'আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি৷ আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য৷ আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে৷ এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম৷ শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি৷ আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার৷ ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম৷ ওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর? ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা৷'
নিজের ছবি সম্পর্কে এ কথাগুলো বলেছিলেন নড়াইলের চিত্রা নদীরপাড়ের ‘লাল মিয়া’, বিশ্ববাসীর এস এম সুলতান। জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই শিল্পী বিচিত্র ধরনের ছবি এঁকে সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দেন।
বাংলার কৃষক-শ্রমজীবী মানুষ তাঁর ছবিতে অবয়ব পেয়েছে নতুন রূপে, অনন্য আকার-গড়নে। এই শিল্পীর জন্ম ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে।
তিনিই প্রথম এশীয়, যার আঁকা ছবি পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালির মতো বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তার এই ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এমব্যাঙ্কমেন্ট ও লেইস্টার গ্যালারিতে।
সুলতান তার চিত্রকর্মের জন্য অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ম্যান অব দ্য ইয়ার, একই বছর একুশে পদক, ’৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স, ’৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক এবং ’৯৯ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ৫০ বছর পূর্তিতে সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান এই শিল্পী। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের ভেতর ম্যাসাকার, জিপসি পরিবার, কৃষক, প্রথম রোপণ, চর দখল ও আদম সুরত অন্যতম।
সুলতান বিড়াল ভালোবাসতেন আর তাঁর স্বপ্ন ছিল বজরায় করে ঘুরে ঘুরে শিশুদের ছবি আঁকা শেখাবেন। বিশ্ববরেন্য এই শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষে তার জীবনের কয়েকটি মজার ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো।
‘শিল্পী এস এম সুলতান আমাকে বলতেন কাসেম ভাই আর তাঁকে আমি ডাকতাম সুলতান ভাই বলে। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম যশোরের ফটিক সরদারের বাড়িতে—গেরুয়া রঙের শাড়ি পরা। প্রথম পরিচয়েই মনে হলো, তিনি অন্য রকম—ভিন্ন ধারার মানুষ—এরপর আমাদের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। আমরা কিন্তু পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করতাম। একদিন তাঁকে বললাম, “শালা, তুমি ছবি আঁকো না, খালি নেশা করো, টোব্যাকো খাও, যে তোমাকে টোব্যাকোর টাকা দেয় তাকেই ছবি এঁকে দাও— তোমাকে মেরে আজ মাথা ফাটিয়ে দেব। তুমি চেনো আমাকে? এরপর আমার দিকে তেড়ে এলেন সুলতানও। বেশ সময় ধরে চলল আমাদের দুজনের হম্বিতম্বি। তারপর একসময় সুলতান আমাকে বললেন, কাসেম ভাই, দুটো সাইক্লোন পরস্পর মুখোমুখি হয়ে ঘুরে ঘুরে শান্ত হয়ে গেল—ইট ইজ অ্যা বিউটিফুল মোমেন্ট!”’
কথা বলছেন ৯৬ বছর বয়সী আবুল কাসেম জোয়ারদার, যশোর এম এম কলেজের একসময়ের শিক্ষক, এস এম সুলতানের বন্ধু। এস এম সুলতানের সঙ্গে ঝগড়ার সময় কাশেম সাহেব যে টোব্যাকো খাওয়ার কথা বলেছেন প্রকৃতপক্ষে সেটা হচ্ছে গাঁজা। সুলতান প্রচুর গাঁজা এবং আফিম খেতেন। সুলতান গাঁজাকে বলতেন টোব্যাকো।
*
একদিন গভীর রাতে সুলতান নেশা করবেন এবং ছবি আঁকবেন। নেশা না করে তিনি ছবি আঁকতে পারছেন না। সুলতান ছটফট করছেন। ঘরে গাঁজা নেই। সেই রাত ১২টায় অধ্যাপক কাশেম গাঁজা কিনতে বেরুলেন। ঐ গভীর রাতে গাঁজা পাওয়া যাবে একমাত্র মেড়ো মন্দিরে (মাড়োয়াড়ি মন্দির)। মেড়ো মন্দির এলাকা হচ্ছে যশোর শহরের পতিতাপল্লী। পুরাতন কসবাস্থ মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে মেড়ো মন্দিরের দূরত্ব এক কিলোমিটারের উপর। সেই গভীর রাতে অধ্যাপক সাহেব চললেন সেই এলাকায়। ঐ গভীর রাতে কেউ যদি দেখে যে, অধ্যাপক সাহেব মেড়ো মন্দির এলাকায় গেছেন তাহলে তো তার অর্থ একটাই দাঁড়ায়। পতিতা সংসর্গ। অধ্যাপক সাহেব মেড়ো মন্দির থেকে গাঁজা কিনলেন। সেখানে যথারীতি এক ব্যক্তি কাশেম সাহেবকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে বসলো, স্যার এতো রাতে আপনি এখানে? তার সংক্ষিপ্ত উত্তর, গাঁজা কিনতে এসেছি। কথা না বাড়িয়ে কাশেম সাহেব কলেজের পথ ধরলেন।
*
এম এম কলেজ ক্যাম্পাসে এস এম সুলতানকে মাঝে মাঝেই দেখা যেত। তার পরনে প্রায়শ থাকত একটি শাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরা! আদুল গা। সাধারণত কোমরের নিচের শাড়িটা কাঁধের উপর প্যাঁচানো। আর কাঁধে থাকতো একটি ঝোলানো ব্যাগ। তার এমন বেশভূষায় যারপরনাই হতবাক হত আশেপাশের মানুষ।
চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আহমেদ ছফা। সুলতানের ৩০০ চিত্রকর্ম সোনারগাঁয়ে এক বাড়িতে ছিল। সুলতানের অনুরোধে সেগুলো আনার ব্যবস্থা করে দেন ওই ভদ্রলোক। একটা সরকারি ট্রাকের ব্যবস্থা করে সাথে আহমদ ছফাকে দিয়ে দেন। কারণ সুলতানের গাঁজার প্রতি ছিল অসীম ভক্তি। দিনকাল ভুলে যেতেন।
আর সে কারণেই নিরাপত্তা স্বরূপ ছফা সাহেব সাথে যান যাতে সহিসালামতে ৩০০ চিত্রকর্ম ঢাকায় ফেরত আসে এবং ট্রাকটা বিকেল ৫টার মধ্যে ইডেন গার্ডেন্সে জমা দেয়া যায়। সব ছবি সাবধানে উঠানো হল। কাজ শেষ হওয়ার খানিক আগে সোনারগাঁয়ে সেই বাড়ির সামনে এক বাউলে সাথে সুলতানের দেখা হয়ে গেল। দুজনে মিলে গাঁজা খেতে বসলেন। গাঁজা খাওয়ার মধ্যে বাউল গান ধরলেন। স্বাভাবিকভাবে সুলতান বাকি সব কিছু ভুলে গেলেন।
আহমদ ছফা সুলতানকে ডাকতে আসলেন। সুলতান বিরক্ত হলেন। তিনি হিন্দিতে জবাব দিলেন, ‘আমি সুলতান, আমি কারো কথায় চলি।' সাথে থাকা বাউলও তাল দিলেন। বললেন, ‘অবশ্যই আপনি সুলতান। আপনি কারো কথায় কেন চলবেন?’
ব্যস! হয়ে গেল। আহমদ ছফা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর ট্রাকে উঠে ড্রাইভারকে গিয়ে বললেন, গাড়ি স্টার্ট দেন, আমাদের ৫টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। ট্রাক চলা শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সুলতানের ডাক শুনে পিছন দিকে তাকালেন ছফা সাহেব। দেখলেন জোব্বা পড়া সুলতান ট্রাকের পেছনে পেছনে দৌঁড়ে আসছেন আর বলছেন, ‘ছফা ভাই, আমাকে রেখে যাবেন না!’
তথ্যসূত্র: বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন