বিসিএস পরীক্ষার্থী প্রাইভেট স্যার যেভাবে আমাকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়াতেন

৯৮৬ পঠিত ... ২১:২৮, মার্চ ২২, ২০২১

bcs tutor adnan mukit earki

আমি যখন ক্লাস এইটে, তখন বিকাশ চন্দ্র দাস নামে এক শিক্ষক আমাকে কয়েকদিন পড়াইতে আসছিলেন। মূলত তিনি অঙ্কের টাইটানিক। পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার অল্প কিছু গৃহশিক্ষকদের মধ্যে তিনি দীর্ঘস্থায়ী। দুই মাস আমাকে পড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

আমার গাণিতিক দক্ষতা বিকাশের জন্য বিকাশ স্যার আসতেন দুপুরবেলা।

অনেকটা পথ হেঁটে আসতেন। আবার আমাদের বাসাও চারতলা। তাই এসেই 'ফ্যানটা বাড়ায় দাও' বলে হাঁপাতেন কিছুক্ষণ। সাধারণত এই কথা শুনে রেগুলেটর ৪ থেকে ৩ এ নামিয়ে দিতাম আমি। স্যার কিছুক্ষণ পর ওপরে তাকিয়ে 'কী ব্যাপার, ফ্যান ঘোরে না ক্যান?' বলে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তারপর নিজেই গিয়ে আবিষ্কার করতেন, ফ্যান কমানো।

ফ্যানের বাতাস বাড়লে শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে আরাম করে বসতেন স্যার। তারপর বলতেন, 'এক গ্লাস পানি দাও তো।' স্যারের এই আরামটা আমার পছন্দ হতো না। প্রতিদিন তার পানি খাইতে হবে কেন? আর এত পিপাসা লাগলে সঙ্গে বোতল রাখতে পারেন না?

পানি আনার সময় যতটা সম্ভব সময় নষ্ট করতাম আমি। স্যার ঘর থেকে ডাকতেন, 'পানি আনতে এতক্ষণ লাগে?'

'জগে পানি নাই স্যার! কলসি থেকে আনতেসি।' রান্নাঘর থেকে বলতাম আমি। যদিও জগে পানি থাকত সব সময়।

পানি খেয়ে হোমওয়ার্ক চেক করতেন স্যার। হোমওয়ার্ক আমি কখনোই করতাম না। ফলে 'তাহলে এগুলো এখন করো আমার সামনে।'- বলে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে রেস্ট নিতেন স্যার।

বারান্দা দিয়ে আসা বাতাস আর ফ্যানের বাতাস মিলে বেশ আরামদায়ক একটা পরিবেশ তৈরি হতো তখন। মাঝে মাঝে বাতাসে দুলে উঠত ফ্যানটা। ঘটঘট করে একটা শব্দ হতো। শব্দটা আরও ঘুম পাড়িয়ে দিতো। স্যারও 'আমি কিন্তু সব দেখছি' বলে ঘুমিয়ে পড়তেন।

স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন--এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ামাত্র টেবিল থেকে উঠে পড়তাম আমি। ঘরের ভেতরই হাঁটাহাঁটি করি, সিঁড়িতে যাই। তিনতলা থেকে বন্ধু মুনকে ডেকে এনে পা টিপে টিপে দেখাই - 'দ্যাখ, আমার স্যার ঘুমায়!'

বলে আবার নিঃশব্দে হাসি দুজন মিলে! খুব আনন্দের ব্যাপার।

রাত জেগে বিসিএসের পড়া পড়তেন স্যার। সে জন্য দুপুরে ঘুম পেত। বিকালে করতেন টিউশনি। টিউশনি করেই ছোট তিন ভাই বোনের পড়াশোনার খরচ মেটাতেন তিনি। হেঁটে হেঁটেই অনেক দূরের বাসায় পড়াতে যেতেন স্যার। আম্মা বলতো, 'দেখছো, কত কষ্ট করে? আরামে থাকো, তাও পড়ালেখা করো না। ওকে দেখে শিখো।'

আরামে থাকলে পড়ালেখা করব কেন-সেটা আমার মাথায় আসতো না। স্যারকে জ্বালাতে ইচ্ছা করত শুধু। স্যার আমাকে বকতেন না, মারতেনও না। আমার বিরক্ত লাগতো, উনি পড়াতে এসে ঘুমাবেন কেন!

স্যারের কাছে পড়তে আমার একদম ভালো লাগতো না। স্যার ক্রিকেট খেলা দেখেন না, গল্পের বই পড়েন না। টিভি দেখেন না। শুধু বিসিএসের পড়া পড়েন। এটা আমার খুব খারাপ লাগতো। তাই পড়া ফাঁকি দেওয়ার নানা ধান্দা করতাম। আমাদের বাসার দুটো দরজা ছিল, দুটো দিয়েই বের হওয়া যেত। আমি ছোট দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে মূল দরজায় তালা মেরে দিতাম। তারপর আবার ছোট দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে বসে বই পড়তাম। স্যার এসে দেখতেন ঘরে তালা। তারপর কিছুক্ষণ সিঁড়িতে অপেক্ষা করে বাসায় চলে যেতেন। আমার ছুটি!

একদিন স্যার ঘটালেন ব্যতিক্রম ঘটনা। সাধারণত তিনি ঘুমাতেন টেবিলে মাথা গুঁজে। সেদিন একেবারে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাথা পেছনে এলানো, মুখ হাঁ।
এমন সময় এক আত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ দিতে বাসায় এলেন আমার ফুপাতো ভাই। এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী করতেসিলা তুমি?'
'পড়তেসিলাম স্যারের কাছে।'
'স্যার কই?'
'ওই ঘরে। ঘুমায়।'
'তাই নাকি? চলো তো দেখি।'
ভাইয়া এসে দেখলেন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন স্যার। কিছুক্ষণ স্যারের নাক ডাকা শুনে চলে যাওয়ার সময় ভাইয়া বললেন, 'তোমার স্যারকে বলবা বাসে বসে ঘুমাইতে। তাইলে বাসের আর হর্ন দেওয়া লাগবে না।'

আমরা দুজনই খুব হাসলাম। ফিরে এসে দেখি স্যার ঘুম থেকে উঠেছেন। আশেপাশে তাকিয়ে বললেন, 'কে আসছিল?'
'আমার ফুপাতো ভাই।'
'আরে তুমি আমাকে ডাক দিবা না?'
'আপনি তো স্যার ঘুমাচ্ছিলেন।'
'আরে এটা কী কথা! কেমন একটা ব্যাপার হলো! উনি কী ভাববেন!'

স্যার খুবই লজ্জা পেলেন। আমি পেলাম মজা।

একদিন এক আড্ডায় ফুপাতো ভাই আমার বাবাকে বললেন, 'মামা, আদনানের জন্য ঘুমন্ত শিক্ষক কই পাইসো?'
তারপর পুরো ঘটনা খুলে বললেন। এর ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পরই স্যারকে বিদায় বলে দেওয়া হলো। আমি খুবই খুশি হলাম। আমাকে আর দুপুরবেলা পড়তে হবে না!
যেহেতু আমরা একই এলাকায় থাকি, স্যারের সঙ্গে দেখা হতো প্রায়ই। কিন্তু আমি এড়িয়ে যেতাম। একদিন স্যার মাঠে এসে খেলার মধ্যে আমাকে ধরলেন।
'তুমি এখন কার কাছে পড়ো?'
'আম্মার কাছে।'
'আন্টি সময় পায়?'
'পায় তো।'
'ও... তোমার বাবা কিছু বলসিলো আমার বিষয়ে?'
'না তো। কী বলবে?'
'না, বলছিল তোমাদের একটু ক্রাইসিস যাচ্ছে, পরে আবার ডাকবে সমস্যা কেটে গেলে।'
'আমাকে কিছু বলে নাই।'
'কিছু জিজ্ঞেসও করে নাই?'
'একবার জিজ্ঞেস করসিলো যে তোমার স্যার মাঝে মাঝে ঘুমায় কিনা।'
'তারপর? তুমি কী বলসো?'
'আমি বলসি মাঝে মাঝে না, স্যার প্রতিদিনই ঘুমায়।'
'অ্যাই বেয়াদব ছেলে! তুমি তো ভয়ংকর দুষ্টু! তোমাকে মাইর দেয়া দরকার ছিল, বুঝছো?'
'স্যার আমি যাই, খেলার দেরি হচ্ছে।'
'যাও। পড়ালেখা করবা কিন্তু ঠিকমতো।'

আমি মাঠে ছুটে গিয়েছিলাম। স্যারের সঙ্গে মাঝে মাঝে এলাকায় দেখা হতো। স্যার ডেকে খোঁজ খবর নিতেন। কিছু খাবো কিনা জিজ্ঞেস করতেন। আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। কিছুদিন পর তাঁরা অন্য এলাকায় চলে গিয়েছিলেন।

অনেকদিন পর শুনেছিলাম, স্যারের বিসিএসে হয়নি। উনি একটা কোচিং সেন্টার দিয়েছিলেন।

৯৮৬ পঠিত ... ২১:২৮, মার্চ ২২, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top