একজন উঠতি লেখক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি যে কথা শুনতে হয়েছে, বাহ, আপনার লেখায় হুমায়ূন আহমেদের বেশ গন্ধ আছে।
খেয়াল করে দেখেছি, একটু উইট বা হিউমার দিয়ে কোনো কিছু লিখলেই এই গন্ধমাদনের দল এসে হাজির হয়। বিশেষ করে ফেসবুকে।
সার্টিফিকেট দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে মন্তব্য করেন, বাহ, লেখাটার মধ্যে হুমায়ূন-হুমায়ূন গন্ধ পাচ্ছি।
আমার কি খুশি হওয়া উচিত? জানি না। তবে আমি বিরক্তই হই। মুখ ফুটে কিছু বলাও যায় না। পাছে এরা চটে গিয়ে প্রতিশোধ নেয়। বলে, বাহ, আপনার লেখায় কাশেম-কাশেম গন্ধ পাচ্ছি।
আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন আমার আরেক পাঠক। যিনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, ইদানীং বাঙালির ঘ্রাণশক্তি বড় বেড়ে গেছে দেখছি!
eআরকির পাতায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য আলোচনা নিয়ে eআরকি কোনোটাই করতে চাই না। তবে আজ এই সুযোগ অনেক দিন ধরে মনের ভেতরে পুষে রাখা কথাটি বলে ফেলতে চাই। বাংলা সাহিত্যে উইট বা হিউমার শুধু হুমায়ূন আহমেদ ব্যবহার করেননি। প্রথম বাংলা উপন্যাস আলালের ঘরে দুলালের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে উইট, বাবু কালচারকে বিদ্ধ করার তীক্ষ্ণ রসবোধ। শুধু বইটার ছোট্ট ভূমিকা খেয়াল করলেই সেই রসবোধের পরিচয় মিলবে। সেখানে বাঙালির বই পড়ার অনীহা নিয়ে তীর্যক মন্তব্যের শেষে বইয়ের দাম লেখা হয়েছে: ১২ আনা নগদ!
বাকিতে বই বিক্রি ঝুঁকি কে নিতে চায়। নগদ দামে কেনা বই পড়ুক আর না-পড়ুক, বাঙালি ফেলে দেবে না নিশ্চয়ই। বুকে বা বুক শেলফে না রাখুক, খাটের পায়ার তলে তো রাখবে!
বাঙালি পাঠকের একটা বোদ্ধা অংশের ঘ্রাণশক্তি আসলেই আকস্মিক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর।
আমরা হুমায়ূন বলয়ে বেড়ে উঠেছি। আমার নিজের সাহিত্যপাঠ হুমায়ূন দিয়েই শুরু। অন্যান্য বড় লেখকদের আবিষ্কার করেছি পরে। ফলে সাহিত্যে রসবোধের সঙ্গে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন হুমায়ূনই।
কিন্তু পরে রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে দেখেছি, রস সৃষ্টিতে ঠাকুর মশায়ের জুড়ি নেই। আরও পরে আবিষ্কার করেছি, শুধু বইয়ের শুকনো পাতা রসবোধে ভেজাননি; জীবনের মলাটের ভেতরে বরং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আরও রসিক। তাই বলে সেকালে রবীন্দ্রনাথকে কেউ এই কথা বলেছে কিনা জানি না—বাহ, আপনার মধ্যে বেশ হুমায়ূন-হুমায়ূন গন্ধ পাচ্ছি মশাই!
এই ধরনের সার্টিফিকেট বিতরণে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী সম্ভবত আঁতেল গোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এদের প্রাদুর্ভাব ছিল। এদের চাপে রবীন্দ্রনাথকেও সাহিত্য বাসর টাইপের আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হতো। সে সব অনুষ্ঠান চলার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ এক-দুইবার যে ঘুমিয়ে পড়েননি, তা জোর দিয়ে বলতে পারব না।
এমনই এক সাহিত্য আলোচনায় বাংলা সাহিত্যে লোকরঞ্জনবাদ ও সমকালীন স্যোশাল ডিসকোর্স নিয়ে গুরু-গম্ভীর আলোচনা চলছে; হুট করে রবীন্দ্রনাথ বলে বসলেন, এই সভাকক্ষে একটা বাঁদর আছে!
সে কী, কাকে নিয়ে এমন কথা বললেন রবি বাবু? সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। রবীন্দ্রনাথ আঙুল তুলে হল ঘরের বাঁ দিকের দরজার দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘ওই যে, বাঁ-দোর।’
এমন শব্দ নিয়ে খেলতে খুব ভালোবাসতে রবীন্দ্রনাথ। শুধু ‘পান’ নিয়ে মেতে থাকলে রবীন্দ্রনাথকে এই জায়গাতে শিবরামের আগে স্মরণ করতে হতো। রবীন্দ্রনাথের দুই নাতনী একবার তাঁর পা টিপে দিচ্ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলে বসলেন, ‘ওরে, তোরা পাণিপীড়ন, নাকি পা-নিপীড়ন কচ্চিস?’
শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে কজন অতিথি এলেন। রবীন্দ্রনাথ সৌজন্য করে তাঁদের চা করতে বললেন ভৃত্যকে। কিন্তু সেই চা আর আসে না। রবীন্দ্রনাথ অতিথিদের বললেন, ‘মাফ করবেন, ও বোধ হয় চা-কর নয়।’
ততক্ষণে আড্ডা বেশ জমে গেছে। রবীন্দ্রনাথ হারমোনিয়ামটা টেনে গান শুরু করেছেন, ‘হে মাধবী দ্বিধা কেন।’ ভৃত্যের অবশেষে মর্জি হলো। চা নিয়ে বৈঠকখানায় দরজায় পা দিয়েই তিনি দেখলেন, গান চলছে। এ সময় চা নিয়ে ঢোকা কি ঠিক হবে? রবি বাবু বিরক্ত হবেন না তো!
রবীন্দ্রনাথ তখনো গাইছেন, ‘হে মাধবী দ্বিধা কেন, হে মাধবী দ্বিধা কেন, হে মাধবী দ্বিইইধাআআআআ কেনওওওও।’ লাইনটা যে ভৃত্যের উদ্দেশে বুঝতে বাকি সবার কিছুটা সময় লেগেছিল।
রবীন্দ্রনাথের কথার মানে বুঝতে গিয়ে এমন ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রীও। শাস্ত্রী মশাই ছিলেন সংস্কৃতের পণ্ডিত, শান্তি নিকেতনে পড়াতেন। একদিন তাঁর কাছে গুরুদেবের চিরকুট এল, ‘শাস্ত্রী মশাই, এক্ষুনি আমার সঙ্গে দেখা করুন। আপনাকে আমি দণ্ড দেব।’ বিধুশেখর কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলেন। কী এমন অপরাধ করেছেন! ভয়ে ভয়ে হাজির হলেন রবীন্দ্রনাথের দপ্তরে।
গুরুদেবের টেবিলে সত্যি সত্যিই একটা লাঠি। মারবেন নাকি! বিধুশেখর আরেকটু খেয়াল করতে বুঝলেন, এ তাঁরই লাঠি, গতকাল ফেলে গিয়েছিলেন ভুল করে। কবিগুরু বললেন, ‘এই নিন, আপনার দণ্ড।’
তো আমরা আবার সাহিত্য আলোচনার আসরে ফিরে যাই, এসব জায়গাতেই রবীন্দ্র্রনাথের ভেতরে বাস করা বালকদিগের সর্দার ফটিক চরিত্রটা মাঝেমধ্যে বের হয়ে আসত। পারিপার্শ্বিক গুরুগম্ভীর আলোচনার মধ্যে তাঁর এক-আধটা ফোঁড়ন বৈঠকে এনে দিতো ভিন্ন মাত্রা।
এ ধরনের হাই থটের সাহিত্য আলোচনার আসরে রবীন্দ্রনাথের যে হাই উঠত, এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এও বুঝি, তাঁর সুনাম রক্ষারও তো একটা দায় ছিল।
একবার কী হলো, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভালো বক্তৃতা করে ফেললেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, বনফুল ছদ্মনামে যিনি অবিস্মরনীয় সব ছোটগল্পের জন্ম দিয়েছেন। সবাই বেশ তারিফ করছে, এমন সময় রবীন্দ্রনাথ ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘ও তো ভালো বলবেই। ও যে বলাই।’
এমনই আরেক সাহিত্য আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ বিরস বদনে প্রধান অতিথির চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। বিশেষ অতিথি শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় তখনো এসে পৌঁছাননি। তখন সদ্য প্রকাশিত হয়েছে শরতের নতুন উপন্যাস চরিত্রহীন। শরৎ একটু পর কাচুমাচু ভঙ্গিতে সভাকক্ষে ঢুকলেন। রবীন্দ্রনাথ বলে বসলেন, ‘ওই যে এসে গেছে, আমাদের চরিত্রহীন শরৎ।'
কত কত গল্প, লিখতে গেলে শেষই হবে না। একবার এক লোক রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু টাকা ধার নিল। রবীন্দ্রনাথ তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। টাকাটা দু হাতে নেওয়ার সময় বলল, আপনার এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।
অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ এই গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন, লোকটা কিন্তু কথা রেখেছে। এখনো ঋণীই রয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথের এই রসবোধ শেষ বয়সেও ফুরোয়নি। বরং তাঁর কেবল শেষ বয়সের রসবোধ নিয়ে আলাদা একটা লেখাই লেখা যায়। যেমন এই গল্পটা।
রবীন্দ্রনাথ পিঠের ব্যথার কারণে তখন উবু হয়ে, কিছুটা বেঁকে বসে লিখতেন। এক লোক তাঁর এমন লেখার ভঙ্গি দেখে বলল, আহা আপনার লিখতে বুঝি খুব কষ্ট হয় এখন! রবীন্দ্রনাথ বললেন, তা না। তবে বুঝলে না, কলসিতে পানি শেষের দিকে, তাই এমন বাঁকিয়ে রাখতে হচ্ছে।
নিজেকে নিয়ে এমন পরিহাস রবীন্দ্রনাথ করেছেন শেষ পর্যন্ত, যখন বুঝেছেন, জীবন বিচিত্র ছলনাজালে বাঁধা এক ধাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই সময়ের গল্প দিয়েই লেখাটা শেষ করি।
তখন তাঁর দেখাশোনার ভার মৈত্রেয়ী দেবীর। রোজ রোজ রবীন্দ্রনাথকে নিরামিষ খাওয়াতে হয়। ডাক্তারদের নির্দেশ। একবার বুদ্ধি করে মাথার মগজ ভুনা রান্না করে খাওয়ালেন। রবীন্দ্রনাথ আগে এই বস্তু চেখে দেখেননি। বললেন, হ্যাঁ রে, এটা কী খাওয়াচ্ছিস? মৈত্রেয়ী বললেন, মগজ। রবীন্দ্রনাথ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, এটারই সবচেয়ে কমতি ছিল। আগে থেকে যদি খাওয়াতি!
পুনশ্চ: হুমায়ূন রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন এক লেখক ছিলেন। তাঁর অনেক উপন্যাসের নাম রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নেওয়া। শুধু তা-ই নয়, হিমুর বিখ্যাত রসিকতাগুলোর একটিও হুমায়ূন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নিয়েছিলেন।
মরিস নামের এক সাহেব শান্তিনিকেতনে ইংরেজী ও ফরাসি ভাষা পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন এমন আলোচনার ফাঁকে মরিস সাহেব বললেন, ‘ভেবে দেখো, গুরুদেব সুগার নিয়েও গান লিখেছেন!' সবাই অবাক, এটা আবার কোন গান? মরিস সাহেব ভাঙা ভাঙা বাংলায় গেয়ে উঠলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী…।’
সবাই হেসে খুন। কে বলেছে আপনাকে এই কথা, এটা চিনি নিয়ে গান? বিভ্রান্ত মরিস বললেন, কেন গুরুদেব নিজেই!
পাঠকের মন্তব্য ( ১ )
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন