৫ আগস্টের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণ-তরুণীদের প্রতি বয়েসীদের সীমাহীন ক্রোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ব্যাপারটাকে অডিপাল কনফ্লিক্ট বলা হয়। গ্রিক ট্র্যাজেডি ইডিপাস কমপ্লেক্স থেকে এই জারগনটি এসেছে। গোষ্ঠীপিতারা প্রবীণ হিসেবে গোত্রের সমস্ত নারীকে সম্ভোগের অধিকার উপভোগ করত। সেইখানে কোনো তরুণকে কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্কে উপনীত হতে দেখলে; প্রবীণেরা তাদের হত্যা করত। বাংলা উপন্যাস ‘আবদুল্লাহ’-তে ‘এক ঘরমে দো পীর যাও বাছা শো রাহো’ বলে যেভাবে প্রবীণ পীর মৃত্যু শয়ানে পাঠান নবীনকে যে পীরত্ব প্রাপ্তির যোগ্য ছিল। এত সব রেফারেন্সে না গিয়ে একে সোজাসুজি জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্ম ব্যবধানও বলা যায়।
আমাদের সমাজে দেখবেন পুরুষেরা সহজে বুড়ো হতে চায় না, এইজন্য চুলে কলপের ব্যবহার সর্বোচ্চ। একই লোক দীর্ঘদিন তরুণ কবি ও লেখক সেজে থাকে। তরুণ সেজে ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হয়। চুলে কলপ করে তরুণ এমপি ও মন্ত্রী সাজে। ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশ এরকম কলপ-তারুণ্যের প্রাচীন চিন্তার অচলায়তনে বন্দী ছিল। এ কারণে আধুনিক চিন্তা তারুণ্যের সৃজনশীলতা কোনোভাবেই বিকশিত হতে পারেনি। বৃদ্ধ শিক্ষক চুলে কলপ করে কন্যার বয়েসী ছাত্রীকে প্রেম নিবেদন করেছে, বৃদ্ধ সংস্কৃতি মামা বুকের বোতাম খুলে তাতে পাওডর মেখে গানের ও আবৃত্তির ছাত্রীর দিকে পেলব করে তাকিয়েছে। বৃদ্ধ মোল্লা ও পুরোহিত আল্লাহ-ভগবানের ভয় দেখিয়ে বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা জোগাড় করেছে।
আমাদের সমাজ একটি বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ টাইপের ক্যানভাস। এখানে অধুনা জিম করে পেশী ফুলিয়ে প্রাক বৃদ্ধ সাজে তরুণ বিপ্লবী। এই বৃদ্ধ শরীরে তরুণ মুখোশে থাকে সবজান্তার দাবি; নিজেই সব বোঝে; আর কেউ কিছুই বোঝে না টাইপের ভাবভঙ্গী। আওয়ামীলীগের সিপি গ্যাং-ই হোক কিংবা বিপ্লবী ইউটিউমার গ্যাং-ই হোক; এদের ভাষারীতিতে প্রাচীন খিস্তি। আদিম গান্ধা কইরা দেওয়ার স্যাঁতসেতে কথন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশের শনি গ্রহ শেখ হাসিনাকে সরাতে পারার মূল কারণ; তারা ঐ তরুণের ছদ্মবেশী প্রাক বৃদ্ধদের কোনো বুদ্ধি পরামর্শ নেয়নি। সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তার শক্তিতে ছাত্র-শ্রমিক ঐক্য তৈরি করেছে। তাই তো বৃদ্ধ চিন্তাগুলোকে চমকে দিয়ে অভাবনীয় এক সাফল্য এনেছে জেনজি বিপ্লবের মাধ্যমে।
লক্ষ্য করুন; বিপ্লবের পরেই ইউটিউমাররা ফোনে তরুণ নেতাদের সঙে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রাচীন চিন্তার কাসুন্দির বিষ ঢেলে দিয়েছে তাদের কানে। তরুণ বিপ্লবীদের কারও কারও আচরণে মাঝে মাঝে যে শামীম ওসমানের ছায়া দেখা গেছে; এ আর কিছুই নয়; অচল প্রাকবৃদ্ধদের কুপরামর্শে সেই বিংশ শতকের স্যাঁতসেতে চোখ পাকিয়ে গরম দেখানোর কুসংস্কৃতি।
৫ আগস্ট রাত থেকেই ‘সাজানো গোছানো দেশটাকে শেষ করে দিল’ যে চাকরস্য চাকর দলান্ধ আর্তচিৎকার, পান থেকে চুন খসলেই গেল গেল রব; এ আর কিছুই নয়; পুরোনো ধান্দাবাজির রাজনীতির অবসানে রুলিং অ্যালিটের অলংকার হারানোর কান্না।
বিংশ শতকের প্রাচীন চিন্তা হচ্ছে ভিআইপি কালচার। মনে করে দেখুন, এরা বিভিন্ন সময়ে গণভবন, বঙ্গভবন, মেরিল-প্রথম আলো, কর্পোরেট শো'র ভিআইপি লেখা আমন্ত্রণপত্র ফেসবুকে আপলোড করত। সভ্য সমাজের মানুষের মতো সবার মাঝে অন্যতম হয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা এদের নেই। তাই তো কথায় কথায় প্রথম, শ্রেষ্ঠ, বৃহত্তম, অনন্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপরাজেয় এসব বিশেষণের ব্যবহার কেবল দেখা যায় এ সমাজেই। হীনমন্যতা থেকে উত্থিত সুপিরিয়রিটির বোধ, খেলনা রেসিজম; এসব পুঁতিগন্ধময় চিন্তার পাতকুয়াতলার এই যে মাতম, আগেই ভালো ছিলাম, এই সরকার পারতেছে না, সংস্কৃতি বাঁচাও; এইসব বৃদ্ধমনের ছদ্ম তরুণ কোলাহল হচ্ছে আমাজনের ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজের সেই খলবৃদ্ধার অভিনয়; যে নিজের বাড়ি থাকার পরেও সরকারি বাড়ি নেবার জন্য কান্না ও অসুস্থতার অভিনয় করে।
৫৩ বছর যারা জমিদার সেজে ঘুরেছে অকারণে, সুবিধাবাদের জঠরে পাওয়া সম্পদের গৌরব দেখিয়েছে, স্যুডো ইন্টেলেকচুয়ালিটিকে বিরাট করে সম্প্রচার করেছে ডোয়ার্ফ মিডিয়ার আলোয়, গাড়ি-বাড়ি-নারী-ভুঁড়ি দেখিয়ে সাফল্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, সরকারি পদ-পদবী-প্লট-পদক দেখিয়ে ‘সফল যারা কেমন তারার’ ফিচার আইটেম হয়েছে; জেনজি বিপ্লব সেই সাজানো গোছানো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তছনছ করে দিয়েছে। তবু সেইসব সরকারি কোলাবরেটরের মুখে এত বড় গলা কেউ কখনও কোথাও দেখেনি।
পারলে এরা জল দিয়ে জ্যান্ত গিলে খায় ঐ তরুণ-তরুণীদের যারা বাংলাদেশের এই ম্যাড়মেড়ে দুর্নীতি ঝাঁঝরা ওয়ে অফ দ্য ওয়ার্ল্ডকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ধর্ম ব্যবসা, রাজনীতি ব্যবসা, সংস্কৃতি ব্যবসা, দেশপ্রেম ও চেতনা ব্যবসা আর অনুভূতির যাত্রাপালাগুলোকে যারা নাকচ করে দিয়েছে; সেই জেনজি-রা এখন ঐ অচলায়তনের শত্রু।
শেখ হাসিনা ছিল এদের স্টেটাসকো; নানা রঙ্গে ও ঢঙ্গে কখনও, উনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে, কখনও শেখের বেটিই পারবে ইত্যাদি নানারকম আশারছলনে ভুলিয়ে ভারতের ওমকে স্বর্গের ওম বোধ করে যে রাষ্ট্র নামের প্রহসন রচনা করেছিল এরা; সেই সুখের সংসার জুলাই বিপ্লবের দমকা হাওয়ায় উড়ে যাওয়ায়; এরা অন্ধ দৈত্যের মতো কিংবা লাইক্যানথ্রোপিক শৃগালের মতো কাঁদে। বিংশ শতকের বাধা বুলিতে সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে তরুণদের বিপক্ষে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
তরুণদের অনুরোধে যে প্রবীণেরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কাজ করছেন; তাদের ওপর জাতক্রোধে অন্ধ অক্ষম লোমওঠা নেকড়েরা মুখে যা আসছে তা বলছে তাদের। এটাই আওয়ামীলীগ রাজনীতির ডক্ট্রিন। যদি গুলি দিয়া না হয়; গালি দিয়ে ভারত সমর্থিত উপনিবেশ ধরে রাখতে মরিয়া তারা। মাজার ভাঙা কার্ড, সংখ্যালঘুর ভিকটিম কার্ড, জাসদ থেকে জামায়াতে ঢুকে পড়ে নিয়মিত লীগের মনপছন্দ ইস্যু পাবলিক স্ফেয়ারে নিয়ে আসার যে হরদম খেলা; এই সব রসুনের গোড়া প্রাচীন পন্থার বলগেম ফিরিয়ে আনার ছেনালী।
বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে ক্ষমতায় যেতে অপেক্ষমান। কিন্তু নির্বাচনে একটা আসনও পাবে না; এমন দলের নেতারাও যখন নির্বাচন নির্বাচন রব তোলে; এ আর কিছুই না; প্রাচীন ধারার রাজনীতির মাঠ ফেরত পাবার তাড়া। বিএনপি ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলেও তাকে এটা-ওটা-সেটা তকমা দিয়ে ক্ষমতার গাছ থেকে পেড়ে কী করে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে হয়; তা জানে এই বৃদ্ধ ও প্রাক বৃদ্ধ লীগের লেটুর দল, সংস্কৃতিমামা, বুদ্ধিজীবী ও গালাগালি গ্যাং। কিন্তু খুবই অপরিচিত জেনজিদের চিন্তা। তারা যদি নতুন শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়; তাহলে বিএনপি ও নতুন শক্তি দ্বিদলীয় রেসের বাইরে চলে যাবে চিরস্থায়ী জমিদারীর দল আওয়ামীলীগ।
এই বাংলাদেশকে তরুণীর মতো সম্ভোগ করার অধিকার কেবল গোষ্ঠী পিতা আওয়ামীলীগের। তাই তো সে অডিপাল কনফ্লিক্টের বিষে তরুণদের জর্জরিত করতে লোলুপ। সে ঐ অন্তর্জলী যাত্রার বৃদ্ধ। মৃত ভেবে শ্মশানে নিয়ে যাবার পরেও হঠাৎ চোখ মেলে যে তরুণীকে বিবাহের শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে। তারপর আয়নায় নিজের জাঢ্য জরদগব কংকালের মতো চেহারা দেখিয়ে তরুণীকে জিজ্ঞেস করে, আমি কী সুন্দর!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন