১.
বাড়ির নাম ‘চামেলী ভবন’। টিপসি নাম দিয়েছে ‘চামেলী সেন্ট্রাল জেল’। ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। ডান হাতটা বাবার হাতে ধরা। আর মাথাটা রেখেছে মায়ের কাঁধে। দুই চোখে কেমন জানি অন্ধকার। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে যেকোনো সময়। মুখস্থের মতো বলে চলেছে নয়ন, 'মেয়েকে কিছুই তো শেখাননি পড়াশোনা ছাড়া। তরকারিতে আজ নবন কম তো কাল হলুদ বেশি। পনেরশো স্কয়ার ফিটের বাড়ি ঝাড়পুছ করতে গিয়েই মাজার ব্যথায় হাসপাতালে! ডাক্তার আবার বলেছে ভারী কাজ করাবেন না। আল্লাদা কত!'
এতক্ষণ বহুকষ্টে চুপ ছিলেন নয়নের মা। এবার শুরু করলেন 'হাসপাতাল থেকে ফেরার পর এককাপ চা চেয়েছিলাম। চিনির বদলে লবণ দিয়েছে। বলে কিনা মাথা ঘুরাচ্ছিল তাই চোখে ভুল দেখেছে। নেকু! তোর বয়সে আমি তো ডুপ্লেক্স বাড়ি একাই সামলাতাম।
এদেশের পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারনে নয়নের বাবার কথার সেই বাড়িতে থোড়াই মূল্য আছে। শশুরের টাকায় পড়ে পাওয়া ডিগ্রী আর তার তদবিরে পাওয়া চাকরির কথা বারবার মনে পড়ার কারনেই কি না জানি না, স্ত্রীকে উনি অসম্ভব ভয় পান। তবুও আজ বলেই ফেললেন- 'তোমার তো তখন থেকেই দুইজন কাজের লোক ছিল। বঊমা এই বাড়িতে আসার পরপরই তো তুমি ওদের বাদ দিয়ে দিলে।'
'চুপ! কাজের লোক ছিল! ওগুলো কোনো কাজ জানতো নাকি? সংসারের তুমি কী বোঝো?'
স্ত্রীর ধমকে বেচারার প্যান্ট ভিজে গেল কি না বোঝা গেল না। কিন্তু, তিনি ওখান থেকে চলে গেলেন।
নয়ন আবারও শুরু করলো- 'এই অচল মাল আপনারা নিয়ে যান। তালাকনামা আমি পাঠিয়ে দেব।'
'কষ্ট করে পাঠাতে হবে না, ওটা আমার মেয়েই পাঠিয়ে দেবে'- এতক্ষণ বাদে মুখ খুললেন টিপসির বাবা। 'তোর মতো অমানুষের সংসার আমার মেয়ে করবে না। তুই মুড়ি খা।'
বয়স্ক একজন মানুষের মুখে এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল মা আর ছেলে। বাবা মায়ের সাথে টিপসি হেঁটে চললো বাড়ির পথে। পেছনে পড়ে রইলো চামেলী সেন্ট্রাল জেল। আর কিছু দুঃসহ স্মৃতি। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু...
২.
ছয়মাস পর।
ইন্টারনেটে রেজাল্ট দেখে প্রথম ফোনটা টিপসি বাবাকেই করলো। 'বাবা আমি মেকাট্রনিক্সে চান্স পেয়েছি।'
-আলহামদুলিল্লাহ । কংগ্রাচুলেশনস,মা । আমার বিশ্বাস তুই ভালো করবি ।
-বাবা, আজকে তাড়াতাড়ি এসো। বাসায় চাইনিজ রান্না করব।
-কী রাঁধবি রে মা? একা ফেরদৌসীর রেসিপিতে নুডুলস না তো?
-বাবা, তুমি পারোও। তাড়াতাড়ি চলে এসো।
ফোন রেখেই টিপসি ছুটে গেল মা কে বলতে। অনেক কাজ এখন। আজ এই বাড়িতে একটি আনন্দের দিন। ভালোমন্দ রান্না না হলে কী চলে?
৩.
পরের বছর...
ভার্সিটির রোবটিক্স ক্লাবে আজকেই ঢুকেছে টিপসি। এখন বসে আছে ক্লাব প্রেসিডেন্ট খুশবুর সাথে।
'ওয়েলকাম টু দ্য রোবটিক্স ক্লাব, টিপসি। তোমার মতো মেয়েদের এই লাইনে খুব দরকার। পৃথিবীকে কত কিছুই না দেবার আছে আমাদের। এপোলো-১১ এর ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন একজন নারী, পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার ছিলেন নারী। আজকের ওয়াইফাই ইন্টারনেটও এসেছে একজন নারীর গবেষনার পথ ধরেই। আর আমরা? চার বছর পড়াশোনা করে একটা ইঞ্জিনিয়ার জামাই জোটাতে পেরেই মনে করি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সার্থক! বেগম রোকেয়া আমাদের দেখে কী বলতেন কে জানে।'
বলতেন, 'মাইরালা। আম্রে কেউ মাইরালা।' খুশবুর কথার এতক্ষণে একটা উত্তর দিতে পারলো টিপসি।
'তোমার সেন্স অব হিউমার অসাধারন। চল, আমাদের কিছু প্রজেক্ট তোমাকে দেখাই। কয়দিন পর তো তুমিই করবে'। খুশবুর সাথে ঘুরে ঘুরে প্রজেক্টগুলো দেখে টিপসি অবাক! এতো সুন্দর কাজও হয় এখানে?'
৪.
দুই বছর পর।
ভার্সিটির লেডিস কমন রুমের সামনে বড়সড় একটা জটলা। ক্যাম্পাসে টিভি ক্যামেরা মেয়েরা আগে খুব একটা দেখেনি।
সাংবাদিক মেয়েটা টিপসিকে প্রশ্ন করলো-টিপসি, আপনার দল তো এবার নাসা লুনাবটিক্স মাইনিং প্রতিযোগীতায় তৃতীয় হল। আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
'আমার স্বপ্ন ভার্সিটির টিচার হওয়া। পাশাপাশি আমি একটি রোবট ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে চাই।' দৃঢতার সাথে উত্তর দেয় টিপসি।
৫.
আরও তিন বছর পর
'ভাতটা খেয়ে নে মা। আর কত দেরি করবি?' ভাতের থালাটা টিপসির টেবিলে রাখতে রাখতে বলল মা। ছয়তলার গেস্টরুমটাতেই টিপসি বানিয়েছে তার রোবট ল্যাব। কর্মী আপাতত সে আর তার দুইজন ব্যাচমেট। ক্লাস নিয়ে দুপুরে ফিরেই টিপসি ঢুকেছে ল্যাবে। কিচ্ছু খায়নি।
-বড় ঝামেলায় আছি মা। কোডটা ডিবাগ না করা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না।
-তুই কাজ কর, আমি খাইয়ে দিই।
-তুমি কষ্ট করবে কেন? রেখে যাও, আমি খেয়ে নেব।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাতের থালা রেখে চলে গেলেন মা। তিনি জানেন, কোড ডিবাগ না করে মেয়ে কিছুই মুখে দেবে না। বেচারির মনে রাজ্যের দুশিন্তা। স্বাস্থ্য নিয়ে এতো উদাসীন হলে চলে?
কেটে গেল আরও আটটি মাস ।
৫.
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না টিপসি। এত দিনের কষ্টের ফল তবে কি সে অবশেষে সত্যিই পেয়ে গেছে? সত্যি?
৬
ফিরে আসি চামেলী ভবনে।
কাস্টমারদের কাছ থেকে ঘুষ নেবার অভিযোগে গতমাসে নয়নের চাকরিটা গেছে ।এখন তার অখন্ড অবসর। ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিল। হঠাত দেখে ওলেড টিভির স্ক্রিনটা কেমন যেন ময়লা ময়লা মনে হচ্ছে। চা নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলো তার বর্তমান স্ত্রী সাবিরা।
'টিভির স্ক্রিনটা ময়লা ময়লা লাগছে। মোছো না?' নয়ন প্রশ্ন করলো স্ত্রীকে।
-কালকেই তো মুছলাম।
-কালকেই তো মুছলাম! আজকে মুছবে কে, মহারানী?
-ধমক দিও না । ঐ ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি আমার বাপই তোমাকে দিয়েছিল।
-আবার মুখ চালানো শিখেছে। দাঁড়া তোর মুখ বন্ধ করি কিভাবে, দেখ।
নয়নের হাতটা উঠলেও পড়লো না জায়গামতো। তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখে কুরিয়ারের লোক দাঁড়ানো- 'স্যার, একটা পার্সেল আছে আপনার নামে।'
লম্বা একটা প্যাকেট। দেখে মনে হচ্ছে ফ্রিজ-টিজ হবে কিছু। অনেক চিন্তাভাবনা করে প্যাকেট খুলল নয়ন। বেরিয়ে এলো প্রায় তার সমান লম্বা একটি হিউম্যানয়েড রোবট। হাতে একটা কাগজ। গায়ের চাবিটা ঘোরাতেই শুদ্ধ বাংলায় বলে উঠলো- 'আমি রিয়া। আমি খুব ভালো রান্না করতে পারি। টিপসি আপনাকে এই চিঠিটা দিয়েছে।' কাপাকাঁপা হাতে চিঠিটা নিয়ে পড়তে লাগলো নয়ন ।
জনাব,
আমাদের ল্যাবে তৈরী এই হিউম্যানয়েড রোবটটি আপনাকে উপহার হিসেবে পাঠালাম। এর বাজারমূল্য কয়েক লক্ষ টাকা। রিয়া রান্নার সময় হলুদ-লবন একদম ঠিকঠাক মেপে মেপে দিতে পারে। দশ বালতি কাপড় কাঁচতে পারে মাত্র পাঁচ মিনিটে। মানুষের মতো পায়ে ব্যাথা, কোমরে ব্যথাও ওর নেই। ও হ্যাঁ, ওকে দিয়ে মাত্র আধাঘন্টার মধ্যেই আপনার পুরো বাড়ি গুছিয়ে ফেলা সম্ভব। ও কোনো কাজে ভুল করবে না। শুধু রোজ এক ঘন্টার জন্য চার্জ দিতে হবে। এছাড়া সে আর কিছুই চাইবে না। এরকম আরো দুটি রোবট আমরা দিয়েছি দুটি নামকরা রেস্টুরেন্টে। কোনোটা নিয়েই কোনো অভিযোগ আসেনি। সব ঠিক থাকলে আজ রাতের ফ্লাইটে জাপান যাচ্ছি পিএইচডির জন্য। আশা করি ওখান থেকে ফেরার পর আরও ভালো রোবট বানাতে পারব। সবগুলোই বাজারে ভালো বিক্রি হবে। ভেবে দেখলাম, কিছু ‘মানুষের’ চাহিদা পূরনে মানুষের চেয়ে রোবটই বেশি উপযুক্ত।
বিনীতা
টিপসি জামান
সিইও, রোবোল্যান্ড বিডি
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন