মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসানের লেখায় জনযুদ্ধের ৪টি গল্প

৭৮২ পঠিত ... ২২:৪৯, মে ২৯, ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের গল্প তো আমরা অনেকই পড়েছি, শুনেছি। তবে সে সব গল্পের একটা বড় অংশই আসলে সামরিক বাহিনী কিংবা শিক্ষিত ছাত্র বা শহুরে যোদ্ধাদের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ যেন ইতিহাসের পাতায় কোনরকমে জায়গা করে আছেন। এই বড় অংশটার কেউ ছিলেন সামান্য চাষি, কেউ মাঝি, কেউ দিনমজুর কিংবা কেউ জেলে। মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষগুলোর তেমন বড় কোন স্বার্থ ছিল না। কেবলই প্রগাঢ় দেশপ্রেম এই মানুষগুলোকে নিয়ে এসেছিল যুদ্ধের ময়দানে, সামরিক কর্মকর্তা কিংবা শিক্ষিত শহুরে ছাত্রদের সাথে এক কাতারে। 

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই গণযোদ্ধাদের নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা লিখে ফেলেছিলেন একটি বই 'জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা'। তিনি মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া, জন্মেছিলেন ভাষা আন্দোলনের উত্তাল বছরে। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের ডাকে চলে গেলেন রণাঙ্গনে। কিংবদন্তী দুই মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারকে সাথে পেয়েছেন সহযোদ্ধা হিসেবে। আর সাথে পেয়েছিলেন সেই সব গণযোদ্ধাদের, যারা আজ বিস্মৃত। মুক্তিযুদ্ধের পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে একটা সময় মেজর হলেও কখনোই ভুলে যাননি তার সহযোদ্ধাদের, যারা কি না কালের বিবর্তনে দেশের 'মাইনর' জনগোষ্ঠী হয়ে গেল। এই বিস্মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা বইটি। 

এই অসাধারণ বইটির লেখক মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। এই নির্ভীক গুণী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আজ eআরকির পাঠকদের জন্য থাকছে 'জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা' বইটি থেকে মুক্তিযুদ্ধের চারটি সত্যিকারের গল্প। 

 

#১

একাত্তরের সেপ্টেম্বর। রাত সাড়ে বারোটার দিকে আমরা পাঁচজন পৌঁছালাম বাজারের উত্তর দিক থেকে এসে। কবরগুলোর কাছে রাস্তার লাগোয়া উত্তর পাশে শূন্য পাটের গুদামে রাস্তার দিকে মুখ করে অবস্থান নিলাম। ঘরের কিছু অংশ খুঁড়ে ফারায় করার সুযোগ করতে হলো। আব্বাসও আছে আমাদের সাথে। সবার কাছে এসএমসিসহ ২৮ রাউন্ড করে দুই ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি। কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে, আমি গুলি করবার আগে কেউ গুলি করবে না এবং আমি বন্ধ করতে বলামাত্রই সবাই গুলি বন্ধ করবে। আমাদের পশ্চাদপসরণের পথ এবং মিলনস্থান পূর্ব-নির্ধারিত ছিল। তবুও আমরা একেবারে নির্ভয়ে ছিলাম না। দালালদের গায়ে সাইনবোর্ড থাকে না। তাছাড়া ভেতরে পশু হলেও গড়ন, গঠন তো মানুষেরই মতো। রাত দু’টোর কিছু বেশি বাজে। চাঁদনি রাত। নিশ্চুপ অপেক্ষা করছি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পাঁচজন পাকিস্তানী সৈনিক কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে গল্প করতে করতে থানার দিক থেকে বাজারের দিকে আসছে। আব্বাস আমার পাশে। রাতের নিস্তব্ধতায় ওদের কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। ওরা তখনো প্রায় পনেরো গজ দূরে। আমাদের সামনে এলে দূরত্ব হবে পাঁচ গজের কাছাকাছি। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি একজন বলছে, “শ্যালা, মুক্তিলোগ কিধার হ্যায়? উনকো পাতা নেহি মিলতা হ্যায়?” আব্বাস উর্দু জানে না, অর্থ বোঝারও কথা নয়। শিশু হোক আর পশু হোক- আদর, স্নেহ, ঘৃণা, অবজ্ঞা, ভালোবাসা সবাই এসবের মর্ম বোঝে। হয়তো তেমনই কিছু একটা বুঝল আব্বাস। আমার কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করেই বলে উঠল, “স্যার, আমি পাতা মিলাইয়া দেই?”- বলেই ফায়ার। এক লম্বা বার্স্টে বোধহয় এক ম্যাগাজিন গুলি ওর শেষ হয়ে গেল। ক্ষণভঙ্গুর সেই মুহূর্তে আমাদের সময় নষ্ট করার সময় ছিল না। উপর্যপুরি কয়েক বার্স্ট ফায়ার ক’রে শুধু ওদের, আমার মাতৃভূমির উপরে চেপে বসা অমানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করলাম।

#২

শিকারপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে সৈনিক ভর্তির সময় যশোরের আজমলকে তার পেশা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে আজমল অম্লান বদনে জানাল, ‘স্যার, বেলাক করি।’ মাথায় করে মালামাল সীমান্তের এপার ওপার করাকে একটি নির্দোষ পেশা মনে করে এই সহজ সরল যুবক। ছ’ফুট উচ্চতার পঁচিশ বছর বয়সী যুবক আজমল। যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম সাহসী। রেকি করার সময় তাকেই সবসময় সামনে রাখে সঙ্গীরা। একদিন বিকালে রেকির সময় একা সে শত্রু ব্যাংকারের একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে- না জেনে। হঠাৎ এক পাকসেনা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায় দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি। দু’জনেরই অস্ত্র ছিটকে পড়েছে। বাকি পাকসেনারা গুলিও করতে পারছে না। অন্য পাকসেনারা এসে আজমলকে ধরার আগেই সে পাকসেনাকে দুহাতে শূন্যে তুলে নেয়। শত্রুর গুলি যেন না লাগে সেজন্য। পাকসেনাকে শত্রুর দিকে রেখে সে পেছন হয়ে দৌড়াতে থাকে। এরই মধ্যে শত্রুর গুলিবৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। দৌড়ের এক পর্যায়ে আজমলের পরনের একমাত্র লুঙ্গিটিও খুলে পড়ে যায়। দিগম্বর আজমল পাকসেনাকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে উল্টা দৌড়াচ্ছে। পাকসেনা হাত পা ছুড়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছে, আর আজমল বলছে, ‘ভাই, আমাকে একটু সামনে এগিয়ে দিয়ে আয়’। প্রায় পঞ্চাশ গজ দৌড়ে একটা গাছের আড়ালে নিরাপদ স্থানে এসে পাঞ্জাবি সৈনিককে ছেড়ে দিতেই দুজনেই দু’দিকে ভৌঁ দৌড়।

#৩

সেপ্টেম্বর মাস। মেলাঘরের সদর দপ্তরে মেজর খালেদ, মেজর মতিন এবং ক্যাপ্টেন হায়দার কী নিয়ে আলাপ করছেন। আমাকে মেজর খালেদ ডেকে পাঠিয়েছেন কেন, আমি জানি না। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ফিল্ড টেলিফোন বেজে উঠল। মেজর খালেদ ফোন ধরলেন। বোধকরি মনোযোগ চলমান আলোচনায় থাকায় তিনি টেলিফোনের আলাপে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। কে টেলিফোন করেছে জানি না। জানা সম্ভবও ছিল না। ক’সেকেন্ডের কথা শুনে খালেদ বললেন, ‘সবাইকে চোখ বেঁধে রেখে দাও।’ এরপর ঘণ্টা দু’য়েকের আলোচনা শেষে মেজর খালেদ ক্যাপ্টেন গফফারের সাব-সেক্টর সদর দপ্তর কোণাবন যাবেন। আমাকে বললেন গাড়িতে উঠতে। M-38 খোলা জিপের পিছনে উঠে বসলাম। গাড়ি মেইন আর পি (Regimental Police) চেক পোস্ট পার হয়ে ১৫-২০ গজ পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ খালেদ গাড়ি পেছাতে বললেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় ৮/৯ জন ১৪/১৫ বছরের কিশোর। খালেদ আর পি হাবিলদারের কাছে জানতে চাইলেন, কেন এদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। আর পি হাবিলদার জানাল, ‘স্যার, আপনিই তো এদের চোখ বেঁধে রাখতে বলেছেন।’ খালেদের এবার হয়তো মনে পড়ল; আদেশ দিলেন ওদের চোখ খুলে দিতে। জিজ্ঞাসা করলেন ওদের, ওরা কী চায়। মুহূর্তের মধ্যে সবগুলো কিশোর ক্রোধে খালেদের ওপর ফেটে পড়ল। এরা আর্মি চেনে না, এরা মেজর চেনে না, এরা সেক্টর কমান্ডার কী জানে না। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি আমাদের চোখ বাঁধার হুকুম দেবার কে? আপনার সাথে যুদ্ধ করতে না দিলে আমরা অন্য জায়গায় যুদ্ধ করব। বাংলাদেশ কি একা আপনার?’ খালেদ হাসছেন। এ হাসির অর্থ আছে। এ হাসি আত্মবিশ্বাসের হাসি। এ হাসির অর্থ- এ প্রত্যয়ী জাতির যেভাবেই হোক, যতদিনেই হোক যুদ্ধে বিজয় অনিবার্য।

দেখতাম এই কিশোরদের খালেদ পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের ব্যাংকার দেখিয়ে বলতেন, ‘যারা আমার সামনে শত্রুর ঐ ব্যাংকারগুলোর ভেতর গ্রেনেড ফেলে আসতে পারবে তাদের জন্য পুরস্কার এই ঘড়ি’। ঘড়ি পুরস্কারের জন্য নয়, অদম্য সাহস আর কী প্রবল দেশাত্মবোধ ছিল এ কিশোরদের। এ আদেশ শুনে প্রথম দিন খালেদকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। কিন্তু না। দিনের আলোয় আমাদের সবার সামনে পাকিস্তানি ব্যাংকারগুলো প্রকম্পিত করে ধুলার আঁধার বানিয়ে ফেলল এরা। অশ্রুসিক্ত চোখে খালেদ ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এ যেন এক পিতা তার সন্তানদের কাঁধে ওজন রেখে হাঁটতে শেখাচ্ছেন।

#৪

ছেলেটির নাম তৈয়ব আলী। লেখাপড়া নেই; থাকলেও খুবই সামান্য। শক্ত গঠন এবং কিঞ্চিৎ স্থূল গড়নের বেটেখাটো এই ছেলেটি ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় তাকে একটি এলএমজি দেবার জন্য রীতিমতো অনুনয় করতে লাগল। অপারেশন রুমের পাশে আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে। এলএমজি তখন একটি দুষ্প্রাপ্য অস্ত্র। তাছাড়া এই অস্ত্রটি ক্লোজ কোয়ার্টার ব্যাটেল অস্ত্র নয় এবং এটিকে সহজে লুকানো যায় না বলে সাধারণত গেরিলা দলকে এ অস্ত্র প্রদান করা হয় না। তৈয়ব আলী এমন সরলভাবে ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে আকুতি মিনতি করতে লাগলে যেন ক্যাপ্টেন হায়দার ইচ্ছে করলেই তাকে এটি দিতে পারেন, কিন্তু দিচ্ছিলেন না। হায়দার মুচকি মুচকি হাসছেন। বললেন, ‘যুদ্ধ আগে কিছু করো, এলএমজি পাবে।’ কিছুদিন পর তৈয়ব আলী গামছায় বেঁধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশের এক ক্যাপ্টেনকে হত্যা করে তার ব্যাজেজ অফ র‍্যাংক, সাদা বেল্ট, লাল টুপি, বুট পাউচসহ পিস্তল এনে ক্যাপ্টেন হায়দারের সামনে উপস্থাপন করল। ‘স্যার যুদ্ধ কইরা আইছি, এইবার এলএমজি দ্যান।’ তৈয়ব আলী তার অনুরোধে পুরোমাত্রায় আন্তরিক।

তারও বেশ কিছুদিন পরের কথা। ২ ইঞ্চি মর্টার এবং এনারগা-৯৮ রাইফেল গ্রেনেড ফায়ারিং-এর ডেমনস্ট্রেশন এবং অনুশীলনের জন্য ক্যাপ্টেন হায়দার আমাদের নিয়ে গেলেন মধ্য-সমতল এলাকার এক পাহাড়ি অঞ্চলে। প্রথমে কয়েকটা এনারগা-৯৪ গ্রেনেড ফায়ার করা হলো পাহাড়ে লক্ষবস্তু স্থাপন করে। ২ ইঞ্চি মর্টার বস্তুত কার্যকরী কোন যুদ্ধাস্ত্র নয়। ২ ইঞ্চি মর্টারের ব্যবহার মেশিনগান এবং রিকয়েললেস রাইফেলের লোকাল প্রটেকশান ও আক্রমণ শেষে বিভিন্ন রং-এর গোলা ফায়ার করে সংকেত দেয়ার জন্য। এর রেঞ্জ মাত্র চারশ গজ। তবুও যেহেতু দুষ্প্রাপ্য, তাই বোধকরি তৈয়ব আলীর লোভ হলো ২ ইঞ্চি মর্টারের প্রতি। আবার ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে আকুতি, তাকে একটা ২ ইঞ্চি মর্টার দেবার জন্য। তৈয়ব আলীর কথা এবং কাণ্ড কারখানায় শুধু ক্যাপ্টেন হায়দারই নন আমরাও খুব মজা পেতাম। হায়দার আবার হাসতে হাসতে তৈয়ব আলীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলোতো ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা কতদূর যায়?’ তৈয়ব আলী সামনের পাহাড়ের নিচে ছোট একটু চারা গাছ দেখিয়ে বলল, ‘স্যার অমন ওদ্দুর যাইব।’ চারশ/সাড়ে চারশ গজ। জবাব শুনে ক্যাপ্টেন হায়দারের গালের কোণা প্রায় কানের লতির সাথে লাগার উপক্রম। হাসি কোনোরকমে থামিয়ে বললেন, ‘যাও, যদি বলতে পার কীভাবে মারলে অতদূর গোলা যাবে, তবেই তোমাকে মর্টার দিব।’ মজার উত্তর এলো এখন তৈয়ব আলীর কাছে থেকে, ‘স্যার, হোতাইয়াও না, আবার খাড়া কইরাও না।’ বাম হাত আড়াআড়ি করে রেখে ডান হাত তার ওপর বাঁকা করে বলল, ‘এইরকম স্যার, মাঝামাঝি।’ অপূর্ব! ঠিক ৪৫ ডিগ্রি এ্যাংগেল। Theory of Small Arms Fire, High Trajectory Weapon Training, Calculus পড়বার কোনো প্রয়োজনই রইল না।

৭৮২ পঠিত ... ২২:৪৯, মে ২৯, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top