ধর্ম নিজেকে বদলানোর জন্য; অন্যকে বদলানোর জন্য নয়

২২০ পঠিত ... ১৮:৫৬, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

21

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের পর সৈয়দ জামিল আহমেদ শিল্পাঙ্গনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। গত দেড় দশক ধরে কেবল আওয়ামী লীগের আনুগত্যের ভিত্তিতে মিডিওকার লোকেদের বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। ফলে শিক্ষা-সংস্কৃতি-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি-গণতন্ত্র-আইনের শাসন সব হারিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গোপালগঞ্জ গ্রামে পরিণত হয়েছে। এইখানে মাতবর শেখ হাসিনা ও তার সহমত ভাই, শিবব্রত দাদার দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতা দিয়ে মেপে মেপে লোকজনকে চেতনার পক্ষে-বিপক্ষে ও যোগ্য-অযোগ্য বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সভ্যতার মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় সর্বনিম্ন জায়গায় চলে গেছে।

ছাত্র-জনতার রক্ত-ত্যাগে-ঘামে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হলে; বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হিসেবে কেবল মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।

কিন্তু দুদণ্ড শান্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারের ভাগ্য করে তো আমরা জন্মাইনি। আওয়ামী লীগের বলবানেরা শেখ হাসিনার পলায়নের সঙ্গী হবার পর; জামায়াতের তালেবানেরা বেরিয়ে এসেছে আমাদের বিরক্তি কোটা পূর্ণ করতে। আওয়ামী লীগের সিপি গ্যাঙের মতো জামায়াতের বাঁশের কেল্লা গ্যাং তাদের দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতায় মাপতে শুরু করেছে ইসলামি চেতনার পক্ষে-বিপক্ষে ও যোগ্যতা-অযোগ্যতা।

সৈয়দ জামিল আহমেদ একটি মন্তব্য করেছেন কিনা নিশ্চিত নই; কিন্তু তার নামে একটি মন্তব্য প্রচার করছে বাঁকে গ্যাং, যেখানে সৈয়দ জামিল বলছেন, শিল্পকলায় জামাতও আসুক, বলুক ২০২৪ সালে এসেও কেন মেয়েরা বোরকা পরবে...

আমি মানুষের পোশাকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। যার যে পোশাক ভালো লাগে; সে তাই পরুক। কিন্তু জামিল আহমেদ হিজাব নিয়ে ঐ মন্তব্য করেছেন বলে বাঁকে গ্যাঙের ঐ মন্তব্যের খণ্ডিত অংশ নিয়ে প্রচারণা শুনলে মনে পড়ে যায়; শফিক রেহমান কিংবা ফরহাদ মজহারের মন্তব্য নিয়ে সিপি গ্যাঙের ড্রপ আউট ছাত্রদের মাপামাপির কথা। দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতা দিয়ে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের মাপামাপির এক আশ্চর্য প্রতিভা আমাদের গ্রামবাসীর।

বাংলাদেশ গরীব দেশ বলে, আমাদের সন্তানেরা আরব বিশ্বে শ্রম দিতে যায়। যেহেতু তারা শ্রমজীবী মানুষ; আরব সমাজের শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে তাদের সখ্য। বাংলাদেশের শ্রমজীবী সন্তানেরা আরব বিশ্ব সম্পর্কে আর সেখানকার সংস্কৃতি নিয়ে যে ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছে; তা আরব সমাজের অনগ্রসর মানুষের কালচার।

এই মুহূর্তে দোহা, দুবাই, রিয়াদ গড়ে উঠছে তথ্য প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে; সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। ক্লাসের ফলাফলের ক্ষেত্রে মেয়েরাই এগিয়ে। সৌদি আরবের শাসক মুহাম্মদ বিন সালমান বুঝতে পেরেছেন, বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। কাজেই বউকে বাসায় বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য আরব স্বামীর ফুরিয়ে যাচ্ছে; সেই বাস্তবতায় আরব নারীদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত করা হচ্ছে। ক্ষমতায়িত নারীর প্রথম উদাহরণ মহানবীর স্ত্রী বিবি খাদিজা; যিনি সেই আমলে একজন স্বনির্ভর উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠানেই বিজনেস ম্যানেজার হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন মহানবী।

সৌদি আরবের নারী নভোচারী এখন মহাকাশ অভিযানে যাচ্ছেন। আরব বিশ্বের শহরগুলোতে গাড়ি চালাচ্ছেন নারীরা। অনেক আগে তুরস্ক লেবাননে যেরকম সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে নারী ক্ষমতায়িত হয়েছিল; সেটাই এখন আরব বিশ্বের মূল ধারা। চলচ্চিত্র ও ফ্যাশন জগত বিকশিত হচ্ছে সেখানে। সংগীত ও নৃত্যের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আরব বিশ্বে অনেক পুরোনো। বিনোদন বলতে জীবনের জৈবিক চাহিদা পূরণের যে আদিম বিনোদন ধারণা; এর বাইরে এসে বিনোদনের সুন্দর যে জগত; তাই হচ্ছে থিয়েটার-চলচ্চিত্র-সংগীত-নৃত্য-শিল্প-সাহিত্যের জগত। এই জায়গাটাতে আরব বিশ্ব সমৃদ্ধ এক জায়গায় রয়েছে। আরব সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজ এই সংস্কৃতি চর্চা করে। কিন্তু নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রাম তাদেরকে হারাম-হালাল বিতর্ক, কে সহি মুসলমান-অসহি মুসলমান, কে নামাজ পড়ল-কে পড়ল না; এই সব সামাজিক পুলিশিতে ব্যস্ত রাখে। যার জীবনে কিছু নেই; তার আছে ইগো; গুরুত্বপূর্ণ হবার ইচ্ছা; আর সেটা সামাজিক পুলিশ হয়ে।

বাংলাদেশের মুশকিল হলো; রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ারাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের কল্যাণে নিম্নবিত্ত লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। কিন্তু তার জানাশোনার জগত যেহেতু ভারত ও আরব বিশ্বের নিম্নবিত্তের সংস্কৃতি; তাই ভারত বলতে তারা বোঝে কপালের চেয়ে বড় লাল তিলক এঁকে রামমন্দিরে মাতম আর সৌদি আরব মানে তারা বোঝে বিশাল দাড়ি ঝুলিয়ে মক্কা-মদিনায় কান্দন। বাংলাদেশে আমরা ভারতের নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুত্ববাদী কালচারকে প্রগতিশীলতা বলে জানি; আর সৌদি আরবের নিম্নশ্রেণীর ইসলামপন্থী কালচারকে খেলাফত বলে জানি। এটা অবশ্য বেদনাদায়ক যে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের লোকেদের প্রবেশাধিকার ভারত ও সৌদি আরবের গোঁড়া নিম্ন সংস্কৃতির ঘরে।
 
মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পৃথিবীর সর্বত্র উদারপন্থী। কারণ তার তো নিজেকে কারও সামনে প্রমাণ করতে হয় না। জন্ম নেবার পর থেকে মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড পূরণ হয়ে যাওয়ায় ইগো কম থাকে; ফলে সামাজিক পুলিশি করার প্রবণতা তাদের কম হয়। ব্যতিক্রম কেবল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো; এখানে দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত হওয়া যায় বলে অস্বাভাবিক সামাজিক গতিশীলতায় দুর্নীতিবাজ লোকজন দ্রুত ধনাঢ্য হয়; নিম্ন সংস্কৃতির ইগো আর উচ্চবিত্ত এক বিষময় ফলাফল আনে। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য সমাজে মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ও বিত্ত অর্জন করে। ফলে একটি স্বাস্থ্যকর সামাজিক গতিশীলতা দেখা যায় সেখানে।

দুবাই-দোহা-ইস্তাম্বুলের জীবন চর্যার সঙ্গে পশ্চিমের জীবন চর্যার পার্থক্য খুবই কম। ইস্তাম্বুলে স্কার্ট পরা নারী, হিজাব পরা নারীর সঙ্গে ট্রামে গল্প করতে করতে ভ্রমণ করে; দাড়িওয়ালা লোক ক্লিন শেভড লোকের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে ট্রামে ভ্রমণের সময়টা কাটায়।

প্রতিটি পোশাক এক একটি এলাকার ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে তৈরি হয়। এক একটি এলাকার মানুষের চেহারা-সুরত; শারীরিক গঠনের সঙ্গে মিল রেখে পোশাকের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। আরবের গৌরবর্ণের দীর্ঘাঙ্গী একটা লোকের দাড়ি ও আলখাল্লা যেমন মানিয়ে যায়; দক্ষিণ এশিয়ার শ্যামলা ও খর্বাকার লোকের দাড়ি ও আলখাল্লা বেমানান দেখায়। আবার ভারতের রাজপুতের কপালে লাল তিলক যেমন মানায়; বাংলাদেশের রাজনীতিপুতের কপালে সেটা বেমানান লাগে। আর পোশাকের বিবর্তন হয় সময়ের সঙ্গে। দুবাই-দোহা-ইস্তাম্বুলে নারী পোশাক দেখলে সেটা বোঝা যায়। প্রাচীন কালের ইহুদিদের পোশাক হিজাব সেরকম জনপ্রিয় নয়। যারা মাথায় স্কার্ফ পরে তারা ফ্যাশনেবল সব স্কার্ফ ব্যবহার করে। অষ্টাদশ শতকের জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পোশাক কী আজকের কলকাতার মেয়েরা পরে আর। আমাদের সমাজের সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রাচীন সৌদি আরব আর অষ্টাদশ শতকের ভারতীয় ফ্যাশন নিয়ে বসে আছি; আর সেগুলোকে বিশাল গর্বের চিহ্ন মনে করি।

শিল্পকলার মানুষ হিসেবে পোশাকের বিবর্তন সম্পর্কে সৈয়দ জামিল আহমেদ যদি মন্তব্য করেও থাকেন; সেটা তার এক্সপার্টিজের অংশ; থিয়েটার নির্দেশককে কস্টিউম সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হয়।

তাই অতীতের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুলিশ সিপি গ্যাঙের মতো আজকের বাঁকে গ্যাংকে অনুরোধ জানাব অযথা ইসলামি চেতনা পুলিশি না করতে। কবি জালালুদ্দিন রুমী বলেছেন, ধর্ম হচ্ছে নিজেকে বদলানোর মাধ্যম; অন্যকে বদলানোর জন্য নয়।

(ছবিতে সৌদি আরবের সিনেমাটিক আর্টের ছাত্রীরা। ৩০০টি সিনেমা হল খোলা হচ্ছে সেখানে। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হতে হচ্ছে সৌদি জেন জিদের) 

459293601_10232645143047390_1866834845573360691_n

২২০ পঠিত ... ১৮:৫৬, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top