মুভি রিলিজ হওয়ার প্রথম দিনে দেখার একটা চাপ, অন্তত এই সোশ্যাল মিডিয়া যুগে, ফোমো (ফিয়ার অফ মিসিং আউট)’র যুগে- যে অনেকে জিগায়: কেমন লাগলো?
কেমন লাগালাগির প্রশ্ন এমনিতেই ডরাই। এত প্রচারণা, এতো হাইপ দেখে হলে গিয়া যে মুভি দেখলাম, দেশের সিনেমা পরিস্থিতি নিয়া তাতে ভালোই ডরাইছি। আরেক প্রস্থ ডরাইতেছি লিখতে গিয়া। খুব ইতিবাচক কথাবার্তা না বলতে পারলে, ‘দেশি পন্য, অতএব খারাপ বলা যাবে না’ মনোভাব একটা বড় অংশের মধ্যে এমনভাবে আছে যে দেশি সিনেমা নিয়া ‘নেগেটিভ’ কথা কইলেই উনারা উত্তেজিত হয়া পড়েন। অতএব ভয়ে ভয়ে লিখতেছি।
হলে ঢোকার পূর্বে যা যা সাথে নিবেন
মুভিতে প্রচুর স্ল্যাং-এর ব্যবহার আছে। আমি গালিপন্থী লোক, যেকোনো স্ল্যাংই ভাল্লাগে। চাটগাইয়া স্ল্যাং বেশ মিষ্টি মনে হইলো। ইন ফ্যাক্ট চাটগাইয়া ভাষাটাই ভাল্লাগলো। অনেকগুলা নতুন স্ল্যাং শিখলাম। মন্দ না।
আপনি মুভিটা দেখার সময় চাইলে তর্জমাকারী নিয়া যাইতে পারেন সাথে। অথবা চট্টগ্রামের ভাষার যেকোনো ডিকশনারি। মুভিটা দেখার পর নূর মোহম্মদ রফিক লিখিত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান অর্ডার করছি রকমারিতে। আপনি সিনেমা হলে যাওয়ার সময় ডিকশনারিটি নিয়া যাইতে পারেন। একেকটা ডায়লগ শুনবেন আর ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাইয়া শব্দটা চট করে দেখে নিলেন। আইডিয়াটা কেমন?
যদি মনে করেন আইডিয়াটা খারাপ, তাহলে জানবেন, মুভিতে কিন্তু কোনো সাবটাইটেল নাই। চাটগাইয়া না হইলে আপনার পক্ষে অনেক কথাই বোঝা সম্ভব হবে না। দৃশ্য, ভাব, অভিনয় ইত্যাদি দেইখা ৭০/৮০% না হয় বুঝলেন, ১০০% বুঝতে পারবেন না।
আমার জীবন থেকে নেয়া আরেক পিস সাজেশন দিতে পারি। খাবার দাবার নিয়া হলে ঢুকেন। অন্তত চুকা ক্যান্ডি/লজেন্স টাইপ জিনিস নিয়া হলে ঢুকতে ভুল কইরেন না। প্রেডিকটেবল কাহিনী দেখে আপনার ঘুম আসার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
কারণ বাকি দিকগুলা যা-ই হৌক, মুভির সবচেয়ে দুর্বল দিক এর গল্প। দুর্বল বললেও ঠিক হয় না, শব্দটা আসলে ক্লিশে।
কাহিনীর কিছু অংশ সংক্ষেপে বলি। ভয়ের কারণ নাই, এই মুভির স্পয়লার বলতে কিছু হয় না। কারণ ‘যন্ত্রণা’ গানটা আর ট্রেইলারে যা দেখছেন, আড়াই ঘন্টাজুড়ে সেইটারই এক্সটেন্ডেড ভার্শন দেখবেন মুভিতে।
অত্যন্ত রক্ষণশীল, গোড়া, গরিব পরিবারের মেয়ে আয়েশা। পরিবার তার সমুদ্রে গিয়া সার্ফিং করা এলাউ করে না। বড় ভাই, খুব কড়া শাসন করে, কথায় কথায় মারধোর করে। নায়ক আরও গরিব। আয়েশার ভাইয়ের সাথে নায়ক সোহেলের চিরশত্রুতা টাইপ সম্পর্ক। আয়েশা-সোহেলের সম্পর্ক কিছুটা স্পষ্ট হইলে, এবং আয়েশার সাগরে গিয়া সার্ফিং করাটা তাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে, এক পর্যায়ে আয়েশারে প্রচুর মারধোর কইরা গৃহবন্দী করে এবং তার চাইতে ‘তিন ডবল’ (একটা চরিত্রই বলে এই কথা) বয়সের একটা বয়স্ক লোকের সাথে তার বিয়া দেয়া হয়। টিপিক্যাল অত্যাচারী শ্বশুরবাড়ি পায় আয়েশা। তারা নানারকম নির্যাচন করে। বিয়ার কিছুদিন পর আয়েশারে দেখতে গিয়া তার দরিদ্র অসহায় বাবা বেয়াইনের দ্বারা অপমানের শিকার হয়া ফিরা আসে। ‘সাদা রঙের ঘন তরলপদার্থ কাচের বোতলে’ নিয়া মাতলামি করতে দেখা যায় সোহেলের বাপরে। আরও গাদা গাদা ক্লিশের উল্লেখ করা যায় গল্পে, সংলাপে। আমার আরেকটা ধারণা হইতেছে, মুভিটা চাটগাইয়া ভাষায় হওয়ায় ডায়লগ যতটা ক্লিশে, ততটা ক্লিশে মনে হয় নাই।
একটা সময় বলা যাইতো, বাজেট নাই, এনাফ টেকনিক্যাল সাপোর্ট পান না পরিচালক। এখন এইসব বলার দিন সুযোগ নাই। এখন দেশের অডিয়েন্সও আসলে গ্লোবাল অডিয়েন্স। তারা নেটফ্লিক্স দেখতে পারে, আমাজন প্রাইম দেখতে পারে। খুব ভালো কিছু না হোক, এভারেজ জিনিসও যদি তারা না পায়, পকেটের টাকা দিয়া তারা সিনেমা হলে কেন যাবে এইসব ক্লিশের ডিব্বা দেখতে?
বাংলাদেশের দর্শক তো অনেক ভালো, ছবি দেখতে গিয়া একটু বেশিই সহানুভুতি দেখায় তারা। মানে দোষত্রুটি কমই ধরে। এভারেজ মুভি হইলেও পাবলিক আগ্রহ নিয়া দেখার চেষ্টা করে, ইতিবাচক হৈচৈ করে। অনেকে ‘দেশি পন্য দেখে হন ধন্য’ টাইপ আবেগ নিয়াও দেখতে যায়। এবং গিয়া হতাশ হয়। অনেকে দেখি মুভি অনলাইনে প্রচারণায় দেশি মুভি হলে গিয়া দেখে সিনেমা শিল্পকে বাঁচাও-টাইপ কথাবার্তা বলেন।
কেন ভাই?
পকেটের টাকা দিয়া শিল্প বাচানোর দায় কেন পাবলিক নিবে? মাছের ইন্ডাস্ট্রি বাঁচায় রাখার জন্য কি বাজারে গিয়া পচা মাছ কিনবেন আপনি? সবসময় তো দেশি জিনিস না কিনে বিদেশি জিনিসই কেনেন, কারণ সেটা থেকে আপনি ভালো সার্ভিস পান। সিনেমার ক্ষেত্রে আলাদা নিয়ম কেন? সিনেমা, মিউজিক, শিল্পসাহিত্য এইগুলাও প্রডাক্টই। এস্থেটিক প্রডাক্ট। আপনারে দুনিয়ার সাথে পাল্লা দিয়া ভালো জিনিস বানাইতে হবে। না পারলে নাই। দেশের নানান সীমাবদ্ধতার কথা না বলা ভালো। পাবলিক আপনার সমস্যা দেখবে না, আউটপুট দেখবে। এইটা কঠিন শুনাইলেও সত্যি।
দেশের ক্রিকেটের যে অবস্থা, টি-টুয়েন্টি, ওডিআই বা টেস্টে– ব্যাপক মিডিয়া হাইপ, প্যাশনেট দর্শক, প্রচুর টাকা অথচ তাদের পারফর্মেন্স জঘন্য, সিনেমার ক্ষেত্রেও একইরকম। শর্টার ভার্সনে, একটা দুইটা ম্যাচ মাঝেমধ্যে ভালো খেলে র্যান্ডমলি। কিন্তু লংগার ভার্সন ক্রিকেট তাদের অবস্থা যা তা। সিনেমাতেও এখন একটু আকটু ট্রেইলার বানানো শিখতেছে মনে হয়। লংগার ভার্শন শিখে উঠতে পারে নাই।
পুরা মুভি আসলে জাস্ট ৪৫ মিনিটের। মোটামুটি সবাই প্রেডিক্ট করতে পারবে যে কী হইতে যাইতেছে। হুদাই টাইনা আড়াই ঘন্টা লম্বা করা হইছে। আমরা ইনসমনিয়া ভালো হয়া যাইতে পারে- এই একটা কারণেই হলে যাইতে পারি এই টাইপ মুভি দেখতে।
তাইলে এই মুভি দেখার কী কী কারণ থাকতে পারে?
হলে গিয়া দেখার মতো আমি তেমন কোনো কারণ খুজে পাই নাই । চাটগাইয়া ভাষার মতোই চাটগাইয়া ভাষার স্ল্যাংও সুন্দর। আঞ্চলিক ভাষার এক্সপ্রেশনের ফ্লেক্সিবিলিটি, বৈচিত্র্য, ও বহুবর্ণিল মাধুর্য থাকে, আলাদা সৌন্দর্য থাকে। মুভির কিছু কিছু ডায়লগে তার ছাপ আছে। সুনেরাহ, রাজ বা ভিলেন চরিত্রটার (নাম জানি না) মুখে স্ল্যাং শুনতে খারাপ লাগার কথা না।
কিন্তু রোদ্দুর রায়রে পার্ভার্ট মনে করা দেশি সুশীল শিক্ষিত মিক্লা, যাদের কাছে ‘আঞ্চলিক ভাষা’ ক্ষ্যাতনেসের সিম্বল ছাড়া কিছু না, নিজেদের একসেন্টের আঞ্চলিকতা লুকাইতেই যারা সদাতটস্থ, তারা এই আঞ্চলিকতারে ‘জাস্ট কমিক রিলিফ’-এর বাইরে গিয়া এপ্রিশিয়েট করতে পারে কিনা আমার ডাউট আছে।
ছোট পোলাপাইনের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কারস্বরূপ একটা বাথ সিন আছে, ব্যাকসাইড ন্যুডিটি, লিপকিস আছে। সমুদ্রতটে ডেনমার্কের একট্রেস জোসেফিন লুন্ডেগার্ডের বিকিনি পরা ছোটাছুটি আছে। শরিফুল রাজের ঢাকা আইসা বিপথগামী হয়া গাঞ্জা প্রভৃতি বস্তু সেবনের রিয়ালিস্টিক দৃশ্য আছে। মিনিট বিশেকের সার্ফিং আছে। হাস্যকর ব্যাপারে হইলো যে নারী সার্ফার আয়েশার কাহিনী নিয়া তার সার্ফিং সাকুল্যে দুই মিনিট আছে কিনা সন্দেহ৷
ক্যামেরার কাজ খারাপ না। মুভিতে বেশ কিছু সুন্দর শট আছে। কক্সবাজারের মতো একটা ঘিঞ্জি বিচ ন ডরাই-তে যেমন সুন্দর লাগছে, দেখতে দেখতে মনে হইছে আরেকবার কক্সবাজার চলে যাই। কক্সবাজারের সুন্দর সমুদ্র সৈকতের দৃষ্টিনন্দন ভিউ দেখতে হলে যাইতে পারেন। মিউজিকও খারাপ না, বাংলাদেশের হিসাবে আর কি। শিল্পীদের অভিনয়ও খারাপ না। সমস্যা হইতেছে, বিচ্ছিন্ন নানান ভালো কিছু জোড়াতালি দেয়ার চেষ্টার ওভারঅল প্রোডাক্টটা অত্যন্ত বাজে হইছে। তবে কক্সবাজারে কী একটা রিসোর্ট আছে, ওইটার ভালো প্রচারণা হইছে মুভিতে।
এর বাইরে মুভিটাতে কী কী সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশন, ও গভীর দৃশ্য বা চিন্তাবস্তু আছে তা জানতে দেশের জ্ঞানী ও বোদ্ধা ফিল্ম ক্রিটিকদের সাথে কনসাল্ট করতে পারেন। আমি তেমন কিছু পাই নাই।
সিনেমায় একটা ডায়লগ আছে, যেইটা সোশ্যাল মিডিয়া হয়তো অচিরেই ছড়ানো শুরু করবে: 'ছোদানিরফুয়া আই ন ডরাই।' এইসব মুভি দেখে দেশের সিনেমা পরিস্থিতি নিয়া আসলেই ডরাইছি। বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবলে, হ, আমি আসলেই ডরাই।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন