আমি সারাদিন বাসায়-- এটাতে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না (যেহেতু প্রতিবছর চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গুতে ভুগে আমাকে ৭/৮ দিন গৃহবন্দী থাকতেই হয়)। কিন্তু আশেপাশের মানুষও যে বাসায় পড়ে আছে, এটা একটা সমস্যাই বটে। আগে শুধু ছুটির দিনগুলোতে আশেপাশের মানুষের চিল্লাচিল্লি ঝগড়াঝাটি শুনতে হইতো। এখন প্রতিদিনই শুনতে হচ্ছে। সকালে ঘুমই ভাঙে চিল্লাচিল্লিতে। কর্কষ গলায় বাবা-মা চিল্লায় ওঠে-
: বাবু (আসল নাম বলা যাচ্ছে না, তাই বাবু লিখতে হলো। প্রেমিক-প্রেমিকা সমাজের কাছে এ জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি। তবে আপনারা ছাড়াও বাপ-মা বাবু নামটা ব্যবহার করে, কথাটা ভুলে যাবেন না)! অ্যাই বাবু! কুত্তারবাচ্চা এখনও তোর ঘুম ভাঙে না? রাতভর ফোন গুতাস... কয়টা বাজে ঘড়িতে?
অদ্ভুত প্রশ্ন। যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে আছে, তার পক্ষে তো দেখা সম্ভব না যে কয়টা বাজে। আপনি জেগে আছেন, আপনি ঘড়ি দেখলেই তো হয়ে যায়। অযথা চিৎকার করে নিজের পুত্র তো বটেই, আশেপাশের সব পুত্রের ঘুম ভাঙানোর মানে কী? আর পুরা জাতি এখন হোম কোয়ারেন্টিনে আছে। কোনো স্কুল কলেজ খোলা নাই। এখন যদিও আপনার পুত্র ১২টা পর্যন্ত ঘুমানোর অধিকার না পায়, তাইলে আর কবে পাবে?
সকালে ওঠার পর তাদের মনে হয় এখন একটু গলা সাধা দরকার। তখন তারা চিৎকার দেয়, 'কাশেম ভাই! অ্যাই কাশেম ভাই! কাশেম!'
মনে হয় আমিও উইঠা ডাক দিই, 'ওই ব্যাটা কাশেম, কে তুই! ডাকতেসে শুনোস না হালা?' কিন্তু বলি না। বালিশের অংশবিশেষ দিয়ে কান চেপে শুয়ে থাকি। যাক, ডাক তাইলে থামসে। কিন্তু না। একটু পর আবারও সেই চিৎকার!
: কাশেম ভাই! অ্যাই কাশেম ভাই! কাশেম!
: জে!
: কই থাকেন? ডাকলে শোনেন না...কানে তুলা দিসেন নাকি?
: জে না।
: মটর ছাড়েন।
: কী ছাড়মু?
: মটর মটর!
: আইচ্ছা।
ভাইরে ভাই! একটা মটর ছাড়ার কথা বলতে আপনার বিল্ডিং কাঁপাইয়া ডাকা লাগে! ফোন দিলে কী হয়? আর ফোন না দিলেন, কাশেমরে বললেই তো হয় প্রতিদিন এই সময়ে মটর ছাড়বে!
আর মটরও তো না, আওয়াজ শুনে মনে হয় মশা মারার মেশিন! এ জন্য আপনার উচিৎ ইতালির বিখ্যাত পেডরোলো পাম্প ব্যবহার করা। মাটি কৃষি কাজেতে, পেডরোলো সাথী হে। পানি নিয়ে নিয়ে ভাবনা, আর না আর না।
তাছাড়া ইটালির অবস্থা এখন খারাপ, আপনি পেডরোলো পাম্প কিনলে যদি তাদের একটু উপকার হয়!
খেয়াল করে দেখলাম, প্রতিবেশি এক আঙ্কেল মোবাইলের চার্জার খুঁজে পান না। সকালবেলা আৎকা চিল্লায় ওঠেন, 'বাবুর আম্মা!! কই গেলা!' বাবুর আম্মা রান্নাঘর থেকে তিক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করেন, 'কী হইসে? তোমাদের যন্ত্রনায় কী কুমড়াটাও কাটতে পারবো না শান্তিমতো?' বাবুর আব্বা গলার ভলিউম আরও বাড়ান, 'আমার মোবাইলের চার্জারটা কই রাখসো?'
'তোমার চার্জার আমি কেন রাখব? তুমি কই না কই রাখসো, আমি জানি না।'
'আশ্চর্য কথা! বাসা থেকে একটা চার্জার কি উধাও হইয়া গেল নাকি? হ্যা? এটা কোন ধরনের কথা?'
'উধাও হইয়া যাবে কেন? ঘরেই আছে। খুঁইজা দেখো।'
'খুঁজতে হবে কেন? যেখানে রাখব, চার্জার সেখানে থাকতে হবে। আমার জিনিস ধরল কে? নিশ্চয়ই তোমার ছেলে হাত দিসে। নাইলে চার্জার তো এখানেই থাকার কথা।'
'ও কেন হাত দিবে? ওর কি চার্জার নাই? কথায় কথায় ওর উপরে দোষ চাপাও ক্যান?'
'দোষ চাপাবো না? বেলা বাজে ১২ টা। নবাবজাদা এখনও ঘুমায়। এই ওঠ! দরজা খোল! বাইর হ ঘর থেকে। লেখাপড়া নাই... ফাঁকিবাজ...'
বাবু তখন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে দরজা খুলে বলে, 'কী হইসে? সকাল সকাল চিল্লাও কেন?'
'চিল্লাবো না? তুমি বারোটা পর্যন্ত ঘুমাবা আর আমি তোমারে নিয়া নাচমু? আমার চার্জার নিসস ক্যান?'
'আমি কেন চার্জার নিমু? তোমার নষ্ট চার্জার নিয়া আমার লাভটা কী?'
'নষ্ট তো তুই করসোস! বাসার প্রত্যেকটা জিনিস নষ্ট করসোস তুই। তুই তো ছেলে না। দানব একটা! কিচ্ছু রাখা যায় না তোর জ্বালায়...'
'এই যে তোমার চার্জার' বাবুর আম্মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে। 'রাখো এক জায়গায়, খোঁজো আরেক জায়গায়... সকাল সকাল চিল্লাচিল্লি!'
'হ্যাঁ, আমি কথা বললেই তো চিল্লাচিল্লির মতো শোনায়। এখন তো আমি বাসায়। দেখি ছেলে সারাদিন কী করে... অ্যাই, বই নিয়ে বস। দেখি তোর পড়াশোনার কী অবস্থা!'
এ ছাড়া পিচ্চি পোলাপানের চিল্লাচিল্লি তো আছেই! এক পিচ্চি আছে, প্রতিদিন একদম অ্যালার্মের মতো ১০টার দিকে বিকট শব্দে কান্দে। মনে হয় উইঠা গিয়া দেই এক থাবড়া। কিন্তু থাবড়া দিলেই তো আবার কানবে। লাভ নাই। বালিশ কানে চাপা দিয়া চুপচাপ শুইয়া থাকি। এ ছাড়া আর কিছু করার নাই।
মনে বড়ো দু:খ ছোড চাচা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন