*দিন-১
করোনা নামক অণুজীবের আতঙ্কে আজ হইতে ঘরে একাকী সঙ্গনিরোধের সূচনা করিলাম। আজিকে বাহিরের আবহাওয়া বেশ সুন্দর। এমন দিনে ঘরে মন টেকানো বড্ড দায়। তবে নিজের ও দেশের স্বার্থে ঘরে অবস্থান নেওয়াটাই উত্তম সকলের জন্য। এজন্য আমি কবিতাও লিখিয়াছি, 'ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।'
কিন্তু খবর পাইলাম ঐ অভদ্র স্টাইলে কেশ কর্তন করা বখাটে কাজী নজরুলটা লোকজনকে বাহিরে বের করাইবার জন্য ফুসলাইয়া কবিতা লিখিতেছে, 'থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে।'
সরকার মহোদয়ের নিকট আমার আবেদন রহিবে সেনাবাহিনী প্রেরণ করিয়া লাঠিকাঘাতে নজরুলের পশ্চাৎদেশ রক্তিম করিয়া দিলে বাহিরে ঘোরাঘুরির স্বাদ মিটিয়া যাইতো।
তবে এতো কিছুর মাঝে আমাদিগের ডাক্তারগণ এখনো সুরক্ষা পোষাক বা পিপিই পাইতেছে না ইহা লইয়া কিঞ্চিৎ চিন্তার উদ্রেক হইতেছে।
*দিন-২
ফেসবুক নামের জিনিসটা আবিষ্কার না হইলে ঘরে মন টেকানো দায় হইতো। শ্রীমান মার্ক বাবুকে আমার অন্তর হইতে ধন্যবাদ। বালিকাদের সহিত খোশগল্প করিয়া বেশ সময় কাটিয়া যায়৷ কিন্তু আজ একটু ঝামেলা সৃষ্টি হইয়াছে। এক সুন্দরীকে বিস্মিত করিবার উদ্দেশ্যে লিখিয়াছিলাম, 'বুকভরা মধু, বঙ্গের বধু, জল লইয়া যায় কাখে।'
উক্ত বালিকা প্রতিউত্তরে বলিল, 'হুজুর মানুষ হয়েও মেয়েদের বুকের দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না।'
বলিয়া আমাকে বার্তা রুদ্ধ করিয়া দিলো। পরে দেখিলাম সে তাহার আইডিতে আমার স্ক্রিনশট অর্পণ করিয়া লিখিয়াছে, 'সবাই এই বুইড়া লুচ্চার প্রোফাইল রিপোর্ট মারেন। দাড়ি পেকে গেছে অথচ লুচ্চামি যায় নাই।'
প্রথমত আমি বলিতে চাই, দাড়ি থাকিবার মানেই ইহা নহে যে আমি হুজুর। আমি একজন শুদ্ধ ব্রাহ্ম। আর দ্বিতীয়ত আইডিতে অধিকমাত্রায় রিপোর্ট আসিতেছে, অনুগ্রহ করিয়া আপনারা সকলে আমার এই পোস্টখানাতে স্টিকার মন্তব্য করুন।
* দিন-৩
আজিকে নিউজফিড চ্যালেঞ্জে চ্যালেঞ্জে ভরিয়া গিয়াছে। বালকগণ সকলে লুঙ্গি পরা নওয়াজুদ্দিন আর বালিকাগণ শাড়িপরিহিতা আনুশকা শর্মা। মনের ভুলে এক বালিকার পোস্টে প্রতিক্রিয়া প্রদান করিয়া এক সাহসের খেলায় ফাসিয়া গিয়াছি।
'আমি গর্ভবতী' লিখিয়া পোস্ট করিতে বাধ্য হইলাম। শ্যামবাবু আমার মানসিক বৈকল্য ঘটিয়াছে ভাবিয়া দুপুরে ডাক্তার আনিয়া হাজির করিলো। ডাক্তার মশায় সব শুনিয়া আমার নাড়ি দেখিয়া বলিলেন, 'বিশ্রাম নিন আর বেশি করে টক খান। তিনমাস চলিতেছে। এই সময় বিশ্রাম খুব জরুরি।'
আমি বুঝিতেছি না আমার সাথে কি হইতেছে। মৃনালীনি সকাল হইতে নাঁকে নাঁকে কান্না করিতেছে। আমার বাচ্চাটির মা কে তাহা জানিতে চায়৷ আমি আর এ জীবন রাখিবো না।
এর মাঝে আরো খারাপ লাগিলো যখন দেখিলাম ব্যাংক ম্যানেজার, ম্যাজিস্ট্রেট, ভূমি কমিশনার, হুজুর, সকলেই পিপিই পরিয়া ঘুরিতেছে কিন্তু এখনো ডাক্তারগণ পিপিই পায়নি। এই লজ্জা আমি কই রাখিব!
*দিন-৪
শুনিলাম চাপাইনবাবগঞ্জের এক কামেল সাধুবাবা স্বপ্নে একখানা বিকাশ নাম্বার লাভ করিয়াছে। সেই নাম্বারে মাত্র কুড়ি টাকা বিকাশ করিয়া দিলেই করোনা হইতে মুক্তি পাওয়া যাইতেছে৷ সত্য মিথ্যা জানিনা তবে আমি বিকাশ করিয়াছি, আপনারাও করুন। নাম্বার জানিতে আমার ইনবক্সে আঘাত দিন।
* দিন- ৫
রায়হান নামের জনৈক লোমশ বক্ষের যুবক গভীর রাতে ভাইরাল হইয়াছে। তাহার নৃত্য বালিকাদিগের হৃদয়ে ঝড় তুলিয়াছে দেখিতে পাইলাম। ভাবিতেছি পরজন্ম বলিয়া যদি কিছু থাকে তবে কবিতা না লিখিয়া লাইভে আসিয়া চিকণী চামেলী গানে কোমর দুলাইবো। এজন্মে যাহা পায়নাই ঐজন্মে তাহা লাভ করিবো। বালিকারা আমারে লইয়া পোস্ট করিবে, 'রবীর বক্ষে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।'
* দিন- ৬
সকালে লুচি আর পাঠার মাংস খাইলাম। খাওয়াদাওয়া শেষ করিয়া তামাক টানিতে টানিতে একখানা কোরিয়ান সিনেমা দেখিয়া শেষ করিলাম। আহা কোয়ারেন্টাইনের জীবন বড় মধুর। অথচ কিছু লোক নাকি এখনো বাহির হইতেছে। এরা কখনো মানুষ হইলো না। অশিক্ষিত গোয়ারের দল।
বিকালে শুনিলাম নজরুল বাহিরে যাওয়াতে তাহাকে পুলিশ কান ধরাইয়া উঠবস করাইয়াছে। হাসিতে গিয়াও হাসিতে পারিলাম না। খুশি হইতে গিয়াও হইতে পারিলাম না। যখন শুনিলাম বেঁচারার বাসায় খাবার ছিল না। সে খাবারের সন্ধানেই বাহির হইয়াছিলো৷ এ এক বড় দুঃসময়। না খাইয়া মৃত্যু আর করোনার মৃত্যু হইতে যেকোনো একটা বাছিয়া লইতে হইতেছে।
*দিন-৭
আজ সকালে আমাদের কাজের মাসি পিপিই পরিয়া রান্না করিয়া দিয়া গেল। মালি পিপিই পরিয়া গাছে জল ঢালিতেছে। পাশের বাসার সুবলের দিদিমা দুপুরে পিপিই পরিয়া ঘুমাইতেছে দেখিলাম। আমাদের মিনি পিপিই পরিয়া বারান্দায় রান্নাবাটি খেলিতেছে। অথচ এখনো ডাক্তাররা পর্যাপ্ত পিপিইর অভাবে রোগী দেখিতে পারিতেছে না। অনেকেই নিজ অর্থে পিপিই ক্রয় করিয়া লইতেছে। সাধে কি আর আমি লিখিয়াছি, 'রেখেছো মন্ত্রী করে, মানুষ করোনি।'
*দিন-৮
বাদশা নামক জনৈক র্যাপারের 'গেন্দাফুল' শীর্ষক সঙ্গীত বাজারে আসিয়াছে। সকলে ইহা দেখিয়া আলোচনা করিতেছে বলিয়াই আমি দেখিতে গেলাম। প্রথমবার জ্যাকুলিন নাম্নী তরুনীর কোমরের নড়াচড়া ব্যাতিত কিছুই বুঝিলাম না। তাই আরো তিনবার দেখিলাম। বাদশার কথাগুলো বুঝিবার আশায় আরো ছয়বার দেখা লাগিলো। তারপর সন্ধ্যা হইতে জ্যাকুলিনের সফেদ কোমরের জন্য মনটা কেমন কেমন করিতে লাগিলে আরো কুড়িবার দেখিলাম। শেষরাতের দিকে নেশা ধরিয়া গেল। বাদশার বদলে আমি গেন্দাফুল গানটা লিখিলে কেমন হইতো তাহাই ভাবিলাম-
তব হন্টন লটক মটক,
তরুণ চিত্ত পটক পটক,
আজি শ্বাস বহে আটক আটক,
মোর শীরে বুঝি সাটক সাটক!
তব নিতম্ব হর্ষে দুলিছে,
প্রজাপতি তোমা কোমরে ঝুলিছে,
মাখনের লাগি দেহপল্লবী,
জলযোগে বুঝি মাখন গিলিছে।
এসো হেথা সখী মারো সেথা লাথি,
কাটিয়াছি তব চালান পাতি,
হাস্য খেলায় নাহি বসে মন,
তবুও তোমারে হারায়েছি সাথী।
বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল,
এমন মাথায় বেধে দেব লাল গেন্দাফুল।
* দিন-৯
আইইডিসিআর নামক সংস্থা বলিয়াছে আজ সারাদেশে একজনও করোনা রোগী সনাক্ত হয়নাই। ইহা দেখিয়া আমার আমির খানের 'তিন বেয়াদব' সিনেমাটির একটি বিখ্যাত সংলাপ মনে পড়িয়া গেল।
আইইডিসিআরের করোনা টেস্ট সম্পর্কে আজ নতুন কিছু জানলাম। দেশে করোনারোগী ধরা পড়লে খুব চিন্তা লাগে। মনে হয় কিছু একটা ঠিক হইতেছে না। পরন্তু দেশে কোনো রোগী না ধরা পড়লে আরও অধিক চিন্তা হয়। মনে হয় কিছুই ঠিক হচ্ছে না।'
ইতালির আইইডিসিয়ার হয়তো বলিতো- 'আজ ইতালিতে করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে মাত্র একজন। এই নিয়ে ইতালিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাড়ালো সাতষট্টি। তার মধ্যে একজন মৃত ও আঠারো জন সুস্থ হয়ে বাসায় চলে গেছে।'
.
ইতালির পত্রিকায় হয়তো ছাপা হয় এমন সব খবর- 'জ্বর কাশির লক্ষণ নিয়ে নিউমোনিয়ায় আজ সারা ইতালিতে মারা গেছে ৮৫০ জন।'
*দিন-১০
আজ জানিতে পারিলাম সোহাইল রহমান নামের এক সস্তা ফেসবুক সেলিব্রেটি আমার নামে করোনা ডায়েরি লিখিয়া ফেসবুকে পোস্ট করিয়াছে। আমাকে দিয়ে আজেবাজে কথা লিখাইয়াছে। এতোদিন জানিতাম কিছু অবৈধবালকের দল আমার নামে আজেবাজে বাণী লিখিয়া ফেসবুকে চালায়া দেয়। আর আজ ডায়েরি। এইসব বরাহশাবকের দলকে আমি পাইলে সারমেয় দ্বারা সঙ্গম করাইতাম। এরা আমাকে ফেসবুকে লুচ্চা আর গালিবাজ হিসাবে উপস্থাপন করে। এসব মস্তিষ্কহীনদের সহিত সম্পর্ক স্থাপনকারীদের কি বলিব বুঝিয়া উঠিতে পারি না। এইসব অর্ধাঙ্গিনীর ভ্রাতুষ্পুত্রদের (শালার পুত) লইয়া আমি একখানা কবিতা লিখিলাম বহুদিন বাদে-
.
"আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুই লিখিছিস বসি আমার নামে ডায়েরি,
দুচি তোরে...
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি খারাপ মেজাজে প্রভাত গালির
লেশমাত্র ভাগ-
পাঠাইলাম তোদের তরে, শখ জাগে দেই ভরে,
আজি হইতেছে বড় রাগ,
একজন বৃদ্ধের নামে গালি লিখিস,
বাপ দাদা নেই কি তোদের ঘরে?
আজি হতে শতবর্ষ পরে।"
*দিন-১১
নিউজফিড দেখিয়া লাগিতেছে দেশের কোথাও কোনো এক বাচ্চা জন্ম নিয়াই বলিয়াছে, 'যে সকল তরুণী গেন্দাফুল গানে টিকটকে নৃত্য করিবে তাহাদের করোনা হইবে না' বলিয়াই মরিয়া গিয়াছে।
আহা, দেখিতে বড় ভালো লাগিতেছে।
কোয়ারেন্টাইনে মাত্র এগারোদিন হইলো, অথচ মনে হইতেছে এগারো বছর কাটিলো। কবে যে সব ঠিক হইবে ঈশ্বর জানেন...
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন