আম্মা সব সময়ই বলে- সময়ের মূল্য তো বোঝো না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে পস্তাবা।
সময় বোঝার জন্য দরকার ঘড়ি, খেয়াল করে দেখলাম, ঘড়ি জিনিসটার প্রয়োজনই অনুভব করি নাই কোনোদিন (ফলে আমি যে সময়ের ব্যপারে উদাসীন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই)। ঘড়ি যে একটা প্রয়োজনীয় বস্তু হতে পারে, তা এতদিনেও বুঝতেই পারলাম না। আমার এখনও মনে হয়, এই যুগে কটন বাডের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ঘড়ি গেজেটটার কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই (থাকলেও আমি খুঁজে পাই না)।
অবশ্য ২০০১ সালের আগে কোনো দেয়াল ঘড়ি ছিল না আমাদের বাসায়। আমি যখন ছোট, তখন একটা ক্যাসিয়ো ঘড়ি ছিলো বাবার, সেই সময়ে বাবা-চাচা টাইপের সব লোকের হাতেই ওই ঘড়িটা দেখতাম আমি (ভদ্রলোকের এক ঘড়ি!)। নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বাবা সেই ঘড়ি আর ঠিক করায়নি। তার মানে, বাবার কাছেও ঘড়ির কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
আম্মারও একটা ঘড়ি ছিলো, চিকন বেল্টের। বাবার ঘড়িটা মোটা বেল্ট আর মায়ের ঘড়িটা চিকন বেল্টের কেন সে প্রশ্নটা মাথায় আসতো প্রায়ই। বেশিরভাগ দিন অফিসে যাওয়ার সময় আম্মা তার ঘড়িটা বাসায় রেখে যেতো ভুলে। আমি জিনিসটা নিয়ে কী করব? নব ঘুরিয়ে টাইমটা বদলে দেয়া কিংবা খুলে ব্যাটারিটা বের করে আবার জায়গামতো রেখে দেয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার। মাঝে মাঝে অবশ্য ঘড়ির বেল্টটা ছিড়ে কিছুটা ব্যতিক্রম এনেছিলাম, তবে পরবর্তীতে আম্মা যেভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠল, তাতে আর বেশি এগোয়নি। কিন্তু এটা বুঝেছিলাম, আম্মার কাছেও ঘড়ির প্রয়োজন নেই খুব একটা। নইলে কি আর এটা অবহেলায় ঘরে পড়ে থাকতো?
সময় দেখার জন্য মানুষ টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনে- এই ব্যাপারটা খুব অবাক করতো আমাকে। কারণ আমার ঘড়ি দেখতে হতো না। ঘড়ির অভাবও বোধ করিনি কখনো। সকালে ঘুম থেকে উঠতাম, জানালা দিয়ে তাকালেই বুঝে ফেলতাম এখন কোন সময়। টাকলা আঙ্কেলদের হাঁটতে দেখলেই বুঝতাম, এখন ভোর, আরেক রাউন্ড ঘুম দিলে দেশের কোনো ক্ষতি হবে না।
একটু পর রেডিওতে 'দর্পণ' অনুষ্ঠানট শুরু হলেই অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যেতো আম্মা। নয়টার খবরের ইন্ট্রোটা শুরু হলেই আমি বেরিয়ে যেতাম স্কুলের জন্য। তারপর আর ঘড়ির কী দরকার? স্কুলের লতিফ কাকার বাজানো ঘন্টাই জানিয়ে দিতো সময়। আটটা ঘন্টার পর টিংটিংটিংটিং সুরে টানা কিছুক্ষণ ঘন্টা বাজতো, তার মানে ছুটি। আসরের আজান দিলে বুঝতাম এখন খেলতে যাওয়ার সময়, মাগরিবের আজান মানে বাসায় গিয়ে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসা। রাত আটটার বাংলা সংবাদ শেষ, পড়াও শেষ। আর দশটার ইংরেজি সংবাদের পর ভাত খেয়ে ঘুম আসুক না আসুক, বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকা। কী সুন্দর ঘড়িহীন জীবন (যদিও বাকিরা তো ঘড়িই দেখেই খবর পড়তো বা আজান দিতো)!
২০০১ সালে বাংলাদেশের মানচিত্রের শেপে একটা ঘড়ি দেখলাম শিশু অ্যাকাডেমির মেলায়। বায়না ধরলাম, এটা কিনতেই হবে। সময় দেখার জন্য নয়, মানচিত্রটা দেখতেই ভালো লাগতো খুব। সেটাই এখন পর্যন্ত আমাদের বাসার প্রথম এবং একমাত্র দেয়াল ঘড়ি।
যদিও কয়েক মাসের মধ্যেই শোপিসে পরিণত হলো সেটা। ঘড়িতে সময় দেখার অভ্যাস তো নেই, ফলে ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলেও কারও মনে হতো না নতুন একটা ব্যাটারি কেনার কথা। তাছাড়া রাতে ঘুম না এলে ঘড়ির টিকটিক শব্দটা বিরক্ত করতো খুব, বন্ধ হওয়ায় শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। সেই ঘড়ি আজও ঠিক করা হয়নি।
এখনও আমাদের বাসায় কোনো ঘড়ি নেই। তবে মোবাইল আছে। মোবাইল থাকার পরও মানুষ কেন ঘড়ি কেনে তা জানি না। কত দাম দিয়ে ঘড়ি কেনে মানুষ! অবাকই লাগে!
একজন বলল, 'ঘড়ি হইলো ব্যক্তিত্বের বহি:প্রকশ।' কী অদ্ভুত, আরে ভাই, তোমার ব্যক্তিত্বের বহি:প্রকাশ যদি একটা ঘড়ির মতো একটা যন্ত্রের উপর নির্ভর করে তাইলে সেটা আর এমন কি ব্যক্তিত্ব!
তাও এমন এক যন্ত্র, যেটার কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবহার নাই। নাই বলেই হয়তো এখন ঘড়ির এমন ডিজাইন করে, যে ঘড়ি তার নিজস্ব স্বত্তা হারাইয়া ব্রেসলেটের মতো হইয়া গেছে। আর সময় দেখাটাও মুখ্য না, কত হাঁটলাম, রক্তচাপ কত, কে ফোন দিলো, টেক্সট দিলো এইসব হইয়া গেছে মূল।
এই যুগে যিনি ঘড়ি ব্যবহার করেন, নিশ্চয়ই তার কাছে প্রতিটি সেকেন্ড খুব মূল্যবান। প্রতিটি কাজ তিনি ঘড়ি ধরে করেন। এমন হলে, এই যে ঘড়িটা হাতে নিয়ে বেল্ট লাগিয়ে হাতে পরবেন, আবার ঘুমানোর আগে সেই ঘড়িটা খুলবেন। স্মার্ট ঘড়ি হলে চার্জ দেবেন- এতেও তো সময় ব্যয় হয়, যেটা মোবাইলে একটা গুতা মারলেই দেখা যায়। সেক্ষেত্রে একটা বিপদ হতে পারে- এই যে তিনি দামী একটা ঘড়ি পড়লেন, তা দেশ ও জাতি জানতে পারলো না। দামী ঘড়িও তো একটা ভাবের বিষয়।
ওই যে, সেই একই কথা, ভাবের উপরে দুনিয়া। তবে নিশ্চয়ই একদিন ঘড়ির মূল্য না বোঝার জন্য পস্তাবো।
এতে আবার কারও ঘড়িঅনুভুতির কাটা নইড়া গেলে বিপদ!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন