হাসপাতালের তিনটি বোরিং গল্প

২৮৫ পঠিত ... ১৭:০৫, মে ২৫, ২০২৪

17 (10)

হাসপাতাল এক রঙ্গমঞ্চ। প্যারালাল ইউনিভার্সের মতো এখানে একই সাথে একই বিল্ডিংয়ে বিভিন্ন রকম কাহিনী ঘটতে থাকতে। এখানের মূল প্রোটাগনিস্ট ডাক্তার। পাশাপাশি বিছানায় যখন সুখ দুঃখের কাহিনী ঘটে, তখন তাকে একই সাথে দুটোতেই সমানভাবে অংশ নিতে হয়। শুধু সুখ দুঃখই না, আরও নানা অনুভূতিমিশ্রিত (যেমন-রাগ, বিরক্তি, হতাশা, ক্লান্তি, একঘেয়েমি ইত্যাদি) ঘটনা এখানে ঘটে। যা হোক। পৃথিবীতে সবাই মজার গল্প বলতে চায়। মানুষ চায় তাকে সবাই শুনুক। আমি তিনটি বোরিং গল্প নিয়ে এসেছি। আপনারা শুনবেন কী শুনবেন না—এ নিয়ে কোনো ধরাবাঁধা নেই।

 

১)

হাসপাতালে ফিমেল ডাক্তারদের আয়রনিগুলোর মধ্যে একটি হলো 'সিস্টার/খালা/নার্স' ডাক শোনা। সাধারণত সিস্টার বলা হয় নার্সদের, খালা বলা হয় আয়াদের। প্রতিটি পেশাই সম্মানজনক, তবে এভরিওয়ান হ্যাজ দেয়ার প্লেসেস। আমার ডিউটি এখন নিউরোসার্জারি বিভাগে। বিকেল বেলা একজন রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট রুমে এসে বললো, 'রোগীটাকে দেখলে খুব ভালো হইতো, মাথা ব্যাথা করতেছে...'

'ফাইল নিয়ে আসেন, ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি...’ 

'এখন অবশ্য আগের চেয়ে ভালো, আপনি যদি দেখে একটু কথা বলতেন তাহলে মনে সাহস পাইতো। একটু যদি আসতেন...প্লিজ.. ’

এই ধরনের অনুরোধ আমরা প্রায়ই শুনি। রাত তিনটার সময় এসে হয়তো কেউ বলবে, 'রোগী কেম্বা কেম্বা করিচ্ছে, আপা তাড়াতাড়ি আসেন...'

দৌড়ে যাওয়ার পর দেখা যায় রোগী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কিছু কিছুর রোগীর লোক এই কাজগুলো করে বোরডম থেকে, বাকিরা কনসার্ন থেকে।

এরপর যেটা আরও বেশি শোনা যায় তা হলো, 'জ্বরে রোগীর গা পুইড়ে যাচ্ছে... একদম শেষ। একটু আসেন...’

গায়ে হাত দিয়ে দেখা যায় একদম স্বাভাবিক তাপমাত্রা। মাঝে মাঝে এসব দেখে আমাদের জ্বর উঠে যায়, নিজের গালের কষিয়ে দুটো চড় দিতে ইচ্ছে করে—কিন্তু মোরাল অবলিগেশনের কথা চিন্তা করে পুরো ব্যাপারটা জাস্টিফাই করি।

মূলকথা, কাদের ক্ষেত্রে 'দেখতে যাবো' এই সিদ্ধান্ত খুব সূক্ষ্মভাবে নিতে হয়। জরুরি কাজের মধ্যে রোগীর মনে সাহস দেওয়ার জন্য হাই হ্যালো করতে যাওয়া সরকারি হাসপাতালের জন্য বিলাসিতাই বলা যায়। তারপরও গেলাম বাবার প্রতি ছেলের কনসার্ন দেখে। এছাড়া রোগীর ছেলেটির কথা বার্তাও বেশ ভদ্র এবং মার্জিত।

ছেলের পিছে পিছে রোগীকে দেখতে গেলাম। নিউরোতে সাধারণত পেশেন্টের কনশাসনেস লেভেল দেখার জন্য জিসিএস স্কোরিং করতে হয়। ডাক দিলাম রোগীকে। 'বাবা চোখ খুলেন তো দেখি, কী সমস্যা বলেন...'

রোগী চোখ পিটপিট করছে, তখনো চোখ একদম মেলেনি। তখন ছেলেটা বলে উঠলো, 'আব্বা উঠো, নার্স দেখতে আসছে...’

ওই মুহূর্তে আমার ছয় বছরের এমবিবিএস শিক্ষাজীবন গলায় দড়ি দিতে চাইলো।

 

 

২)

তখন মেডিসিনে ডিউটি চলছে।

মেডিসিনের অ্যাডমিশন রাতগুলো ভয়াবহ। কপাল খুব ভালো হলে চারটা পাঁচটার দিকে আধঘণ্টার জন্য বিছানায় পিঠ ঠেকানো যায়। খারাপ হলে তাও যায় না।  

ঘটনায় যাবার আগে বলে রাখা প্রয়োজন—এমনিতে আমি সাহসী প্রকৃতির মানুষ হলেও আমার অফিডিওফোবিয়া আছে। অফিডিওফোবিয়া শব্দটি আমি ক'দিন আগেই শিখলাম। পাঠককে তাই শেখানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। এর অর্থ হলো মারাত্মক  সাপ ফোবিয়া। শুধু মারাত্মক বললে সমস্যার গুরুত্ব বোঝা না-ও যেতে পারে। মারাত্মক টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি ফোবিয়া।

যা বলছিলাম।

রোগী এলো ভোর পাঁচটার দিকে।

সাপে কাটা রোগী। কাটা জায়গায় টাইট করে কাপড় বাঁধা।

ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করলাম, 'সাপ টা কি আপনি দেখেছেন?'

সাপে কাটা রোগীদের সাপ দেখা জরুরি, কারণ মাঝে মাঝে ইল্যুশন বা সন্দেহ থেকেও মানুষের মনে হতে পারে সাপ কেটেছে। আবার বিষধর সাপ কি-না এই তথ্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

রোগী বললো, 'সাপ তো দেখছিই। মেরে ব্যাগেও নিয়ে আসছি। আপনি দেখেন...’

এই বলে তড়িৎ গতিতে সে সাপটা টেবিলের উপর রাখলো।

এরপর আমার কী অবস্থা হলো, রাসেল ভাই, সেকথা আর না বলি....

 

৩)

এই গল্পটিও মেডিসিন বিভাগে থাকাকালীন সময়ের।

হাসপাতালে যখন নতুন রোগী আসে, তাদেরকে ইনিশিয়াল এক্সামিন করার জন্য দুটো নীল বিছানা রাখা আছে। বলা বাহুল্য, বিছানাগুলো বয়স এবং ময়লার ভারে জরাজীর্ণ। ভর্তি হবার পর এই বিছানায় রোগী শুয়ে থাকে। আমরা যেয়ে প্রথমে হিস্ট্রি নেই। বর্তমানে সে কী সমস্যা নিয়ে এলো, আগে কী সমস্যা ছিলো, কী ওষুধ খায়, শরীরের যে অংশে সমস্যা সেটা টিপে টিপে দেখা, প্রেশার মাপার মতো যাবতীয় কাজগুলো এখানে ঘটে।

তখন সন্ধ্যা হয়েছে কেবল।

রোগীর ভীষণ চাপ। 

ডক্টর রুমের সাথেই একটি নীল বিছানা। নতুন রোগী দেখার উদ্দেশ্যে বিছানায় গিয়ে দেখি চোখ বন্ধ করে এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। নাম-পুটু মিয়া। কারো নাম পুটু মিয়া হতে পারে—এ কথা নিজে না শুনলে কখনো বিশ্বাস করতাম না (তবে এর ক'দিন পর নুনু মিয়াকেও পেয়েছি)

যাই হোক, পুটু চাচার হিস্ট্রি নিলাম। তার পেটে ব্যাথা, মাথা ঘুরানো, বমি বমি ভাব, হাড়ে ব্যাথাসহ নানা সমস্যার কথা সময় নিয়ে শুনলাম। এরপর ধীরে সুস্থে এক্সামিনেশন করলাম, প্রেশার মাপলাম।

যখন প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য তার ভর্তির কাগজটি চাইলাম, পুটু মিয়া আমাকে বিস্মিত করে বললেন, 'আমি তো রোগী না। আমার ছেলে ভর্তি। আমি অর সাথে আসিছি। আমাদের বিছানা নাই তাই এই বিছানায় একটু শুইছিলাম..’

২৮৫ পঠিত ... ১৭:০৫, মে ২৫, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top