‘আরে শুধু থ্যাঙ্কিউ বললে হবে নাকি?’

‘তাহলে স্যার?’

‘লেজ আছে...কিন্তু নাড়াচ্ছেন না যে…’

আমি বিনয়ে বিগলিত হয়ে লেজটা নাড়ানো শুরু করলাম। কিন্তু ওকি! লেজটা যে নড়ছেই না…! আমি বারবার চেষ্টা করতে থাকি...কিন্তু না, একেবারেই নড়ছে না! আমি হাত দিয়ে নাড়াতে চাইলাম, তবুও নড়ছে না। অস্বস্তি নিয়ে হর্তাকর্তার দিকে তাকাই আমি—স্যার…

উনি ভীষণ হয়ে ওঠেন মুহূর্তেই—আগে ছিল না...সেটা মনে করতাম আপনার যোগ্যতার অভাব। কিন্তু এখন থেকেও যে নাড়াচ্ছেন না...এটাকে আমি বেয়াদবি হিসাবে নিচ্ছি...বুঝেছেন! গেট আউট!

৩.

মিতালি মুখার্জি বলেন, লেজ নাড়ানো কিন্তু সহজ কাজই। তবে আপনার বেলা এমন জটিল হয়ে গেল কিনা বুঝছি না। এক্সরেতে যা পেলাম তাতে মনে হচ্ছে লেজে না, সমস্যাটা মেরুদণ্ডে… আসলে কী জানেন, ওটার সাথেই লেজের আত্মার সম্পর্ক!

আমি আর মিলি ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে আছি। বলি, কোনো উপায়ই কি নেই?

ডাক্তার হাসেন—আছে আছে! আমার কাছে থাকবে না তো কার কাছে থাকবে? একটা ছোট্ট অপারেশন করতে হবে। আমরা মেরুদণ্ডটাকে তরল নমনীয় বানিয়ে ফেলব… কিন্তু অপারেশনে মোটামোটি সত্তর লাখ মতো খরচ হবে, সেটা কি যোগাড় করতে পারবেন আপনি? না হলে ঘুমের অষুধ তো আগেই লিখে দিয়েছি, তাই না?

৩১৫ পঠিত ... ১৭:১৮, আগস্ট ২৫, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top