'তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে?'

৩২৬ পঠিত ... ১৯:১৯, জুলাই ১৭, ২০২৪

34

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহিদ আবু সাঈদের মা সন্তান হারানোর বেদনায় এই প্রশ্নটি রেখেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আবু সাঈদের বাবা প্রশ্ন করেছেন, টিউশনি করে টাকা না পাঠালে তিনি চাল কিনবেন কী করে! তার বোন বর্ণনা করেছেন, ছাত্রজীবনে প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছিল সাঈদ। দারিদ্র্যে বিশীর্ণ পরিবারের জীবনে ভাতের স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছিল সাঈদ।

এই রকম খরখরে জীবন বাস্তবতায় বসবাস করেও সাঈদ ঊনসত্তুরে শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার সাহসকে বুকে ধারণ করেছিল। ইতিহাসের দুটি বাঁকে ক্ষমতা-রাক্ষসের গুলিতে প্রাণ দিলেন দুজন মেধাবী মানুষ। যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবসার পসরা সাজিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার গত পনেরো বছরে বৈষম্যে ধূসর করেছে বাংলাদেশ; সেইখানে এই খুনে ক্ষমতা কাঠামো ঠিক কোনদিক দিয়ে একাত্তরের পাকিস্তানের খুনে ক্ষমতা-কাঠামো থেকে আলাদা রইল!

ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া পাকিস্তানের খুনে সেনার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে লেলিয়ে দেওয়া খুনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের পার্থক্য রইল কোথায়! ১৬ জুলাইয়ে শহীদ হওয়া ৬ জন তরুণের লাশ কোলে নিয়ে বাংলাদেশ মা বসে। অথচ বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই স্বৈরাচারী সরকারের। তারা রয়েছে ছলে বলে কৌশলে মসনদ বাঁচানোর মারণখেলায়। ঠিক কতটা রক্তের নেশা এদের; আর কত রক্ত হলে তৃষ্ণা মিটবে এই ভ্যাম্পায়ার ক্ষমতা রাক্ষসের।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিটি অঙ্গীকার, গণতন্ত্র, বৈষম্যমুক্ত সমাজ, সামাজিক সুবিচারকে পায়ে দলে গত পনেরো বছরের যে দেশ-ডাকাতি, দলীয় কোলাবরেটরদের ছাপড়ি থেকে রাজপ্রাসাদে তুলে আনা; ক্রসফায়ার, গুম, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে বাকস্বাধীনতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে; এসব গর্হিত অপরাধের ঠিক কোন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশুদ্ধতা অনুসরণ করা হয়েছে। রক্তপিপাসু শোষক নিপীড়ক দেশ লুন্ঠক কী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তলোয়ার বানিয়ে হত্যা করতে থাকে নিরীহ মানুষকে। এইভাবে পদে পদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা করেছে ক্ষমতা কাঠামো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্টের ট্র্যাজেডিতে প্রায় ৬০ লাখ শহীদের কথা বার বার মুখে বলে জায়নিস্টরা। যেভাবে ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ে প্যালেস্টাইনে নাগবা গণহত্যা চালু রেখেছে; আজও যেখানে নারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে; ঠিক একইভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ শহীদের কথা বার বার মুখে বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে এথনিক ক্লিনসিং চালু রেখেছে।

১৯৭১ সালে মাত্র ০.২৪ শতাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন; গোটা দেশের মানুষ তাদের সহযোদ্ধা ছিল। পাকিস্তানি খুনে সেনার নৃশংসতায় প্রাণ হারানো, শরণার্থী হওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতার মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল। ০.২০ শতাংশের কম লোক এই যুদ্ধে পাকিস্তানি খুনে সেনার সহযোগী হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক এদের মধ্যে যারা সক্রিয় মানবতাবিরোধী অপরাধী ছিল, খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-অগ্নি সংযোগে নিয়োজিত ছিল; তাদের বিচারের সম্মুখীন করেন। কেবল রাজনৈতিক আদর্শের কারণে যারা পাকিস্তান সমর্থন করেছিল, তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ায় মন দেন তিনি। ২০১৩ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের মাধ্যমে রাজাকার ইস্যুটির নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল।

দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল বর্তমান সময়ের মানবতা বিরোধী অপরাধী যারা, সেইসব দুর্নীতিবাজ-লুণ্ঠক-দখলবাজ-খুনিদের বিচারের দিকে মনোযোগ দেবে সরকার।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ও বিপক্ষ শক্তি দুইভাগে ভাগ করে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীতে মনোযোগ দেয়। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগের কোলাবরেটর হয়ে ভাগ্য পরিবর্তনে উদ্যত লোকেরা; সরকারের যে কোনো সমালোচনা করলেই সাধারণ মানুষকে রাজাকার তকমা দিতে শুরু করে। চোরাজকতার নৈরাজ্য ঢাকতে এ হচ্ছে বর্তমানকালের চোরাজাকারদের আধিপত্য স্থাপনের কৌশল। ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নিরংকুশ সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ইসলামোফোবিয়া প্রদর্শন শুরু করে। দাড়ি-টুপি দেখলেই রাজাকার বলে তকমা দেওয়া শুরু হয়। কারও নাম আরবি-ফার্সি হলেই তাকে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ধমক দেওয়া শুরু হয়। আবার ইসলামপন্থী হেফাজতকে কোলে নিয়ে নাস্তিক কতল করা ওয়াজিব ফতোয়া দেওয়া মোল্লা শাফির সঙ্গে শোকরানা মাহফিল করেন সরকার প্রধান। হিন্দুত্ববাদ ও ইসলামপন্থার কট্টর নেশাজল পান করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪-এর তিনটি ভোটহীন নির্বাচন করে স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডে স্বৈরাচারি সেনাশাসক এরশাদকেও পেছনে ফেলে দেয়।

আওয়ামী লীগ ও এর কোলাবরেটরেরা কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে আজকের কোটা সংস্কার আন্দোলনে; বার বার ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে অল্পবয়েসী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে পেডোফিলিক মনোবিকৃতি প্রকাশ করে চলেছে।

বুড়ো ভামেরা দেশ ডাকাতি ও সম্পদ পাচার করে দেশের অর্থনীতি রুগ্ন করেছে; বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বড় অপরাধগুলো করে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় গলা করে হাঁটুর বয়সী বাচ্চা-কাচ্চাদের রাজাকার তকমা দিতে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ছাত্রলীগের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা বিসিএস পরীক্ষা দাও, আমরা দেখব। আওয়ামী লীগ সদস্য দেলোয়ারকে আমরা দেখেছি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হতে। এই কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান সাদেক এবার ডামি ভোটে আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছেন। আর সম্প্রতি আপনারা টিভি প্রতিবেদনে দেখেছেন কীভাবে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রশ্ন ফাঁস করে সরকারি চাকরি দেওয়া হচ্ছে। জার্মানির নাতসিদের মতো সরকারি চাকরিতে আওয়ামী রক্ত নিয়োগের বিকৃত প্রবণতার কুরুক্ষেত্রে বসে, কোন লজ্জায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীদের ঢালাওভাবে রাজাকারের নাতিপুতির তকমা দেন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ। ঢালাওভাবে রাজাকারের নাতিপুতি তকমায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা স্লোগান দেয়, তুমি কে আমি কে রাজাকার, কে বলেছে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার। চাইতে এলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।

এই স্লোগানে ছাত্র-ছাত্রীদের গভীর অভিমান, বেদনা, উপায়হীনতা অনুভব না করে ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হুকুম দেন, আন্দোলনকারীরা যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, ছাত্রলীগ যেন তার যোগ্য জবাব দেয়।

শুরু হয় অপারেশান হার্শলাইট;  ক্ষমতা রাক্ষসের লেলিয়ে দেওয়া খুনে নেকড়েরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর। ১৫ জুলাই তারা অসংখ্য আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীকে রক্তাক্ত করে। ১৬ জুলাই পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেকড়েদের যৌথ হামলায় সারা বাংলাদেশে ছয়জন শহীদ হয়।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতা রাক্ষসের নির্মমতা যেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্ষমতা রাক্ষসের নির্মমতার দেজাভুঁ।

৩২৬ পঠিত ... ১৯:১৯, জুলাই ১৭, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top