আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

৭৯৬ পঠিত ... ১৭:৪৯, মার্চ ২৩, ২০২৩

আমি-বেঁচে-ছিলাম-অন্যদের-সময়ে

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,

আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,

আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।

আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,

আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,

আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,

আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,

আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।

তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,

তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,

তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,

তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,

তারা আমার মুখে গুজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।

তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে বাঁচতে।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,

আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,

আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,

আমি উচ্চারন করতে চেয়েছিলাম আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।

আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।

আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,

আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।

আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।

আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয়নি।

আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আপন সুরে,

ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।

আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।

আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।

আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।

আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমাকে ওদের মতো করেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।

ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে বলতো সাফল্য,

ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবত গৌরব,

ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,

ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।

আমি মাংসের টুকরা থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয়নি।

আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয়নি।

আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয়নি।

আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয়নি।

আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।

ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,

ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,

ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে

আমার দিঘিতে পানি ওঠেনি।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে

আমার জমিতে শস্য জন্মেনি।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে

আমার ভবিষ্যতের বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।

তখনো আমার দিঘির জন্য পানি উৎসারণের সময় আসেনি।

তখনো আমার জমির জন্য নতুন ফসলের সময় আসেনি।

তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসেনি।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার সবকিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,

ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।

ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।

আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।

ওরা যে-তরুণীকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছে তাকে ধরেছে দস্যুর মতো।

আমার তরুণীকে আমি জরিয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।

ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।

আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।

চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।

আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায়নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারেনি।

তখনো আমার সময় আসেনি।

আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারেনি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাইনি।

তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসেনি।

আমি বেঁচে ছিলাম

অন্যদের সময়ে।

 

৭৯৬ পঠিত ... ১৭:৪৯, মার্চ ২৩, ২০২৩

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ


Top