শিবরাম চক্রবর্তীর জীবনের ২৯টি টক-ঝাল-মিষ্টি গল্প

২০৩৯৫ পঠিত ... ১৬:৫৭, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮

জন্মেছিলেন গত শতাব্দীর শুরুর দিকে। ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মালদা জেলার চাঁচোলের রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী হয়ে জন্মালেও সে সবে কোন আগ্রহ ছিল না কখনো। কৈশোরেই যখন তখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতেন যখন তখন। এরপর তো একটা বয়সে একেবারেই ঘরছাড়া হলেন। পরবর্তীতে লিখে ফেললেন উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে'।

প্রথম জীবনে কবি হয়ে থাকলেও পরবর্তীতে গল্প, উপন্যাস, নাটক সবই লিখেছেন। আর প্রায় সবই ছিল রসাত্মক। বাংলা সাহিত্যে শিবরামের মতো রসবোধসম্পন্ন আর কোন সাহিত্যিক আছে কি না, তা নিয়েই চলতে পারে বিস্তর তর্ক। ফিকশন হোক আর নিজের জীবনের কথা, সবটাতেই যেন রস ঝরে পড়ছে। কিন্তু পুরো জীবন কাটিয়েছেন দুর্দশার মাঝে। প্রাচুর্য ছেড়ে একটা মেসবাড়িতেই কাটিয়েছেন পুরো জীবন, কখনো করেননি বিয়েথা। সাহিত্যের পাশাপাশি করেছেন স্বদেশী আন্দোলন। নিজ দুর্দশার কথা এতো মজা করে বলতে পারতেন, শুনে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়।

শিবরাম চক্রবর্তীর দীর্ঘ জীবনের চমৎকার সব ঘটনা, অভিজ্ঞতার সামান্য কিছু নমুনা থাকছে eআরকির পাঠকদের জন্য। 

 

মুক্তারামের শুক্তারামের আঁতুড়ঘর।
৬.
শিবরামের বাবা ছোটবেলায় শিবরামের বিভিন্ন রকমের বই পড়ার নেশা দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন, গ্রন্থি ভবতি পণ্ডিতঃ --যারা গ্রন্থ নিয়ে পড়ে থাকে তারাই পণ্ডিত হয়।

এই শুনে শিবরামের মা বলেন, ঠিকই বলেছেন তোর বাবা। যারা বই মুখে করে পড়ে থাকে সব সময়, তাদের সবকিছুই পণ্ড হয়ে যায়, সেইজন্যেই তারা পণ্ডিত।

 

৭.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে--

বিভূতিবাবুকে একদিন দেখলাম কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে রিকশা টানতে টানতে আসছেন। না, ঠিক টানাটানি না হলেও, রিকশার প্রতি তাঁর একটা টান দেখলাম।

এবং রিকশাটানা না বলে রিকশাটানায় বাধাদানও বলা যায় বোধহয়, রিকশায় বসেছিলেন এক তন্বী তরুণী, অসামান্য লাবণ্যের। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রী পরিচয় দিলেন বিভূতিবাবু, মায়া না কী যেন নাম, মনে পড়ছে না এখন।

বিভূতিবাবু একটা হাতল ধরে রিকশার পাশাপাশি পয়দল, আর রিকশাওয়ালা দুটো হাতল ধরে মধ্যস্থল দখল করেও বেকায়দায়; বিভূতিবাবুর টানাপড়েনের মাঝখানে পড়ে রিকশা নিয়ে যুতমত এগুবার যো পাচ্ছে না বেচারা।

আর উনি মায়া বাড়িয়ে রিকশার সঙ্গে পদে পদে এগিয়ে চলেছেন। এদিকে উনি তো হ্যান্ডেল ধরে হাঁটছেন, ওদিকে সেই মেয়েটি রিক্‌শার অর্ধেকটা মাত্র জুড়ে রয়েছে--মেয়েটি অর্ধাসনে আর বিভূতিবাবু এই অনশনে--দৃশ্যটা বেজায় বিসদৃশ ঠেকলো আমার।

বললাম, বিভূতিবাবু, জানেন তো ? নেচার এভারস ভ্যাকুয়ম। ব্যাকরণের প্রশ্নে শূন্যস্থান পূর্ণ করার মতন সর্বদাই সে শূন্যতা মোচনে তৎপর। আধখানা রিকশা বেবাক খালি যাচ্ছে, আপনি যদি নেহাত না বসেন, তাহলে অনুমতি দিলে আমি এই শূন্যস্থল পূর্ণ করতে পারি।

বলতে না বলতে বিভূতিবাবু রিকশা থামিয়ে তৎক্ষণাৎ মেয়েটির পাশে উঠে বসেছেন। আমিও খুশি হয়ে বিদায় নিয়েছি।

 

৮.
শিবরাম কহেন: মন্দির-মসজিদ-গির্জা যাই বানানো হোক না কেন‚ সেখানে শুধু একধর্মের লোকেরাই আসবে। সুতরাং পাশাপাশি মন্দির-মসজিদ-গির্জা গড়লে একদিন হয়ত মারামারি লাঠালাঠিও বেধে যেতে পারে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে এই পায়খানাই বানিয়েছি। সবাই আসছে এখানে। আসবে চিরদিন। হিন্দু, মুসলমান, জৈন, পার্শী, খেরেস্তান। কেউ বাকি থাকবে না। সর্বধর্ম-সমন্বয় এইখানেই।

 

৯.
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারেননি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। অথচ একসময় এই শরৎচন্দ্রকেই ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করতেন শিবরাম।

নিজের একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও নিয়ে গেছিলেন শরৎচন্দ্রের কাছে, ‘যদি দুটো লাইন লিখে দেন ভূমিকায় তাহলে একটা প্রকাশক জোটে' এই আশায়।

লিখেও দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। সেই সম্পর্কই এক ঘটনায় চুরমার হয়ে গেল।

'দেনাপাওনা' উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম। নাম হয়েছিল ‘ষোড়শী'। সকলেই জানে সে কথা। স্বয়ং লেখকও জানেন।

অথচ সেই নাটক যখন ‘ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেখানে নাট্যকারের নাম বদলে শরৎচন্দ্রের নাম!

