এক মহাজন ও তার ডিলেমাগুলো

২৫০ পঠিত ... ১৭:৫৯, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৪

6

লেখা: তারান্নুম মৃত্তিকা

পূর্ব কথা

কথায় বলে, বয়স যত কম রক্তের তাপমাত্রাও নাকি তত উপরের দিকে থাকে। যেই কারণে ইতিহাসের প্রায় সব মিটিং-মিছিল-প্রতিবাদ সভায় বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই নাকি স্বল্পবয়সী। কম বয়সী মানুষের হঠাৎ বুঝতে শেখার ক্ষমতা হলে আশেপাশের অন্যায়-অনাচার-ভুলভ্রান্তি তাদের মধ্যে রাগের উৎপত্তি ঘটায়, তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটে। এই জ্বালা কমাতে ওরা প্রথমে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করে।

প্রতিবাদ শুরু হয় যুক্তি দিয়ে, তারপর পর্যায়ক্রমে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়ে৷ বুঝতে পারে, প্রতিবাদের এই রুপও অকার্যকর। তাই ওরা রাজপথ দখল করে, গলার রগ ফুলিয়ে স্লোগান দেয়, অন্যায়কারীর ভবন ঘেরাও করে, গাড়ি ঘোড়া ভাঙচুর করে। জমে থাকা রাগ সব শহরের রাস্তায় উগড়ে দেয়। অনেকে আবার সৃষ্টিশীল উপায়েও প্রতিবাদ করে। প্ল্যাকার্ড হাতে, কবিতা লিখে, দেয়ালে-কাগজে-ব্যানারে-টাচস্ক্রিনে-রাস্তায় চিত্রকর্ম এঁকে শহর প্রতিবাদের ধ্বনিতে ঢেকে দেয়। শহরের অলিতে-গলিতে গিয়ে মোমবাতির আলোয় যেন ওরা রাতের বেলার নিকষ কালো আঁধার ঘুচিয়ে দেয়।

যারা রাস্তায় নামতে পারে না, তারা ঘরে বসে একাত্মতা প্রকাশ করে। চলমান অন্যায় দমন করার জন্যে যেই মানুষরা রাস্তায়, দাঁড়িয়ে তাদের কর্মকাণ্ড টিভি স্ক্রিনে দেখে, বুকে সংহতি আর ঘর জুড়ে সুনসান নীরবতা। আর যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তারা তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে এমন রাগের বিস্ফোরণ দেখে কিছুটা হলেও ঘাবড়ে যায়। তারা সংখ্যালঘু হয়েও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিবাদকারীদের থামানোর জন্যে যা করা দরকার তাই করে। তথাকথিত ক্ষমতার এতটাই তথাকথিত শক্তি! তরুণ চোখ এসব দেখে, আর হৃদয়ে সারা পৃথিবীর উপর অভিমান নিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। মহাজনের কাছে অন্যের জীবনের চেয়ে নিজের দাম্ভিকতা ভরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই যেন বড় ব্যাপার! এরা কী আর জানে, নবীনেরা একাই একশো, আর তারা নিজেরা যে একশোই একা?

আবার হয় অন্যায়, নবীনেরা আবার নামে রাস্তায়। আবার নামে রাস্তায়, আবার হয় অন্যায়। এই চক্রের নিয়মের জালের যেন কোনো হেরফের নাই; সূর্যোদয়ের পর সূর্যাস্তের মতোই। যেন চলতেই থাকবে!

সময়ের বহমানতার রেশ ধরে সবই বদলায়। কিছুদিন আগেও টগবগ করে ফুটে রক্ত যেন চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইত। সেই রক্তই এখন ক্ষণিকের ঠুনকো বুদবুদ ফুটিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল হতে থাকে। সেদিনের নবীনেরা সাঁইসাঁই করে বেড়ে উঠলেও পরিবর্তন ধীরে ধীরে গদাইলস্করি চালে ঘটলে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় ভোগে।

তাদের মধ্যে এক দল বুঝে যায়, টিকতে চাইলে মানিয়ে চলা ছাড়া উপায় নাই। যোগ্যতমের জয়। সুতরাং টিকে থাকার জন্য তারা সিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় খাবি খেতে থাকে। স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে তারা অনেকেই মুখে কলুপ আঁটে।

বাকিরা এই অনাচারের বিরুদ্ধে সারাজীবন যুদ্ধ করে, সমাজ সংস্কারের কাজে নেমে পরে। 'আরও এক বিপন্ন বিস্ময়' তাদের 'অন্তর্গত রক্ত' আর শরীরের প্রতিটা কোষে বিরামহীনভাবে নাচলেও ক্লান্তি তাদের পরাস্ত করে না। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের দেখে ভরসা পায়, ভাবে— নাহ্, এখনও মানব প্রজাতির উপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারানোর সময় আসেনি। সাম্প্রতিক ইতিহাসই ঘেঁটে দেখো বিশ্বাস না হলে! এদিকে আরেক দল এসব ব্যাপারে নির্মোহ থাকে, সম্ভবত তাদের পরিস্থিতিই বিভিন্ন সংবেদনশীল ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকার প্রণোদনা যোগায়।

এবং এদের মধ্যবর্তী এক সংখ্যালঘু দল থাকে যারা পরবর্তীতে অন্যায় অনাচার অবিচার দূর্নীতি করে জীবন কাটায়। এদের সংখ্যা কম। সবাই মিলে এদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেই; খেল খতম। তবুও তারা, 'আমি একাই রাজা আমার এই রাজার রাজত্বে' নীতিতে চলে, এবং কেউ এর অমান্য করলে তাদের খেল খতম। হাস্যকর ব্যাপার হলো, এদের মধ্যে অনেকেই কম বয়সে যেই অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত তাদের 'আদর্শেই' অন্যায়কারী হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। নিয়তির এক নির্মম প্রতিধ্বনি!

তবে, তারা যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্যবর্তী, খ্যাপাটে বিপ্লবীদের চাপে অনিবার্য পতনের আগ মুহূর্তে দুই নৌকায় পা দিতে গিয়েও শেষ রক্ষা পায় না। কর্মফল তাদের হ্যাঁচকা মেরে নৌকা দুটির মাঝখানে অতলের দিকে টানতেই থাকে! নৌকাডুবি!!

বর্তমান পরিস্থিতি—

বয়স্ক দাপুটে ব্যক্তি তার বিলাসবহুল অফিস কক্ষে আরামদায়ক আর্ম চেয়ারে নিশ্চিন্তে বসে আছেন। ডান দিকে বাইরের জানালার পর্দা গলে উষ্ণ স্নিগ্ধ রোদ গায়ে লেগে আলস্য জাগিয়ে তুলছে। তবে তিনি কিঞ্চিৎ চিন্তিত, যদিও তার চিন্তার কোনো কারণই নাই। এক ফাঁকে জানালার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাসটা খুলে বাইরে তাকাতে গেলেন। সাথে সাথে মানুষের কোলাহল যেন কানের পর্দার নিচে বিকট বোমা ফাটাল। নিচে বিক্ষোভকারীরা গেট ধাক্কিয়ে ভাঙার চেষ্টায় ব্যস্ত। এরমধ্যে কয়েকজন পিচঢালা রাস্তা থেকে রোড ডিভাইডার মাথায় তুলে গেটের দিকে তেড়ে আসছে। একের পর এক গলা ফাটানো প্রতিবাদী স্লোগান, প্রতিটা বাক্য তার বিরুদ্ধে। সবাই তার পতন চায়। তবে বয়স্ক ক্ষমতাবানের এতে কিছু আসে যায় না, তার ক্ষমতাবলে একদল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মিছিল ঠেকাতে ব্যস্ত। প্রতিবাদকারীরা সীমা অতিক্রম করলেই টিয়ার গ্যাস ও গুলি বর্ষণ শুরুর আদেশ আছে। যেকোনো মূল্যে ভিভিআইপিকে সুরক্ষিত রাখতেই হবে। বয়স্ক দাপুটে মানুষটি জানালার গ্লাস বন্ধ করে পর্দা নামিয়ে দেন। সামনে রাখা ঠান্ডা পানির গ্লাসের ছোটো ঢাকনাটা সরিয়ে ঢকঢক করে চুমুক দেন। এক নিঃশ্বাসে এক গ্লাস পানি শেষ। হাত বাড়িয়ে রিমোটটা নিয়ে এসি চালু করলেন। আজকের খবরের কাগজও পড়ার মতো না, অবশ্যই ওই একি পুরাতন ভুজুংভাজুং দিয়ে ভরা। রাবিশ! মানুষ এসব বাদ দিয়ে কাজ কর্ম করলে দেশ এতদিনে উন্নতির বড় জোয়ারে ভাসত! সাইড টেবিল থেকে তিনি রিডার্স ডাইজেস্টের এক পুরাতন সংখ্যা বের করে আয়েশী ভঙ্গীতে পাতা ওল্টাতে চেষ্টা করলেন। তাও কেন জানি চিন্তা দূর হচ্ছে না, ব্রেইন ক্যাফেইন চাচ্ছে। এই মাত্র তার টেবিলে দুই শট এসপ্রেসো রেখে যাওয়া হয়েছে। তিনি চুমুক দিলেন। আহ্, কফি বিন চূর্ণ করে তৈরি এই জিনিসটা মুহূর্তে মানসিক চাপ কমিয়ে দেয়। এই এসপ্রেসো যেই কফি বিন থেকে বানানো হয়েছে তার বুৎপত্তি ব্রাজিল বলেই মনে হয় এত ভালো মানের, এই দেশ কফি উৎপাদনে সারা পৃথিবীতে নাম্বার ওয়ান!

আচ্ছা, তার বুৎপত্তি কোথা থেকে? তিনি কোথা থেকে এসেছেন?

 

২৫০ পঠিত ... ১৭:৫৯, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top