শিবরামের বদলে শরৎবাবুর নাম দিলে পত্রিকা বিক্রি হবে বেশি। সম্পাদকের যুক্তিতে চুপ থাকলেন শিবরাম। নাটক নিয়ে গেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে। নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত নাট্যাচার্য।

''অসাধারণ নাট্যরূপ দিয়েছেন! আমি করব।''

শুরু হল শো। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল। এদিকে তখন দেনার দায় জর্জরিত খোদ নাট্যকার শিবরাম।

নাট্যাচার্যকে বললেন, 'শিশিরবাবু, কিছু টাকা পেলে ভাল হয়। নাটকে আমার লভ্যাংশ থেকে যদি কিছু দিতেন।'

নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে আসতে বললেন শিশির কুমার। গেলেন।

শো শেষে সাজঘরে গিয়ে হাত পাততেই শিশিরকুমার বললেন, ‘দেরি করে ফেললেন। আজ টিকিট বিক্রির সব টাকা একটি থলেতে ভরা ছিল, শো শেষ হতেই শরৎবাবু সাজঘরে এসে সব টাকা নিয়ে চলে গেলেন।'.

'সে কী! আপনি বললেন না আমার কথা!’ হতবাক শিবরাম।

'বলেছিলাম।' শরৎ উত্তরে আমায় বললেন, ‘শিবরাম টাকা দিয়ে কী করবে? বিয়ে-থা করেনি, কিচ্ছু না। ছেলেপুলে নেই, ঘর-সংসার নেই, টাকার তার কীসের দরকার?’ আমি বললাম তবু কিছু দিন অনুগ্রহ করে...। খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে ও। আজ আসবে ও কিছু টাকার আশায়। শুনে বললেন, ‘না না। এই বেনিফিট নাইটের বখরা ওকে দিতে যাব কেন? এ রাত্তিরে টিকিট বিক্রি হয়েছে আমার নামে। এর মধ্যে শিবরাম আসছে কোথা থেকে!’ বলে টাকার থলে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন শরৎ । হয়তো আপনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেই জন্যই।

শিশিরকুমারের কাছে এই কথা শুনে চুপ শিবরাম। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না!

মাথা নিচু করে ফিরে আসছেন, পিছন থেকে ডাক দিলেন শিশিরকুমার, ‘দাঁড়ান একটু।' বলে একজনকে বললেন, ‘আমার চেকবইটা নিয়ে আয় তো।’

চেকবই এল।

'আমার অ্যাকাউন্টে কত আছে জানিস?’

'একশো কুড়ি টাকা।'

'শিবরামবাবু, আপনার নামের বানান বলুন।'

'আমার তো কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই।'

'বেশ তাহলে এই একশো কুড়ি টাকারই একটা সেলফ চেক কেটে দিলাম। আমার আর কিছু নেই, বিশ্বাস করুন, থাকলে সেটুকুও দিতাম। কিছু মনে করবেন না।'

সেই চেক হাতে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে ফিরে এসেছিলেন শিবরাম। কথাশিল্পীর প্রতি জমে ওঠা এত দিনের শ্রদ্ধা যেন চোখের সামনে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল।

যে শিবরাম কখনও কারও নিন্দা করেননি, সেই তিনিও ‘দরদি' কথাশিল্পীর অমন আঘাত ভুলতে পারেননি শেষ দিন পর্যন্ত।

এই সেই রান্নাঘর যেখানে মুক্তারামের শুক্তারাম তৈরি হত, এখনো হয়।

১০.
এমনিতে টাকাপয়সা, সম্পত্তির প্রতি কোনও দিনই শিবরামের আসক্তি ছিল না।

নেহাত পেটে টান না পড়লে টাকার চিন্তাও করতেন না। পুরো জীবনটাই যেন তার কাছে ছিল একটা ঠাট্টা।

প্রেমেন্দ্র মিত্রর সঙ্গে আচমকাই পরিচয় হল এক সিনেমা হলে। শিবরামের আবার রোজ একটি করে সিনেমা না দেখলে খাবার হজম হয় না। তো, পরিচয়ের একটু পরেই দু'জনের গল্প এমন তুঙ্গে উঠল যে সিনেমা দেখা মাথায়।

শিবরাম তখন ওই সিনেমা হলেরই সিটে বসে প্রেমেন্দ্রকে নিয়ে মানসভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। এই দেশ ওই দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রও হাঁ করে শুনছেন।

মোটামুটি কোন কোন দেশ ঘুরতে যাওয়া হবে তার খসড়া রেডি। তখন প্রেমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিন্তু এত দেশ যে ঘুরব দু'জনে টাকা কই?’

'আরে লাখ টাকার মামলা ঠুকেছি ভায়া। জিতলাম বলে। ওই টাকা হাতে পেলেই বেরিয়ে পড়ব দুই বন্ধুতে।'

হ্যাঁ, সত্যিই শিবরাম সেবার এক লাখ টাকার মামলা ঠুকেছেন তার পৈতৃক সম্পত্তির দাবিতে। যাকে বলে একেবারে শিব্রামীয় মামলা।

উকিল ব্যারিস্টার কেউ নেই। শিবরাম নিজেই সব। প্রমাণ বলতে একজন সাক্ষী। আর সেই সাক্ষী কে? যার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন স্বয়ং তাকেই নিজের পক্ষের সাক্ষী বানিয়েছেন শিবরাম। এতই বিশ্বাস যে সাক্ষী মিথ্যে বলবেনই না।

এ দিকে যা অবশ্যম্ভাবী, তাই-ই ঘটল।

আদালতে দাঁড়িয়ে সেই প্রতিপক্ষ তথা সাক্ষী বলল, ‘ধর্মাবতার শিবরামবাবুর এই অভিযোগ সবটাই মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন।'
ব্যস, সাক্ষীর একটি কথাতেই পুরো মামলা ডিসমিস।

 

১১.

এক ধূপকাঠিওলার ছদ্মবেশে দিনদুপুরে এক চোর ঢুকল শিবরামের ঘরে।

ঘর মানে, যেখানে মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তারাম খেয়ে শিবরাম থাকেন সেই মেসের ঘরে।

বাইরে গেলে কোনও কালেই ঘরে তালা দেন না, তালা দিয়ে লাভ কী? কিছুই তো নেই ঘরে। শুধু চার দেওয়ালে অজস্র নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা। শিবরামের অকাট্য যুক্তি, 'খাতা হারিয়ে গেলেও দেওয়াল হারানোর কোনও সুযোগ নেই।'

চোর ঢুকে গোটা ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পেল না। ফিরে গেল।

সন্ধেবেলা শিবরাম ঘরে ঢুকে দেখে জামাকাপড়, লেখার কাগজপত্র, কম্বল-বালিশ সব তছনছ। আর তক্তপোশের ওপর রাখা একটি দশটাকার নোট এবং এক প্যাকেট ধূপকাঠি আর একটি চিঠি।

চিঠিতে লেখা, ‘ভাই তোমার ঘরে চুরি করতে এসে দেখলাম তোমার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। কাজকম্ম বোধহয় কিছুই করো না। এই দশটা টাকা রেখে গেলাম। এই টাকায় এই কোম্পানির ধূপকাঠি কিনে ফেরি কোরো। এইভাবে কত দিন চলবে? আমার পরামর্শ মানলে জীবনে উন্নতি করবে।’

 

১২.
ধূপকাঠি ফেরি না করলেও জীবনের প্রথম রোজগার শুরু করেছিলেন কিন্তু ফেরিওলা হয়েই। খবরের কাগজ ফেরি।

গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা এসেছে কিশোর শিবরাম। কোথায় থাকবে, কী করে পেট চলবে জানা নেই। সুতরাং দুই বেলা কখনও ভিখিরিদের সঙ্গে পঙ‌্ক্তিভোজ আর রাত্রে ওই ভিখিরিদের সঙ্গেই ফুটপাতে বা মন্দিরের গায়ে লাইন দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা। একদিন হঠাৎই পরিচয় হল তারই বয়েসি একটি ছেলের সঙ্গে।

'আরে তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, এই ভাবে ভিখিরিদের সঙ্গে বেশি দিন থাকতে পারবে না। এক কাজ করো।'

'কী করব তাহলে?' শিবরামের প্রশ্ন।

'তুমি আমার মতো খবরের কাগজ ফেরি করো। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।'

ব্যস, শুরু হয়ে গেল পরদিন থেকেই। কখনও হেদুয়া তো কখনও শ্যামবাজার, কখনও বউবাজার তো কখনও গোলদিঘি। কিন্তু কাগজ বেচাও অত সহজ নয়। পুরনো ফেরিওয়ালারা নতুনকে ঢুকতে দেবে কেন? তাই বার বার জায়গা বদল। সারাদিন কাগজ বেচে যা কমিশন হাতে আসে তাই দিয়ে আগেই রাবড়ি, রসগোল্লা, চপ-কাটলেট এবং অবশ্যই সিনেমা।

রোজের রোজগার রোজই শেষ।

রবিবার ইস্কুল-আপিস বন্ধ তাই সব ফেরিওয়ালারই সারাদিনে কাগজ বিক্রি হত কম।

ফেরিওয়ালারা কাগজ তুলতও কম। শিবরাম কিন্তু কাগজ তুলে সেদিন সকালে বিশেষ বিক্রির চেষ্টা না করে সন্ধেবেলায় উত্তর কলকাতার একটি সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন।

রবিবার হাউসফুল। সিনেমা শুরুর আগে পর্যন্ত কেউ কিনত না। কিন্তু যেই শুরু হত তার একটু পর থেকেই তিরবেগে নিজের সিট ছেড়ে বাইরে উঠে আসতেন দর্শকরা, তারপর শিবরামের থেকে বাংলা ইংরেজি উর্দু নির্বিশেষে যা হোক একটা দুটো কাগজ কিনে আবার ঢুকে যেতেন ভেতরে।

আসলে, ওই হলের সিটে এত ভয়ংকর ছারপোকা ছিল যে কাগজ না পেতে বসার উপায় নেই।

শুধু একটা কাগজ কিছুতেই বেচতেন না, রেখে দিতেন নিজের জন্য।

টিকিট আগেই কাটা থাকত। সব বিক্রি শেষ হলে ওই কাগজ হাতে নিয়ে ঢুকে পড়তেন হলে।


১৩.
বাউণ্ডলেপনা ছিল তাঁর রক্তে। নইলে রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হয়ে কেউ সব ছেড়েছুড়ে এমন ভবঘুরে জীবন কাটায়?

উত্তরবঙ্গের চাঁচোল। সেখানকার রাজা ঈশ্বরগুপ্তের দুই স্ত্রী। সিদ্ধেশ্বরী আর ভূতেশ্বরী।

রাজা দুই স্ত্রীকেই অপুত্রক রেখে দেহ রাখলেন। তখন সিদ্ধেশ্বরী দেশের থেকে নিজের বোন বিন্ধ্যেশ্বরীর ছেলে শিবপ্রসাদকে নিয়ে এসে তাকে দত্তক নিলেন।

এই শিবপ্রসাদ চক্রবর্তীই হলেন শিবরামের বাবা।

শিবপ্রসাদ রাজসম্পত্তির উত্তরাধিকারী তো হলেন কিন্তু তার এসবে কোনও কালে মন নেই। সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী। জাগতিক সব কিছুতেই নির্লিপ্তি।

আর মা? যাঁর প্রতি শিবরামের ছিল আজীবনের গভীর ভালবাসা, তিনিও সারাক্ষণ আধ্যাত্মিক জগতেই থাকতেন।

শিবরাম ছোটবেলা থেকেই দেখতেন বাড়িতে তার বাবা এবং মা, এই দু'জনের কেউই যেন লৌকিক জগতে থেকেও নেই। ফলে শিবরামেরও তাই হল। সংসারের প্রতি মায়া জন্মাল না।

একেবারে অল্প বয়স থেকেই বাড়ি ছেড়ে বারবার পালাত কিশোর শিবরাম। কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র, যখন যেখানে খুশি।

পকেটে এক পয়সাও নেই। ট্রেনে চেপে বসে, যা হোক তা হোক করে, যেখানে খুশি যত দিন খুশি কাটিয়ে আবার সে ফিরে আসত বাড়ি।

এসে দেখত এই অল্পবয়েসে কাউকে কিছু না জানিয়ে এত দিন বাইরে থাকার পরেও বাবা-মা দুজনেই নির্বিকার। একবার তাঁরা জিজ্ঞাসাও করতেন না, ‘এত দিন কোথায় ছিলিস?’ আর মায়ের তো বিশ্বাস ছিল মা দুর্গা সবসময় শিবরামকে রক্ষা করেন!

এমন পরিবেশে বড় হওয়ার জন্যই হয়তো রাজসম্পত্তি, সংসার কোনও কিছুতেই মায়া জন্মাল না কোনও দিন। তারপর ওই কিশোর বয়েসেই একদিন পাকাপাকি ভাবে বাড়ি ছেড়ে পালাল স্বয়ং দেশবন্ধু চিত্তররঞ্জন দাশের সঙ্গে।

 

১৪.
শিবরাম তখন প্রাথমিক স্কুলে।

দেশ জুড়ে চলছে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। স্কুলে মাস্টারমশাই প্রবন্ধ লিখতে দিলেন— বড় হয়ে কী হতে চাও?

ছাত্রদের কেউ লিখল ডাক্তার, কেউ উকিল। শিবরাম লিখল, দেশপ্রেমিক হতে চাই।

শিক্ষক অবাক!

স্কুল শেষে এক বন্ধু আড়ালে টেনে নিয়ে বলল, ‘তুই দেশপ্রেমিক হতে চাইলে আমাদের দলে নাম লেখা। আমিও বিপ্লবী, আমার মতো দেশের কাজ করবি।’

শিবরাম যোগ দিল ওই বিপ্লবীদের দলে। দলে ছোটদের কাজ হল গোপনে চিঠি আর অস্ত্র দেওয়া নেওয়া করা, যাতে পুলিশ সন্দেহ না করে।

একদিন শিবরামের ওপর দায়িত্ব পড়ল এক সাহেবকে গুলি করে হত্যা করার। তাও আবার এক বিশাল সভার মাঝে।

পিস্তল এসে গেল। পকেটে পিস্তল নিয়ে দুরুদুরু বুকে শিবরাম পৌঁছলেন সেই সভায়। সাহেবকে গুলি করার পরেই যে নিজেকেও মরতে হবে তাও অজানা নয়। দেশের জন্য মরতেও প্রস্তুত।

মঞ্চে সেই সাহেব যেই উঠেছেন অমনি দর্শকের আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন শিবরাম। গুলি ছোড়ার জন্য সবে পকেট থেকে পিস্তল বার করতে যাবেন অমনই মাইকে ঘোষণা, ‘শিবরাম চক্রবর্তী মঞ্চে এসো।'

কেন? উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হবে।

সবার চোখ তখন শিবরামের দিকে। আর উপায় নেই Gun এর বদলে গানই ব্যবহার করতে হল মঞ্চে। পকেটের পিস্তল পকেটেই রয়ে গেল! 

এই সেই বিখ্যাত ঘর যেখানে অর্ধশতাব্দীর ওপর অধিষ্ঠান করেছেন শিবরাম।

১৫.
দেশের কাজ করতেই হবে। নইলে জীবন বৃথা।

চাঁচোলে সভা করতে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। গোটা এলাকা ভেঙে পড়ল দেশবন্ধুর ভাষণ শুনতে। কিশোর শিবরামও পোঁছল সেই সভায়। দেশবন্ধুর ভাষণ শুনে এমন উদ্বুদ্ধ হল যে সিআর দাশ যেই ফেরার ট্রেনে উঠলেন অমনই ওই বগিতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল শিবরাম।

'আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাব।'

'কী করবে গিয়ে?'

'দেশসেবা। স্বদেশী করব।' শিবরামের সাফ জবাব।

'চলো তাহলে।'

কলকাতায় এসে উঠল এক মেসে, যেখানে সব অল্পবয়েসি স্বদেশীরা থাকে, ইস্কুলে যায়, চরকা কাটে।

সব ব্যবস্থা করে দিলেন দেশবন্ধু। তবে এও বললেন, ‘শুধু দেশসেবা করলে হবে না, সঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে কিন্তু।'

শিবরামকেও স্কুলে ভর্তি করা হল। সেই মেসের কড়া নিয়ম। মেস-ম্যানেজারের হাতে দেশবন্ধু দশটা টাকা দিয়ে বললেন, শিবরামের বই খাতা পেন জামা সব কিনে দিতে।

কী করে যেন সেই টাকা শিবরামের হাতে এল!

আর তারপর?

দু'দিনের মধ্যেই পুরো টাকা সিনেমা দেখে আর চপ কাটলেট খেয়ে শেষ।

ম্যানেজার চড়াও হলেন। কৈফিয়ত চাইলেন, ‘কোথায় তোমার বইখাতা? টাকাই বা কোথায় গেল?’

জেরার মুখে সত্যবাদী শিবরামের তখন সরল স্বীকারোক্তি।

ম্যানেজার ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে আর মেসে থাকতে হবে না। তুমি এখানে থাকলে বাকি ছেলেরাও গোল্লায় যাবে।'

ব্যস, আবার শুরু হল ভবঘুরের জীবন।

 

১৬.

স্কুল পাশ করার পরীক্ষাটা অবশ্য দিতেই হয়েছিল সি আর দাশের নির্দেশে। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ দিয়েই আবার পুরোদমে স্বদেশী আন্দোলনে।

তখন হাজারে হাজারে ছেলে জেলে যাচ্ছে ‘বন্দেমাতরম' বলে। শিবরামেরও খুব শখ জেলে যাওয়ার। কিন্তু অমন ল্যাকপেকে চেহারা দেখে পুলিশ কিছুতেই আর ধরে না।

একদিন ধরল। বলা যায় নিজেই একপ্রকার ধরা দিলেন। সেই জেলে গিয়েও অবাক শিবরাম। গ্রামে তার কিশোরী প্রেমিকা রিনি, যে কলকাতায় চলে এসেছিল সেও রয়েছে ওই জেলেই। জেলের মধ্যেই আবার প্রেমিকার সঙ্গে পুনর্মিলন। কিন্তু বেশি দিনের সুখ তো শিবরামের কপালে নেই। কয়েক দিন পরেই অন্য জেলে বদলি হয়ে গেল শিবরাম। আবার বিচ্ছেদ।


১৭.
তখন মুক্তারামের মেসে পাকাপাকি চলে এসেছেন।

একদিন রাতে কুখ্যাত টেগার্ট সাহেব স্বয়ং এসে হাজির শিবরামের মেসে। চারদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।

পাকা খবর, শিবরামের মেসে প্রায়ই নাকি বিপ্লবীরা এসে রাতে থাকে। টেগার্ট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার মেসে আর কেউ আসে?’

'আজ্ঞে হ্যাঁ, যার যখন খুশি চলে আসে। চলে যায়, আবার আসে।'

'এর মধ্যে কে এসেছিল?’

'আজ্ঞে, তারক এসেছিল।'

'কেমন দেখতে?'

শিবরামের বর্ণনা শুনে টেগার্ট বলে উঠলেন, ‘ইয়া দ্যাটস দ্য ম্যান। হি ইজ্ সিয়োরলি আ টেররিস্ট।'

'টেররিস্ট কি না জানি না স্যার তবে হি ইজ এ নভেলিস্ট।'

'নাউ হি ইজ আ রাইটার? নট এ টেররিস্ট ইউ মিন?'

শিবরামের জবাব, ‘বাট টু লিসন টু হিজ রাইটিংস নট লেস এ টেরর স্যার। আই ডোন্ট লাইক, কিন্তু কী করব? জোর করে সে শোনাবেই।'

এবার টেগার্ট কী বলবেন বুঝে পেলেন না। শিবরামের ঘর সার্চ হল। কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু তার পর দিন থেকে শিবরাম পেলেন অনেক কিছু। এলাকায় বিশাল নাম হয়ে গেল তাঁর। কেউ ভাবল পুলিশের চর, তো কেউ ভাবল বড় বিপ্লবী।

যারা পাত্তাই দিত না তারাই দুইবেলা খাতির করত। সব থেকে বড় পাওনা সাধনবাবুর সন্দেশের দোকানে ধারে রাবড়ি পাওয়ার ব্যবস্থা।

 

১৮.

টাকা নিয়ে টানাটানি আর যায় না। হবে নাই বা কেন? লিখে কিছু টাকা এলেই তো সঙ্গে সঙ্গে চপ কাটলেট, রসগোল্লা, বাবড়ি আর সিনেমা।

তাও আবার একা নয়। সঙ্গে কেউ থাকলে তাকেও পাকড়াও করে নিয়ে যেতেন দোকানে।

পেটপুরে খাওয়া, যতক্ষণ না শেষ পয়সাটাও নিঃশেষ হচ্ছে। আর কোনও নেশা নেই। ‘নেশা করলে রাবড়ির নেশা করাই ভাল।'—— এই হল শিবরামের সিদ্ধান্ত।

একবার তো বন্ধু কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ীর সঙ্গে গিয়ে ঘুগনিওলাকে বললেন, ‘তিন প্লেট ঘুগনি দাও।'

ঘুগনিওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, 'আপনারা তো দুইজন, আরেকটা কাকে দেব?'

'আরেকটা তুমি খাবে। কোনও দিন নিজের ঘুগনি খেয়ে দেখেছ? আজ খাও। আমি খাওয়াব।'

ঘুগনিওয়ালা এমন খদ্দের পেয়ে হাঁ। শিবরামের সামনেই নিজের বানানো ঘুঘনি খেয়ে তারপর তার নিস্তার।


১৯.
সে বার বেজায় টানাটানি চলছে। খবর কানে গেল দেশবন্ধুর। শিবরাম চিরকালই তাঁর বড় প্রিয়, বারবার বলতেন, শিবরাম আলাদা জাতের। অনেক প্রতিভা।

দেশবন্ধু চিঠি লিখলেন সুভাষ বোসকে।— ‘শিবরামকে আত্মশক্তি কাগজে নিয়ে নাও। ভালো লেখে ও।’

গুরুদেবের আদেশে শিবরামকে চাকরিতে নিলেন নেতাজি। কিন্তু মানুষটি যে শিবরাম! নিয়মকানুনের ধারে কাছে নেই। কোনও দিন অফিস যান তো কোনও দিন টিকিটি নেই। কখন আসেন আর কখন বেরিয়ে যান তা'ও কেউ জানে না।

সুভাষ বোসের কানে গেল সেকথা। এমন আচরণ নিয়মনিষ্ঠ নেতাজির কোনও মতেই পছন্দ নয়। শিবরামকে ওয়ার্নিং তিনি দিলেন ঠিক সময়ে রোজ দপ্তরে আসার জন্য। কিন্তু শিবরাম কোনও দিনই বা কার কথা শুনে চলেছেন? ফলে যা হওয়ার তাই হল। একদিন হাতে একটি খাম পেলেন। তার মধ্যে একশো টাকার একটি নোট আর সুভাষচন্দ্রের একটি একলাইনের চিরকুট। তাতে লেখা।— ‘আপনাকে আর দরকার নেই।' চাকরি নেই। এ বার দিন চলবে কী করে? ভয়ে তো কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু তিনি যে শিবরাম।

হাতে বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!

শিবরামের ঘরের বাইরেটা। লোহার কাঠামো যেটা সেটা ছিল শিবরামের বারান্দা। এখন এই বারান্দা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

২০.
কাগজের চাকরি যেমন গেছে তেমনই একবার আস্ত একটা খবরের কাগজেরই মালিক হয়ে গিয়েছিলেন শিবরাম। কিন্তু তার জন্যই আবার জেলে যেতে হল তাকে।

যুগান্তর সেবার দেউলিয়া। বন্ধই হয়ে যাবে এমন অবস্থা।

মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে শিবরাম কিনে ফেললেন যুগান্তর-এর স্বত্ত্ব। সম্পাদক হলেন। তখন অনেক কাগজেরই ইংরেজ সরকারের কোপে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যুগান্তর-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছেপে শিবরামও পড়লেন রাজরোষে।

একদিন দফতরের কাজ সেরে মেসের দিকে ফিরছেন, রাস্তাতেই খবর পেলেন পুলিশ এসেছে। তাঁকে খুঁজছে। শিবরাম বুঝে গেলেন। আগেই ঢুকে পড়লেন সামনে একটা মিষ্টির দোকানে, যদি জেল হয় তাহলে কত দিন মিষ্টি খাওয়া হবে না, কে জানে! আর আজ নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে পুলিশি জেরায়। সুতরাং কুড়িটা বড় সাইজের রসগোল্লার অর্ডার। ধরা যখন পড়তেই হবে, তখন রসগোল্লা খেয়ে ধরা পড়াই ভাল।

টপাটপ কুড়িটা রসগোল্লা আত্মসাৎ করার পর পকেটে হাত দিয়ে বুঝলেন একটা টাকাও নেই। এবার?

দোকানের মালিক সঙ্গে লোক দিয়ে দিলেন, শিবরামের সঙ্গে ওর মেস পর্যন্ত গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে।

বাড়িতে ঢোকার মুখেই গ্রেপ্তার হলেন শিবরাম। পুলিশকে বোঝালেন একজনকে টাকা মেটাতে হবে, একবার ঘরে ঢোকা দরকার। বলে পিছনে তাকাতেই অবাক! সেই কর্মচারী বিপদ বুঝে কখন পালিয়েছে! পাছে স্বদেশীকে মিষ্টি খাওয়ানোর অভিযোগে তাকেও জেলের ঘানি ঘোরাতে হয়!

 

২১.
শিবরামকে সেবার পাঠানো হয় বহরমপুর জেলে। সেখানে তখন কাজী নজরুল ইসলামও আছেন বন্দী হয়ে। শিবরাম যুগান্তর পত্রিকায় বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লিখতেন, কিন্তু এদিকে কোনও বিপ্লবী দলের সাথে শিবরামের পরিচয় ছিল না। এই শুনে কাজি হতবাক হয়ে পড়েছিলেন । শিবরাম কাজীকে বলেছিলেন--

দলাদলি আমি সর্বদা ডরাই । দল বাঁধলে, দলে ভিড়লে, নিজেকেও সেই দলে বাঁধা পড়তে হয় । দলে বাঁধা পড়ে ঐরাবতও মুক্তকচ্ছ হয়ে পড়ে, তা জানো ? হাতী যে হাতী, সেও দল বাঁধলো কি দ-য়ে মজলো - হাড়গোড় ভাঙা দ হয়ে গেলো । আমি মুক্ত বিহঙ্গের মতই থাকতে চাই ।

কাজী বললেন, কোনও বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ নেই, অথচ তোমার কাগজটা বিপ্লবের? এই যুগান্তর?

শিবরামের উত্তর, যুগান্তর না বলে একে হুজুগান্তর বলো বরং। তোমার ধুমকেতু (নজরুলের প্রকাশিত পত্রিকা) দেখে, তোমার দেখাদেখি আরও সবাই কাগজ বার করছে দেখে, সেই হুজুগে আমিও এই - আমারও ধুমধাম ।

এই জেল থেকেই কাজীর হাতের নানান মোগলাই রান্না খেয়ে কড়ে আঙুলের মত রোগা শিবরাম বুড়ো আঙুলের মত হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেরিয়েছিলেন। জেলখানার বিচার তো জেলের খানা দিয়েই।

 

২২.
বেশ কিছুদিন থাকার পর জেল থেকে ছাড়া পেলেন শিবরাম। ছাড়া পাওয়ার সময় জেলর বলেছিলেন, 'আপনার নিজের যা জিনিস আছে তা নিয়ে যেতে পারেন।'

নিজের বলতে তো কিছুই ছিল না। জেল থেকে দেওয়া দুটো কম্বল ছিল, যা নিয়ে যাওয়ার কারও নিয়ম নেই, তবু শিবরাম কী করে যেন ওই দুটোকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়।

তারপর মুক্তারামের তক্তারামে রসগোল্লার ওই দুটো কম্বল পেতেই কাটিয়েছেন বাকি জীবন।

 

২৩.
জেলমুক্ত শিবরাম কিছু পয়সা জুটিয়ে আগে গেলেন সেই মিষ্টির দোকানে। ধারের টাকা মেটাতে হবে যে! কিন্তু ঢুকতেই দোকানের মালিক হাতজোড় করে উঠে দাঁড়ালেন।--'দয়া করে বোমা মারবেন না। যা টাকা লাগবে বলুন দিয়ে দিচ্ছি।'

আসলে তত দিনে স্বদেশী নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে শিবরাম। জেলে যাওয়া মানেই সন্ত্রাসবাদী।

'না না আমি টাকা নিতে আসিনি।'

'আজ্ঞে যা আছে দিয়ে দিচ্ছি। স্বদেশের কাজ করেন, আমাদেরও তো সেবা করা উচিত।'  বলে কাঁপা হাতে ক্যাশবক্সে হাত দেন দোকানদার।

'আরে কী মুশকিল, আমি এসেছি আপনার ধার মেটাতে।'

শিবরামের কাছে সব শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন দোকানদার। টাকা তো নিলেনই না, উপরন্তু একজন মানুষ এক সিটিং-এ বসে কুড়িটা রাজভোগ খেতে পারেন শুনে, আবার কুড়িটা রাজভোগ শিবরামকে খাইয়ে নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করালেন। এবং আরও কুড়িটা হাঁড়িতে ভরে দিলেন। বললেন, 'বাড়িতে খাবেন আর দোকানে যখন খুশি এসে খেয়ে যাবেন। পয়সা লাগবে না।'

না, দ্বিতীয় দিন থেকে আর ওই দোকানের ধারেকাছে যাননি শিবরাম। ধারের ধার বেশি না ধরাই ভাল, এই ছিল শিবরামীয় যুক্তি।

 

২৪.
শিবরাম মিষ্টি খেতে কতটা পছন্দ করতেন তার নমুনা পাওয়া যায় বিখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে ভোজন বিষয়ক এক আলাপ থেকে। শিবরাম চক্রবর্তীর মুখেই শুনুন ঘটনাটি---

নারাণবাবুর বাড়ি গেছি একদিন, গৌরাঙ্গদের বাড়ি যাবার পথে গোলপার্কের কাছেই তাঁর আস্তানাটা, নানা ধরণের আলোচনা হচ্ছিল আমাদের।

কথায় কথায় শরীর গতিকের কথা উঠল। আমার হাই ব্লাডপ্রেশার, ওঁর তো তা রয়েছেই, তার ওপরে আবার ডায়াবেটিস।

'আমার ওই ব্লাডপ্রেশারই ভাল মশাই, ডায়াবেটিস আমার চাই না।'

'চান না?'

'না। ব্লাডপ্রেশারে নুন না খেলেই চুকে যায়, সল্ট-ফ্রি খাবার হলেই হল, কিন্তু ডায়াবেটিসে সুইট-ফ্রি থাকতে হয়। সে ভারী মুস্কিল। মিষ্টি না খেয়ে আমি থাকতে পারি না।'

'তা বটে।'

সঙ্গে সঙ্গে ওঁর বাড়ির ভেতর থেকে ফরমায়েসী গরম গরম রসগোল্লা এসে পড়ল। তার সদব্যবহারে লেগে বললুম, 'ডায়াবেটিস হলে এসব আর মুখে তুলতে পারব কি? শুধু সেই একটিমাত্র মিষ্টি ছাড়া আর কিছুই তো মুখে তোলা যাবে না। এবং সেই মিষ্টিই বা পাব কোথায় এখন? এই বয়েসে কে দেবে আমায় আর!'

আমার কথায় তিনি মৃদু হাসলেন।

ব্লাডপ্রেশার নিয়ে খাসাই আছি বলতে কি! দুটি মাত্র ভয় তো, করোনারি থ্রম্বোসিস আর সেরিব্রাল হ্যামারেজ-এর। করোনারি আটকাতে চর্বিজাতীয় কিছু না খেলেই হল। চর্বিতচর্বণ বাদ দিয়েছি একদম। আর সেরিব্রাল হ্যামারেজের হাত থেকে রেহাই পেতে ওষুধ খাই। যা সব চমৎকার ওষুধ বেরিয়েছে না আজকাল !

'কী করেন?'

'ডাক্তার যা বলেছেন। কাজকর্ম সব বন্ধ করে দিই, আডেলফিন উইথ ইসিড্রেক্স এক বঁটি খেয়েই না লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। সলিড কিছু খাই না আর তারপর। খালি হরলিক্স। এই বটি আর বিশ্রাম। দেখতে না দেখতে আরাম।'

'কি করে টের পান আসন্ন হ্যামারেজ?'

'মাথা ক্রিক ক্রিক করলেই বুঝতে পারি যে, গড়বড় হয়েছে হেড আপিসে। নইলে অকারণে তাঁর এই সহসা ক্রিংকার কেন? যতক্ষণ না সেই ক্রিক রোডের মোড় থেকে ফিরেছে, স্বস্তি নেই আমার। ওষুধ খাবার আর বিশ্রাম নেবার খানিক বাদেই মাথা সহজ হয়ে আসে আবার। তারপরে হরলিক্স খেয়ে টানা ঘুম লাগাই। সেদিন আর কোনও কাজ নেই।'

'আরে মশাই আমারো যে মাথা ক্রিক ক্রিক করে মাঝে মাঝেই।' তিনি জানান।

'কী করেন আপনি?'

'কিছুই না, কী করব! কাজকর্ম যা করার করে যাই তেমনি।'

'লেখেন-টেখেন তখনো?'

'নিশ্চয়ই!'

'কোনও ওষুধ খান না?'

'কেন খেতে যাব অকারণে? তাছাড়া, না লিখে কি থাকা যায়? দায় আছে না মাথায়? ডিউটি ফার্স্ট।'

'তা জানি। কিন্তু ওষুধ ফোরমোস্ট! সব কর্তব্য ফেলে রেখে ওষুধ খেতে হয় সবার আগে।'

নারায়ণবাবু যেমন লেখা পাগল দেখা গেলো, আমার ভয় হল, কোনদিন না এই লেখার জন্যেই তিনি শহিদ হয়ে যান।

'ওষুধ বেশি খেতে নেই। যখন তখন তো কখনোই নয়। ওষুধের একটা প্রতিক্রিয়া আছে--সেই বিষক্রিয়ায় আবার ভুগতে হয়।'

'জানি, কিন্তু এই ভোগবতী বসুন্ধরায় ভোগ এড়াবার উপায় নেই, হয় ওষুধে ভুগুন, নয় অসুখে ভুগন - ভুগতেই হবে আপনাকে। ওষুধে ভোগাটাই ভালো নাকি? আর ব্যারামে ভুগলে আপনারও কষ্ট, আপনাকে নিয়ে আশেপাশের আর সবারও ভোগান্তি। বাধ্য হয়ে আমায় আবার ডাক্তার বদলাতেও হয় যে।'

'ডাক্তার বদলাতে হয়?'

'হবে না? বেঘোরে মারা পড়লে কী করা যায়? বিশ বছর আমি হাই প্রেশারে ভুগছি-- এর ভেতর আমার তিন-তিনটে ডাক্তার একই রোগে স্বর্গীয় হয়েছেন। চতুর্থ ডাক্তার, আমার বন্ধুতুল্যই, ডাঃ কে পি রায়কে ধরেছি এখন, জেনেছি তাঁরও এই প্রেশার, তাই করজোড়ে তাঁকে নিবেদন করেছি--'দোহাই, আমি মারা যাবার আগে যেন মহাপ্রয়াণ করবেন না দয়া করে। তাহলে আমায় দেখবার কে থাকবে? যে ঔষধ আমার জন্যে ব্যবস্থা করেছেন, আপিনিও না হয় তাই খাবেন দরকার পড়লে, অন্যথা না হয়।' 

শিবরাম সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে খুব অপছন্দ করতেন, কারন ওনার নাকি কানের কাছে কারোর খ্যাঁচখ্যাঁচানি পছন্দ হতো না। সে কাঁচি হোক বা স্ত্রী, এইজন্যেই নাকি উনি বিয়ে করেননি।

২৫.
শিবরাম চক্রবর্তীর সাথে জনপ্রিয় অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আছে মিষ্টি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা।

ছিয়াত্তর-সাতাত্তর সাল নাগাদ একদিন সকালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গাড়ীতে দুজন সঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তায় একটি মিষ্টির দোকান থেকে বড় বড় জলভরা সন্দেশ কিনে গাড়ী এসে থামল মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের একটি পুরনো মেসবাড়ির সামনে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরের সামনে পৌঁছতেই ভানুবাবু তাঁর সঙ্গীকে বললেন, আগে দেখ তিনি ঠিক জায়গায় আছেন কিনা।

সঙ্গী আদেশমত ঘরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এসে জানালেন, হ্যাঁ, ঠিক জায়গায়ই আছেন।

ভানু বাবু তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্রথম সঙ্গী ঘরে বসে থাকা বৃদ্ধকে বললেন, এই দেখুন, ভানুদা এসেছেন।

বৃদ্ধর চোখে মুখে শিশুর সরলতা। একটা চার বাই পাঁচ কিংবা তার থেকেও ছোট চট পাতা চৌকিতে সেই বৃদ্ধর চৌকিদারি। সেই সিংহাসন থেকেই রাজাধিরাজ একবার তাকিয়ে প্রায় নিমেষের মধ্যে বুকে টেনে নিলেন ভানু বাবুকে। ভানু বাবুও আশ মিটিয়ে জাপটে ধরলেন আরেক রসরাজ শিব্রাম চকরবর্‌তিকে।

শিবরাম বাবুর প্রাণখোলা হো-হো হাসি, ভানু বাবুর চোখ চিক্‌ চিক্‌ হা-হা হাসির যুগলবন্দীতে ১৩৪ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের পুরনো মেসবাড়ীটা হঠাৎ যেন জলসাঘরে পরিণত হল। দুই পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ যেন একে অপরের সারল্যে নিজেদের জীবনের অক্সিজেন রিফিল করে নিচ্ছেন।

শিবরাম বাবু জড়িয়ে ধরে বলে চলেছেন--ফার্স্টক্লাস। কতদিন-কতদিন ভেবেছি একবার দেখা করবই। দেখা কি হবে না কোনোদিন !

ভানুবাবু বলে চলেছেন--এতোদিনে মনের-প্রাণের সাধ মিটল। ইচ্ছেটা পূর্ণ হল।

সময় যেন থমকে গেছে, রসরাজ-যুগল একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে মজে আছেন আপন খেয়ালে। একটু পরেই সবাইকে বসতে বললেন শিবরাম বাবু। ভানু বাবুর সাথে ওনার কথাবার্তা চলতে থাকে। ওদিকে একটা কলাই-এর থালায় ভাত, কিছু তরকারি আর বাটি থেকে গড়িয়ে পড়া ছোট্ট পোনা মাছের ঝোল দিয়ে গেলেন মেসের কর্মচারী। শিবরাম বাবুর ওদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ভানু বাবু বুঝতে পারলেন যে এখন শিবরাম বাবুর খাবার সময়, তিনি চলে যাবার জন্য অনুমতি চাইলেন। শিবরাম বাবু বললেন, যাবে ? বেশ। আবার এসো কিন্তু।

তাঁরা উঠে পড়েছেন, এমন সময় ইশারায় ভানু বাবু তাঁর সঙ্গীকে সন্দেশের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সন্দেশ হাজির হল শিবরাম বাবুর সামনে। চোখ জ্বলে ওঠে তাঁর, সন্দেশ এনেছ? বাঃ ফার্স্টক্লাস !

বলতে বলতেই দুটো বড় বড় জলভরা সন্দেশ তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলেন তিনি। ভাত পড়ে রইল। ভানুবাবু একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে তাঁর সঙ্গীর কানে কানে চাপা গলায় বললেন, খাইসে, ডায়াবিটিস্‌ আছে নাকি! ভাতের সঙ্গেই খাবে নাকি? বয়স হয়েছে, এতোটা ...

শিশু ভোলানাথের কান সজাগ--কিছু কি বললে?

ভানু বাবু কথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন--এই না, বলছি, আর একটু আগে আসলেই ভাল হতো আর কি। আপনি খেয়ে নিন, আমরা আসি তবে।

শিবরাম বাবুর এক হাতে সন্দেশ। হঠাৎ ভানু বাবুর এক সঙ্গীর সাদা জামায় সবুজ-কালোর কলকা করা হাতা ধরে তিনি বলতে লাগলেন--বাঃ ভারী সুন্দর জামা পরেছ তো!

আরও একবার জামাটায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেশ বেশ। ভাল লেগেছে তোমায়, আবার এসো।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভানু বাবু তাঁর সঙ্গীদের বললেন, ছিটটা খুব পছন্দ হয়েছে ওনার। আবার যখন আসব তখন এইরকম একটা ছিট - না, পাওয়া হয়ত যাবে না। তবে এই ধরণের কলকা করা বেড কভার নিয়ে আসব।

সিঁড়ি থেকে নেমে এসে সবাই নিশ্চুপ। গাড়ীতে উঠে দরজা বন্ধ করে ভানুবাবু নিস্তব্ধতা ভাঙলেন--সবই ঠিক হল, একটুখানি মিসটেক...

সত্যিই একটা মিসটেক হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তাঁরা ক্যামেরাটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন। নিয়ে গেলে এমন দুই রসরাজের একত্রে ছবিটা বাঙালি সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকত। বিশেষ করে আজকের এই যন্ত্রণাময় যান্ত্রিক জীবনে এই ছবি হয়ত ক্ষণিকের জন্য সব ভুলিয়ে নিয়ে যেত সেই সময়ে যখন বাঙালি হাসত এবং হাসাত। সেই ছবির ক্যাপশন হয়ত হতেই পারত--'শিবরাম বাবু, রাবড়িচূর্ণ খামু!'


২৬.
ছোটদের জন্য লিখতেন, নিজের মনটাও ছিল একেবারে শিশুর মতো। নিজের খেয়াল খুশির রাজা।

খুদে পাঠকরাই ছিল তাঁর বন্ধু। বেজায় ভালবাসতেন ছোটদের। জীবনে কোনও দিন কারও নিন্দা করেননি, শুনতেও চাইতেন না।

কেউ যদি কখনও এসে বলতেন, শিবরামদা আপনার নামে অমুকে খারাপ কথা বলে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে শিবরামের উত্তর, ‘হতেই পারে না। আপনিই ভুল শুনেছেন।' বলেই তার হাত ধরে নিয়ে যেতেন খাওয়াতে। নিজেকে সাহিত্যিক পরিচয় দিতেও সংকোচ। বলতেন, ‘ধুর ধুর আমি আবার সাহিত্যিক হলাম কবে? প্রেমেন, অচিন্ত্য, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভুষণ এরা হলেন সাহিত্যিক। কত ভাল ভাল লেখেন! তাদের পাশে আমি!’

নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘সার্কাসের ক্লাউন যেমন। সব খেলাই সে পারে, কিন্তু পারতে গিয়ে কোথায় যে কী হয়ে যায় খেলাটা হাসিল হয় না। হাসির হয়ে ওঠে। আর হাসির হলেই তার খেলা হাসিল হয়।'

 

২৭.
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজার-এ চাকরি করেন। একদিন বেলার দিকে এক সাহিত্যিক এসে খবর দিলেন শিবরামবাবুকে দেখলাম, অফিসের কাছেই ফুটপাথে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। মনে হয় শরীরটরির...!

সর্বনাশ! সে কী কথা!

সুনীল সদলবলে ছুটলেন। গিয়ে দেখেন, সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে শিবরাম টানটান শুয়ে রয়েছেন ফুটপাতে।

'কী হল? শরীর খারাপ লাগছে?'

'না না, ফার্স্টক্লাস আছি। আসলে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল ফুটপাতে শুয়ে আকাশটাকে কেমন দেখতে লাগে একবার দেখাই যাক।'


২৮.
শরীরটা কিন্তু সত্যিই ঠিক যাচ্ছিল না। স্মৃতি কমে আসছিল। কথাবার্তা অসংলগ্ন। শেষ জীবনে প্রায় কপর্দকহীন।

প্রায়ই বলতেন, ‘জিনিসপত্র সব বাঁধা হয়ে গেছে এবার একটা ট্যাক্সি পেলেই চলে যাব।'

 

২৯.
এমনকী শেষদিকে সেই সময়ের রাজ্য সরকার এবং কয়েকটি সংস্থা মিলে তাঁর চিকিৎসা ও ভরণপোষণের জন্য যে মাসিক ছ'শো টাকা তারই এক পাড়াতুতো পরিচিতের কাছে পাঠাত, সেই টাকারও সঠিক ব্যবহার হত না।

শুকনো-রিক্ত চেহারা। অথচ কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর, ‘খাসা আছি। ফাইন আছি।'

কোনও দিন কোনও অভিযোগ নেই কারও কাছে।

তারমধ্যে আবার একদিন ঘরে চোর ঢুকে শেষ পাঞ্জাবিটাও নিয়ে গেছিল, গেঞ্জি পরেই থাকতেন।

মুখে বলতেন, ‘দরকার কী? এই তো দিব্বি চলে যাচ্ছে গেঞ্জিতে।'

হঠাৎ কয়েক দিনের প্রবল জ্বর। দুর্বল শরীরে টলতে টলতে বাথরুমে ঢুকেই সংজ্ঞা হারালেন।

সারারাত পড়ে রইলেন ওখানেই। পরদিন বেলায় খবর জানাজানি হতে ভর্তি করা হল হাসপাতালে।

১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট সকাল। হাসপাতালের বেডে আচ্ছন্ন 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'র নায়ক।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শিবরামবাবু, এখন কেমন লাগছে শরীর?’

'ফার্স্টক্লাস।' জড়ানো গলায় তখনও একই উত্তর।

তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই সেই অপেক্ষার অচেনা ট্যাক্সিতে চেপে বসলেন শিবরাম।

রেডিয়োতে সন্ধেবেলায় যখন সেই খবর ঘোষণা হচ্ছে, তখন হয়তো হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধনের সঙ্গে চাঁদে জমি কেনা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত তাঁদের স্রষ্টা!

 

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, Shibram Chakroborty - শিব্রাম চকরবরতি ফেসবুক পেজ, ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা, ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর, শিরোনাম শিবরাম-কোরক, যষ্টিমধু-শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা, গল্পমেলা-শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা।

২০৩৯৫ পঠিত ... ১৬:৫৭, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top